ড. কামরুল হাসান মামুন
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৪১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. কামরুল হাসান মামুন

শুধু কারিকুলাম দিয়ে  শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা নিয়ে যতই আলোচনা হচ্ছে ততই দেখছি কেউ কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বুঝে না বুঝে জাপান বা ইউরোপের বাচ্চারা যে স্কুলে ঘর বানায়, রান্নাবান্না করে ইত্যাদি নিয়ে লেখা বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। অবশ্যই এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এগুলো না, আরও আছে যেমন- পরিবেশকে চেনাজানার জন্য ছেলেমেয়েদের বনজঙ্গলে নিয়ে যাওয়া, রাস্তা পারাপার ইত্যাদিও শেখাতে হয়। অনেকদিন আগে আমি একটা ভিডিও শেয়ার করেছিলাম সেখানে জাপানি বাচ্চাদের বাস বা ট্রেনে সন্তানসম্ভাবা মা, বৃদ্ধ মানুষ কিংবা প্রতিবন্ধীদের দেখলে সিট ছেড়ে দিতে হয় ইত্যাদি শেখানো হচ্ছে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা শেখানো হয়। আমাদের স্কুলগুলোতেও এসব শেখানো হবে সেটাই তো চাই। চাই বলেই মাঝে মাঝেই এসব নিয়ে লিখি। কিন্তু এখানে একটা বিষয় আছে। কোন ক্লাস বা কত বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের এসব শেখাবেন। এর উত্তর আমাদের এক বাংলাদেশি মা (Samsunnahar Nora) যিনি জাপানে থাকেন এবং সেখানে ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত, তার লেখাতেই বিস্তারিত জানুন।

‘আমার ছেলে জাপানে স্কুলে পড়ে। এখানে শৃঙ্খলা, নীতিনৈতিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিকতা ইত্যাদি শেখানো হয় প্রাইমারি অর্থাৎ elementary level class six পর্যন্ত৷ আর এখানে পড়ার লেভেল অঙ্ক, বিজ্ঞান ইত্যাদি অনেক উন্নত এবং চ্যালেঞ্জিং। আমার ক্লাস ফোরের বাচ্চার বিজ্ঞান আমাদের দেশের আগের নাইন, টেন লেভেলের। আর অঙ্ক তো এতভাবে শেখায় সে বলে শেষ করা যাবে না। আর যেসব ছবি সবাই দিচ্ছে সেগুলো তাদের পড়ার বাইরের অংশ, কেউ পড়ার অংশটা জানাচ্ছে না, আর ক্লাসে যে পরীক্ষা নেয়, সেগুলোতে মার্কস দেয়, আর আমাদের দেখার জন্য বাসায় পাঠায়। আর ক্লাস সেভেন থেকে শুধু পড়াশোনা, পরীক্ষা।’

আমার স্ত্রী ইতালিয়ান। আমি নিজেও ইউরোপের ৩টি দেশে লম্বা সময় ধরে থেকেছি এবং এখনো প্রতিবছরই যাই। জাপানের মতো ইউরোপেও ১২ বছর অর্থাৎ পঞ্চম এবং কিছুটা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত রান্নাবান্না, মাটি নিয়ে খেলা, ঘর গোছানো, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি অত্যন্ত সিরিয়াসলি দেওয়া হয়। এসব শিক্ষার জন্য দরকার উন্নতমানের সৎ এবং শিশুদের বোঝে এমন মানুষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। এই বাচ্চাদের সকাল থেকে দুপুরে খাওয়া, বিকালে একটু ঘুমানো ইত্যাদিসহ প্রায় বিকেল ৪ থেকে ৫টা পর্যন্ত থাকে। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষকদের তাদের দেখাশোনা করতে হয় তাই এই শিক্ষকদের উচ্চবেতন দেওয়া হয়। স্কুলে শিশু মনোবিজ্ঞানীও রাখা হয়। এই বয়সটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শৃঙ্খলা, নীতিনৈতিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিকতা ইত্যাদি এই বয়সের বাচ্চাদের মননে মগজে চিন্তায় চেতনায় একদম গেঁথে দিতে হয়, যা সারাজীবন থাকে।

তবে ক্লাস সেভেন থেকে সম্পূর্ণ সিরিয়াস বিষয় যেমন বিজ্ঞান গণিত সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি শেখানো হয়। এমনকি অষ্টম শ্রেণিতে উঠলে বিজ্ঞানকে ভাগ করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান আলাদা বিষয় হিসাবে। আর নবম শ্রেণি থেকে তো আরো সিরিয়াস। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে গিয়েই কার কি ভালো লাগে সেই সম্পর্কে ছাত্র ও ছাত্রী নিজে এবং তার মা-বাবা ও শিক্ষক অনেকটা বুঝে যায়। এই তিন গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে নবম-দশম শ্রেণিতে কি কি বিষয় নেবে তা ঠিক করবে। এই সময় সেখানে অল্প কয়েকটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক বিষয় যেমন- ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি রেখে বাকি সব অপশনাল রাখতে হয়। ধর্ম শিক্ষা কেবল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকতে পারে। নবম শ্রেণিতে ধর্ম যদি রাখতেই হয় সেটা হতে পারে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব যেন প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে কিছুটা অন্য ধর্ম সম্বন্ধেও জানে। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় কোথাও নবম শ্রেণিতে ধর্ম বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে রাখে না আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যমেও নেই।

লেখাটি শেষ করব একজনের মন্তব্য দিয়ে। যার মন্তব্যটি উল্লেখ করছি তার নাম হাসান সাদ ইফতি। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এখন আরেক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এ পোস্ট-ডক করছেন। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে তার মন্তব্যটি বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি।

‘নতুন শিক্ষাক্রমটি একটি পুরো প্রজন্ম এবং সম্ভবত পুরো জাতিকে ধ্বংস করার একটি রেসিপি। যখন পশ্চিমের প্রতিটি দেশ (এবং প্রাচ্যেরও) স্টেম শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা করছে, তখন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা ঠিক তার বিপরীত দিকে হাঁটছেন। এই যেন একটি বিয়োগান্ত নাটক। এই ধ্বংসলীলা থেকে উত্তরণের এক মাত্র উপায় হলো ও/এ লেভেলের পাঠ্যক্রমে চলে যাওয়া অর্থাৎ ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাওয়া যা নিম্নআয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান অধ্যয়ন করা অসম্ভব করে তুলবে। সে জন্য যেকোনো মূল্যে আমাদের নতুন কারিকুলাম বন্ধ করতে হবে।’

আমরা করেছি বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজি ভার্সন নাম দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। অথচ আমাদের উচিত ছিল ইংরেজি মাধ্যমকে বাংলা করে পড়ানো তাতে অনেকেই আর ইংরেজি মাধ্যমে যেত না। ইংরেজি মাধ্যমে গেলে লেখাপড়াটা সম্পূর্ণ হয় না। প্রতিটা শব্দের যেই একটা মেন্টাল ইমেজ হয় সেটা কেবল মাতৃভাষাতেই সম্ভব। তাই ইংরেজি মাধ্যমের যথাসাধ্য বাংলা মাধ্যম অথবা ইংরেজি কারিকুলামকে বেজ ধরে বাংলা মাধ্যমকে তৈরি করা। এতে দুই মাধ্যমের বৈষম্য কমে যাবে এবং একই সঙ্গে বিশ্বমানের শিক্ষা হবে। কিন্তু কারিকুলাম দিয়ে আর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায় না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, এমআইটি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম এর মতোই। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন বিশ্বের তলানিতে? কারণ শিক্ষকদের মান, লেখাপড়া ও গবেষণার পরিবেশের মান, শিক্ষায় বরাদ্দের মান ইত্যাদি। আজ যদি হার্ভার্ডের সকল শিক্ষক দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিস্থাপিত করা হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান হার্ভার্ডের মানের কাছাকাছি!

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১০

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১১

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১২

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৩

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৪

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৫

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৬

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৭

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৮

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৯

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

২০
X