জুলিয়া আলম
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:০৯ পিএম
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

রাজনীতির শেকলে বাঁধা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার ও আন্তঃবাণিজ্য

দক্ষিণ এশিয়া। ছবি : সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়া। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ব অর্থনীতিতেও বড় প্রভাবক দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য এখানকার দেশগুলোর নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব রাখছে? এটি বুঝতে হলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শচীন চতুর্বেদীর একটি মন্তব্যকে চিন্তার খোড়াক হিসেবে নেওয়া যায়। ভারতীয় থিংক ট্যাংক রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের মহাপরিচালক সম্প্রতি ঢাকায় বলেছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে এখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে দক্ষিণ এশিয়া কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই অঞ্চলের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই বাণিজ্য বা আন্তঃবাণিজ্যের হার এখনো খুবই হতাশাব্যঞ্জক।’

আন্তঃবাণিজ্য নিয়ে হতাশা কেন? একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনমানের উন্নয়ন আধুনিক রাষ্ট্রের সরকার ও রাজনীতির একটি অন্যতম প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রয়োজনেই বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। তবে ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নৈকট্যের বাস্তবতায় এক্ষেত্রে ব্যাপক বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের চেয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্য একটু বেশি ফলদায়ক।

গত চার দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ধীরে ধীরে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৫ কোটি ডলার। ২০১০ সালে বেড়ে ১ হাজার ৬শ কোটি ছাড়ায়। আর ২০২২ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটিতে ঠেকেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২২ সালে বাণিজ্য হয় ৩ হাজার ৯৫৫ কোটি ডলারের, যেটি সে বছর দেশগুলোর সবার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। কিন্তু আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এখন পারস্পরিক বাণিজ্য গড়ে ২৬ শতাংশ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে সেটি ৬২ শতাংশের বেশি।

দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ৪ হাজার কোটি ডলার, তবু সংখ্যাটিও খুবই হতাশাব্যঞ্জক কারণ সারাবিশ্ব থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আমদানিই করে ৬৮ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি পণ্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের নিজেদের বাজার সম্ভাবনাই নিজেরা ব্যবহার করতে পারছে না! সত্যিই তাই। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৪ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে কিন্তু অঞ্চলে বাস করে প্রায় ১৯০ কোটি মানুষ বা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর অর্থ হলো- আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সম্মিলিত জনপদে বিশ্বের প্রতি ৪ জন ভোক্তার বাস। যদিও এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আন্তঃবাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজনে উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, কৃষির রূপান্তরকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারত দক্ষিণ এশিয়া; যেটি দারুণভাবে করেছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলো।

বাজার ঢেকে যায় রাজনীতিতে ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’- শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত সেই কবিতার চরণের সাথে মিলিয়ে বলতে হয়, ‘বাজার ঢেকে যায় রাজনীতিতে।’ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারের সম্ভাবনা আসলেই রাজনীতির দাপটের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। আসলেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য এখনো বাজারের ওপর নির্ভর করছে না। এখানে মূলত কাজ করছে রাজনীতি। এ ছাড়া নিরাপত্তা, আমলাতন্ত্র- এসবও বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসবের পেছনেও সবচেয়ে বড় কারণ হলো রাজনীতি। মানুষের তৈরি বাধার কারণেই বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ছে না।

কেসস্টাডি বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশই চার ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। উচ্চ শুল্ক, আধা শুল্ক ও অশুল্ক বাধা, কানেকটিভিটি খরচ এবং সীমান্তে আস্থার সংকট। যদিও সাফটা চুক্তি থাকায় বাণিজ্যে শুল্ক থাকারই কথা নয়। তবে কেন থাকছে? আসলে সাফটার মূলনীতি থেকেই সরে এসেছে সার্কভুক্ত দেশগুলো। আঞ্চলিক অর্থনীতির সম্মিলিত প্রতিশ্রুতির জায়গা এখন দখল করেছে অবিশ্বাস। আর তিক্ত হলেও সত্য হলো যে, বড় দেশের খবরদারির মানসিকতা এর জন্য দায়ী। সেটি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রতিবেশীর ভাগ বুঝি না, আমার বাজারে আমারই সব’। আসলে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ বড় ভোক্তাবাজারের দেশগুলো আগ্রহী না হলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য এগোবে না। কারণ ভোক্তা সংখ্যার বিবেচনায় ভারতের বাজার এ অঞ্চলে বড় দেশ; তাই তাদের দায় এখানে সবচেয়ে বেশি ।

আন্তঃবাণিজ্যের তোড়ে দূর হতে পারত দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ায় গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় চার দশকের ব্যবধানে শূন্য দশমিক ৭৭ ডলার থেকে ৬ দশমিক ২৫ ডলার হয়েছে । প্রচলিত প্রচারমূলক রাজনীতির মতো মোটিভেটেড হয়ে চিন্তা করলে মনে হবে, দারুণ অগ্রগতি কিন্তু বিষয়টি যদি অন্যভাবে ভাবি তবে বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ গড়ে প্রতিদিন ৩ দশমিক ৬৫ ডলারের আয় নিয়ে জীবন চালায়। যেখানে প্রতি ১০ জন মানুষের কমপক্ষে ৪ জনকে চার ডলারের কমে একটি দিন কাটাতে হয় সেটিকে আর যাই হোক সুখী সমৃদ্ধ আর মানবিক জনপদ বলা যায় না। রাজনীতির অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি সেখানে পূরণ হয়েছে তাও বলা যায় না। এ বিষয়টিই স্পষ্ট হয়েছে নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ১৪তম দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিক সম্মেলনে কয়েকটি সেশনের আলোচনায়। এ অঞ্চলের অর্থনীতিবিদদের বড় এই সমাবেশে এসে সবাই এটি অনুধাবণ করেছেন যে, অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক শক্তিশালী করতে খুব বেশি এগোতে পারেনি ৮ দেশের ভৌগোলিক জোট দক্ষিণ এশিয়া। যদিও ভূ-রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বের কাছে দক্ষিণ এশিয়া আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাণিজ্য না বাড়লে একক মুদ্রা দিয়ে কী হবে? অর্থনীতির ইতিহাসে পড়া সবাই জানেন যে, বাণিজ্যের প্রয়োজনে মুদ্রার আবিষ্কার হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃবাণিজ্য প্রচণ্ড দুর্বল থাকার পরও নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের যুক্তিতে একক মুদ্রা বা কমন কারেন্সির প্রচলন নিয়ে কথা উঠে বেশ কয়েক বছর আগেই। এবার ঢাকায় আঞ্চলিক অর্থনীতি নিয়ে সর্বশেষ সম্মেলনেও একক মুদ্রার বিষয়টি আবার আলোচনায় ওঠে। তবে অর্থনীতিবিদ ও আলোচকরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কমন কারেন্সি প্রচলনের মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি।

নেপালের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অর্থনৈতিক উপদেষ্টা যশরাজ পান্ডে কমন কারেন্সির আগে একটি আঞ্চলিক আর্থিক বাজার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। আর পাকিস্তানের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আবিদ কাইয়ুম সুলেরি বলেছেন, একটি কমন কারেন্সির আশা হারানোর পরিবর্তে, ডলারনির্ভরতা কমানোর পথ অন্বেষণ করা বেশি জরুরি। সেটি সমর্থন করেন ভারতের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শচীন চতুর্বেদীও।

আলোচনায় বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের যুক্তিগুলো বেশ জোরালো। তিনি যা বলেন তা হলো একটি অঞ্চলের জন্য একক মুদ্রা প্রচলনের জন্য অর্থের অবাধ চলাচল, সীমান্ত অতিক্রম করার স্বাধীনতা, ঝুঁকি সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের শর্তগুলো আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে ঢাকায় সম্মেলনটির সব আলোচনার সারাংশই বলে দেয়, এই অঞ্চলের আঞ্চলিক বাণিজ্য আন্তঃবাণিজ্য এবং আর্থিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে নিজেদের জন্য কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদরা।

জুলিয়া আলম : অর্থনৈতিক সাংবাদিক, বিশ্লেষক এবং টিভি উপস্থাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

ভারতীয় দলে আচমকা পরিবর্তন

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

৮ বিভাগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস

৬ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি

কুমির ভেবে ঘড়িয়াল বেঁধে রাখলেন স্থানীয়রা

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

টাঙ্গাইলে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত ২১

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

বন্যা মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বৈঠক

১০

খুবিতে তৃতীয় নৈয়ায়িক ন্যাশনালসে চ্যাম্পিয়ন চবি

১১

গণহত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি সমমনা জোটের

১২

সিলেট কারাগারেই চিকিৎসা চলছে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানের

১৩

৬ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ : মাহফুজ

১৪

রায় দিয়ে ‘বাবার ট্রাস্টে’ টাকা নেন বিচারপতি

১৫

‘সাংবাদিকরা সমাজে মেডিয়েটরের ভূমিকা পালন করে থাকেন’

১৬

দুর্গাপূজায় সনাতনীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বিএনপি : মাহবুবের শামীম

১৭

নাসা স্পেস অ্যাপস প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন জবি

১৮

ষড়যন্ত্র বানচালে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : প্রিন্স

১৯

কার হাতে কত সোনার মজুত?

২০
X