রাজু নূরুল
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৫০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
রাজু নূরুল

আজকের ফিলিস্তিন সমস্যার মূল কারণ ব্রিটিশ

১৯৩৮ সালে ফিলিস্তিনে আরব বন্দিদের নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ছবি: সংগৃহীত
১৯৩৮ সালে ফিলিস্তিনে আরব বন্দিদের নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের সঙ্গে ইরানের এক ছেলে পড়ে। দেখতে গড়পড়তা ইরানিদের মতোই। বেশ লম্বা-চওড়া। গায়ের রংটা অবশ্য ততটা সাদা নয়। অনেকটা আমাদের মতো। ওর নাম মাহাদী। প্রথমবারেই ওর নাম ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পেরেছি বলে সে বেশ খুশি হলো! আমি বললাম, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার নামটি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় একটা নাম। প্রতি বাড়িতে, প্রত্যেক ক্লাসে গড়ে একটা করে মাহদী পাবা। সামান্য একটু তফাত আছে অবশ্য! তোমরা যেটাকে মাহদী বলো, সেটা আমাদের দেশে মেহেদী। আর তা ছাড়া ইরান আমাদের দেশের মানুষের কাছে খুব পপুলার একটা নাম। ইরান সংক্রান্ত সব গুরুত্বপূর্ণ খবর আমাদরে দেশের পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়। আর ইমাম মাহাদীর ব্যাপারটাতো আছেই!’ সে সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল। বলল, ‘এটা আমি জানি।’ ‘তা ছাড়া, আমাদের বাংলা সিনেমার এক নায়কের নামও ছিল মেহেদী। আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন তিনি নায়কের পার্ট করতেন। প্রচুর অশ্লীল সিনেমায় অভিনয় করেছেন।’ বললাম আমি। আমার কথা শুনে মাহাদী হেসে খুন। সে ভাবতে পারছে না, তার নামের ফিরিস্তি বলতে গিয়ে এরকম একটা উদাহরণ আমি দিতে পারি। সে হাসছে আর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাসি দেখে জেফার নামের আরেকজন ছাত্র এগিয়ে আসল। সে এসে হাসির কারণ জানতে চাইছে। জেফার আসার পর আমি খানিকটা সরে দাঁড়ালাম। এর পেছনে আছে এক মর্মান্তিক ঘটনা। দুই/তিন সপ্তাহ আগে জেফার আমাদের এলাকায় যায়। হেমন্ত উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি বন্ধ। কয়েকদিন কারো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। জেফার আমাকে কল দিল। বলল, ‘তোমাদের এলাকায় আসছি।’ ‘বাহ! বাসায় আসো।‘ ‘লোকেশন পাঠাও।’ আমি হোয়্যাটসঅ্যাপে লোকেশন পাঠালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাসার নিচে এসে হাজির। কলিংবেল বাজাল। আমি ওপর থেকে দরজা খুলে দিলাম। রুমে এসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি তাকে এটা সেটা খেতে দিচ্ছি, গল্পগুজব চলছে। আমি খাটের ওপর পা তুলে আরাম করে বসা; আর সে বসেছে চেয়ারে। রুমে একটাই চেয়ার। কিছুক্ষণ পরপর দেখি জেফার আমার খাটের দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না, ঘটনাটা কি!! অনেকক্ষণ পর মনে হলো, ‘আরে আমি করছিটা কি? ও তো গে। এটা বীভাবে ভুলে বসে আছি আমি?’ দুপুরের রান্না করার নামে তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে নিচতলার রান্নাঘরে ঢুকে ‘ইজ্জত’ বাঁচালাম! আমাদের ওয়ার্কশপ শেষ। মাহাদী বলল, চল আমার বাসায়। এক সঙ্গে লাঞ্চ করি। আজ সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে কাজ। তাই আমি বাসা থেকে বাটিতে ভরে খাবার নিয়ে আসছি। কোথাও গরম করে ফেললেই হবে। এখানে বাইরে খাওয়া প্রায় অসম্ভব। মাঝারি সাইজের একটা বার্গার খেলেও ৮-৯ ইউরো বেরিয়ে যায়। বাংলাদেশের হাজার টাকার ওপরে। সে বলল, ‘আমার বাসায় ওভেন আছে। অসুবিধা হবে না।’ ক্যাম্পাসের ঠিক উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ে তার বাসা। এক মিনিটও লাগে না যেতে। আমি খাবার গরম করছি। ও রান্না বসাল। ভাতের সঙ্গে এগপ্ল্যান্ট! ক্যানের খাবার। ইরানিদের খাবারের ধরন আমাদের চেয়ে একেবারে আলাদা। হঠাৎ বলল, ‘তুমি আজ ওয়ার্কশপে বসে মিটমিট করে হাসতে ছিলে, ঘটনা কী?’ আমি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আরও চেপে ধরল। ইরানিয়ানদের সব ব্যাপারে প্রবল কৌতূহল। সারাক্ষণ শুধু প্রশ্ন করে! আমি বললাম, ‘ওয়ার্কশপের টপিকটা দেখছো? কঙ্গোর নগর এলাকায় খাবার পানির সংকট!’ এই কঙ্গো ছিল বেলজিয়ামের কলোনি। ৫২ বছর ধরে শাসনের নামে চলেছে অত্যাচার আর লুটপাট। কঙ্গো প্রাকৃতিক ধনসম্পদে ভরপুর একটা দেশ। হীরে তার মধ্যে প্রধান। সেই হীরে লুট করে ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ বানাইছে ইউরোপ।’ ‘তাতে হাসির কি হলো?’ ‘না তেমন কিছু না। এখন বেলজিয়ামের গবেষকেরা পৃথিবীর সুন্দর শহরগুলোর একটার আধুনিক শ্রেণিকক্ষে বসে এই নিয়ে গবেষণা করে যে, কঙ্গোর শহরের লোকজন কেন নিরাপদ খাবার পানির কষ্টে আছে! তাও গত ১০ বছর ধরে সেই গবেষণা চলছে!’ আমি তাকে এটাও বললাম যে, ‘তুমি কি জানো এক সময় দুনিয়ার প্রায় অর্ধেকই ব্রিটিশ রাজত্ব ছিল। ইউটিউবে একটা ভিডিও আছে, ব্রিটিশ কলোনির ৫০০ বছর নামে। ওইটা দেখলে বুঝতে পারবা।’ এরপর ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ এলো। আমি বললাম, ‘আজকের ফিলিস্তিন সমস্যার মূল কারণ হল ব্রিটিশ। জানো সেটা?’ সে বলল, ‘কি বলো?’ ‘হুম। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেলফোর ১৯২০ এর দিকে ইহুদিদের এক টুকরো জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যাতে তারা নিজেদের মতো সবাই মিলে এক জায়গায় থাকতে পারে। এরপর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের কিছু অংশ ইহুদিদের দিয়ে দেয় ব্রিটিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে জার্মান বাহিনী থেকে দলে দলে ইহুদি সৈন্য পালিয়ে এসে সেখানে বসবাস করতে শুরু করল। এত ইহুদি সেখানে ঢোকার প্রধান কারণই হলো এটা।’ সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, ‘আমি যতটুকু জানি, ওখানকার সমস্যা কিন্তু ফিলিস্তিনিরা নিজে। হামাসের কারণে এসব হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘কি বলো এসব? ফিলিস্তিনিদের অপরাধ কি? তারা তো ৭৫ বছর ধরে নিজ দেশে রিফিউজি। সারা বছর তাদের ওপর একটু একটু করে হামলা হয়। সেটার প্রতিরোধ করা অন্যায়? একটু একটু করে তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আর সেখানে ইহুদিদের বসতি বাড়ছে।’ সে বলল, ‘এটা ঠিক বলোনি। ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই তাদের বাড়িঘর বেঁচে দিচ্ছে।’ ‘ঠিক বলেছো। কিন্তু এটা জানা দরকার, বিক্রি করছে নাকি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে? তা ছাড়া আমি কোনো দেশে গিয়ে যদি জায়গা কিনে বাড়ি করি, তাহলে কি সেই জায়গাটুকু বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাবে? বলতে পারব যে, এই অংশটুকু এখন বাংলাদেশের অংশ?’ ও বলল, ‘না।’ ‘তাহলে? বাই দ্য ওয়ে, তুমি এই তথ্য কোথা থেকে পেলে?’ বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যে ফিলিস্তিনের মেয়েটা পড়ে, হাসিন জাহান নামের, ও বলেছে।’ হুট করে আমার মনে হলো, ফিলিস্তিনের মূল সংকট ইসরায়েল বা হামাস না। তাদের মূল সমস্যা নিজ দেশের বেঈমান জনতা। তারা নিজেদের সুবিধামতো দেশটাকে নিয়ে গত ৭৫ বছর ধরে ব্যবসা করে গেছে। কোনো দেশের মানুষ যখন তার নিজ দেশের সঙ্গে গাদ্দারি করা শুরু করে, তখন আর সেই দেশকে বাঁচানো যায় না। সেটা হোক নোবেল জয়ী ইয়াসির আরাফাত কিংবা ভবিষ্যতের আরেক নোবেল জয়ী মাহমুদ আব্বাস।

রাজু নুরুল: উন্নয়ন সংগঠক, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ‘উন্নয়ন নীতিপরামর্শ’ বিষয়ে অধ্যয়নরত

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফার্মগেটে ব্যাংকে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট

জাতীয়র আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন

মেসির সঙ্গে চুক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনায় মায়ামি

‘একটা মূর্তি বানাতে হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়েছে’

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে পর্ন তারকাকে ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত

কদমতলীতে ঘরে ঝুলছিল যুবকের মরদেহ

কায়কোবাদ-তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারের দাবি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের

পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পর্শে প্রাণ গেল ৩ শিক্ষার্থীর

যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, বাংলাদেশেও চাপে পড়তে পারেন আদানি

হোয়াটসঅ্যাপে কল রেকর্ড করার উপায়

১০

৩ মাসে জ্বালানি খাতে ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় : জ্বালানি উপদেষ্টা

১১

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ / এক বছরের মধ্যে নির্বাচন চান ৬১.১% মানুষ

১২

সুমনের হ্যাটট্রিকে রাজশাহীর লজ্জার রেকর্ড

১৩

রোববার যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না

১৪

ট্রাম্পের সঙ্গে বসতে চান পুতিন

১৫

 ছিনতাইকারীর কবলে সেনা সদস্য

১৬

চীনা দূতাবাস কর্তৃক আউটস্ট্যান্ডিং প্রমোশনাল পার্টনার অ্যাওয়ার্ড প্রদান

১৭

মাদকের টাকা না দেওয়ায় মাকে কুপিয়ে হত্যা

১৮

এবার রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদের ৭ দাবি

১৯

সাবেক সতীর্থই মেসির কোচ হচ্ছেন

২০
X