ছেলেবেলায় রেল ছিল আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। স্টেশনের বারোয়ারি কায়কারবার ছিল চলমান চলচ্চিত্রের মত যুগপৎ চিত্তাকর্ষক ও হতাশাব্যাঞ্জক। স্টেশন মানেই প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় একগাদা লোকের সমাগম। পাগল, ভবঘুরে, বখাটে ও সারমেয়দের দৌরাত্ম্য আর কুলিদের আগ্রাসী পদচারণা। স্টেশনের কর্ম চাঞ্চল্য চব্বিশ ঘণ্টার, কোনো বিরতি নেই।
তখন এখনকার মতো পণ্য পরিবহনের এত ব্যবস্থা ছিল না। রেলই ছিল ভরসা। প্রতিটি ট্রেনের সাথে আলাদা করে মালবাহী বগি যুক্ত করে দেওয়া হতো। বুকিং অফিসগুলো ছিল রমরমা। স্টেশনে সাধারণ বিশ্রামাগার হিসেবে যা ছিল তার বেশির ভাগই থাকত তালা মারা। বিশেষ কেউ এলে বা গেলে, এলাকার কেউকেটা হলে সেগুলো খোলা হতো। সেখানে আসবাব হিসেবে বসার ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু থাকত না। ধুলো, ময়লা আর আবর্জনার কারণে সেখানে বসে থাকা যেত না বেশিক্ষণ। এর সাথে একটা প্রক্ষালনাগার সংযুক্ত থাকত। ভুলেও কেউ তাতে উঁকি দিত না। দিলে কয়েক দিনের মতো খাওয়া হারাম হয়ে যেত। মধ্যম শ্রেণির স্টেশনে দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগার নামে বসার ব্যবস্থা থাকত। সেটা মানে অতি সাধারণ। বহুল ব্যবহার ও অপরিষ্কার থাকার কারণে বাধ্য হয়ে বসা ছাড়া উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম বা স্থায়ী চা স্টলই ভালো। জেলা শহরের স্টেশনে প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগার ছিল। সেটা মোটামুটি মানের।
স্টেশন মাস্টারের রুম প্রায়ই ফাঁকা পরে থাকত। সহকারী স্টেশন মাস্টারের রুমে রেলের নানা প্রকার লোকের ভিড় থাকত। সেখানে কে কর্মকর্তা, কে কর্মচারী আর কে পাবলিক বুঝার উপায় থাকত না। রেলের কর্মচারী মানে ইউনিয়নের লোক। তারা অতিশয় ক্ষমতাবান। ট্রেনের যখন খবর হতো তখন ঝুলন্ত লোহার দণ্ডে হাতুড়ি পিটিয়ে ট্রেনের আগমনী বা প্রস্থানের শব্দ-সংকেত দেওয়া হতো। বড় স্টেশনগুলোতে রেলের আগমনী বা নির্গমনের খবর মাইকে ঘোষণা করা হত। যার বেশিরভাগই বুঝা যেত না।
ট্রেন যখন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকত তখন রেলের একজন নিম্ন পদস্থ কর্মচারী লোহার তারের একটা বিশাল রিং প্ল্যাটফর্মে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ইঞ্জিন থেকে ড্রাইভার তা গ্রহণ করত আর অনুরূপ আরেকটা রিং স্টেশনে ফেরত দিত। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুলোই দেখতাম আর কৌতূহল মিটাতাম। স্টেশনেই বগি জোড়া লাগানো আর বিচ্ছিন্ন করার কাজ হতো। সেগুলোও বিস্ফারিত চোখে দেখতাম। তখন ট্রেনের লেট যেন ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। যারা স্টেশনের আশপাশে বাড়িঘর করে থাকত তাদের বড়ই সৌভাগ্যবান মনে হতো। আহা! আমাদের বাসাও যদি এমন সংলগ্ন হতো। তাহলে স্টেশনে এত অপেক্ষা করতে হতো না। প্রায় সময়েই অপেক্ষা দীর্ঘতর হতো। তখন চা স্টল আর বুক স্টল ছিল কালক্ষেপনের প্রকৃষ্ট জায়গা। চা স্টলে বাজত পুরোনো দিনের জনপ্রিয় গান আর চলতি সময়ের সিনেমার হিট গান। বড় বড় স্টেশনে একাধিক প্ল্যাটফর্ম থাকে। মূল প্ল্যাটফর্ম বাদে অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোতে মূলত- মালামাল গচ্ছিত থাকত। সেখানে থাকত পাগল আর দেহপসারিণির দল। তাদের ঘিরে থাকত একদল কৌতুকপ্রিয় লোক আর নাগর-খদ্দের।
রেলের দৈত্যকার ইঞ্জিনের ফোঁস ফোঁস শব্দ যুগপৎ ভীতি ও বিস্ময় জাগাত। ইঞ্জিন চালককে মনে হতো সবচেয়ে ক্ষমতাবান। কিন্তু তার বেশভূষা আর ক্রমাগত বিড়ি ফুঁকা দেখে তাকে হতদরিদ্র মনে হতো। ভাবতাম এত বড় দৈত্যাকার রেল যিনি চালান তিনি এত গরিব কেন? শিশু মন বাস্তবের ধারাপাত জানত না বলে তার জন্য বড় মায়া হতো। বিবর্ণ, ক্ষত-বিক্ষত রেলের বগিগুলোকে মনে হতো স্বপ্নযাত্রার বাহন। বসার বেশির ভাগ সিট ছিল কাঠের। কিছু ছিল কুশনের। তার বেশির বাগই থাকত ছিঁড়া, ফাটা, কাটা। তা থেকে ছোবড়া দৃশ্যমান হতো। সেই সাথে ছাড়পোকার উপস্থিতিও হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যেত। গাদাগাদি মানুষ বাক্সপেটরা সমেত আণ্ডা-কাচ্চা-বাচ্চাসহ সহযাত্রী হয়ে চলেছে যে যার গন্তব্যে। কেউ বিড়ি ফুঁকছে, কেউ গপসপ মারছে, কেউ উচ্চস্বরে গান গাইছে, কেউ কেউ ঘেউ ঘেউ ঢংয়ে কাইজ্যা-ফ্যাসাদও করছে। তখন সিটে কোনো নম্বর ছিল না। সরেজমিনে দখলই ছিল স্বীকৃত। সিটে যারা বসতে সফল হতো তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করত। তাদের ঠাঁট-বাটই ছিল আলাদা। এদের মধ্য থেকে মাঝ পথে কেউ নেমে যেতে উদ্যত হলে সেই শূন্যস্থান পূরণে রীতিমতো যুদ্ধ লেগে যেত। তখন মহিলা, বৃদ্ধ আর অসুস্থদের প্রাধান্য দেওয়া হতো। তখন সম্মান বলে একটা বিষয় অগ্রজদের প্রাপ্য হক বলে মনে করা হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শূন্যস্থান পূরণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধরতরা আপোষে সেই সিট তাদের অনুকূলেই সমর্পণ করত।
বগীতে লাইট, ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল। কোনোটা জ্বলত, চলত। কোনোটাকে থাপ্পড় মেরে বা খোঁচা দিয়ে সচল করতে হতো। বেশির ভাগ লাইট, ফ্যানই মুখ কালো করে অচল থাকত। তখন, বিশেষত, মহিলারা বাচ্চাদের সাচ্ছন্দ্যের জন্য সাথে করে হাতপাখা বহন করত। কেউ একটা কিছু জোগাড় করে হাত পাখা বানিয়েও ব্যবহার করত। প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে বিনোদনের কমতি ছিল না। হকাররা বিরক্তি উৎপাদন করলেও কমবেশি সবাই তাদের সেবা ক্রয় করত। বিনোদনের আরেক উপকরণের নাম ক্যানভাসার। তাদের পোশাক, মালামালের সজ্জা ও গুণাগুণ বর্ণনা, কণ্ঠ প্রক্ষেপণের অদ্ভূত ক্যারিশমা এবং বেশি কিনলে বেশি বেশি ছাড়ের বিশাল অফার ছিল দেখার মতো। কিনব না কিনব না করেও কেন জানি হাত উঁচিয়ে কণ্ঠে আওয়াজ চলে আসত। আর পকেট হাল্কা হতো। একজনের দেখাদেখি অন্যদের কেনার হিড়িক লেগে যেত।
হকারদের মধ্যে পুস্তক বিক্রেতাদেরও দেখা মিলত। দু’হাতে বিশাল বইয়ের বহর নিয়ে তারা কামড়াময় ঘুরে বেড়াত। বই পড়ুয়াদের অধিকাংশই এদের কাছ থেকে বাংলাসাহিত্যের নামকরা গল্প, উপন্যাস কম মূল্যে সুলভ সংস্করণ হিসেবে ক্রয় করত। মূলত- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ, শংকর, নিমাই, আশুতোষ, সমরেশ , সুনীল, মীর মোশাররফ হোসেনের বই তাদের স্টকে শোভা পেত। সে আমলের শিক্ষিত এমন কাউকেই পাওয়া যাবে না যে কখনোই একবারের জন্য হলেও এদের দ্বারস্থ হয়নি। তাদের কাছে থাকত বিচিত্র সব গ্রন্থের সমাহার। কী করলে কী হয়, ধনী হওয়ার সহজ উপায়, খাবনামা, ডা. লুৎফর রহমানের মানব জীবন, উন্নত জীবন থেকে শুরু করে ডেল কার্নেগী, মুকছেদুল মু’মেনিন, আমলে নাজাত, বেহেশতি জেওর প্রমুুখ বইও। সদ্য পানি পাওয়া কিশোর ও টগবগে তরুণদের জন্য কামসূত্র টাইপের চটি কাহিনির বই ও ম্যাগাজিনও থাকত। মলম আর সর্বরোগ বিনাশী ওষুধের ক্যানভাসাররা ছিল এদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। কী তাদের গলা, কী তাদের প্রক্ষেপণ স্টাইল, কী তাদের আকর্ষণ ক্ষমতা কেউ আজ তা অতটা কল্পনাও করতে পারবে না।
এত ঠাসাঠাসির মধ্যেই আসত পান-বিড়ি-সিগারেট, বাদাম-চানাচুর-ঝালমুড়ি, সেদ্ধ ডিম, শশা, কলা আর ফল বিক্রেতারা। ধূমপানের গন্ধ ও ধোঁয়ায় আর বদহজমিদের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস নির্গমনে কখনো কখনো কামড়ার বাতাসে শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ত, যাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠত। নানা কিছিমের ভিক্ষুকের দলও ছিলো। উপচেপড়া ভিড়ের মধ্যে আরেক দল সক্রিয় থাকত যাত্রী সাধারণের পকেট ফাঁকা করতে। তখন ট্রেনের টাইম টেবিল বিশাল পুস্তকাকারে বের হত। স্বচ্ছল, বনেদী ও শিক্ষিত প্রায় পরিবারেই তা শোভা পেত। সেই পুস্তিকাও ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। ট্রেনের সময় সূচির বাইরেও তাতে থাকত রকমারি বিজ্ঞাপন। মনীষীদের উক্তি, প্রবাদ- প্রবচন। বিভিন্ন রংয়ের পাতায় মুদ্রিত সেই টাইম টেবিল পড়ার জন্যও ছিল সুখকর। এখন নেই।
তখন মূলত ছিল লোকাল ট্রেন। এতে সেকেন্ড ক্লাস ও থার্ড ক্লাসের টিকেট দেওয়া হতো। যারা টিকেট কিনত তারা বুক ফুলিয়ে চড়ত। আর যারা বিনা টিকেটে চড়ত তারা টি-টিইর কদর পেত। উভয়ের ভ্যালু এড হতো। অর্থনীতিতে ভ্যালু এড হওয়া খুবই পজিটিভ দিক। সেই ট্রেনের টিকেটও ছিল অদ্ভূত। শক্ত কাগজের ছোট আয়তকার সেই টিকেট লোহার মেশিনে পাঞ্চ করে বিক্রি করা হতো। যারা বিনা টিকেটে ভ্রমণের কারণে কর্তৃপক্ষের রোষাণলে পড়ত তাদের দেওয়া হতো উচ্চমূল্যের কাগজের টিকেট। তার আবার কার্বন কপি করা হতো। টিটিইদের মধ্যেও রকমফের আছে। সাধারণত তারা সাদা এপ্রোন গায়ে চাপিয়ে পান চিবিয়ে চিবিয়ে টিকেট তালাশের নামে বিনা টিকেটে ভ্রমণকারীদের খুঁজে বেড়াত। কখনো কখনো এরা নিজেরাও সতর্ক থাকত, বিনা টিকেটে ভ্রমণ কারীদেরও সতর্ক করে দিত। নীল এপ্রোন গায়ে আরেক দল এদের সুপারভাইজ করতে আসত। কখনো বসতো সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংক্ষিপ্ত মোবাইল কোর্ট। টিটিইদের পান, বিড়ি, সিগারেটের জোগানের বেশিরভাগই আসত হকারদের কাছ থেকে ‘নজরানা’ হিসেবে। ছিল রেল নিরাপত্তা বাহিনীর লোক। তারা বন্দুক আর লাঠি হাতে ঘুড়ে বেড়াত। এক্সপ্রেস ট্রেন গুলোতে প্রথম শ্রেণির বগি থাকত। সেগুলো ব্যয়বহুল হলেও আয়েসী ছিল। বিশেষ কিছু ট্রেনে থাকত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগী।
সাদা পোষাক আর কালো ক্যাপ পরিহিত লাল, সবুজ ফ্ল্যাগ হাতে গার্ড মশাইকে মনে হতো যথার্থই ক্যাপ্টেন। স্টেশন মাস্টারকে মনে হতো বিগ বস। আর সিগন্যাল ঘরের কর্মচারীদের মনে হতো লাল-সবুজ হলুদ বাতির ট্রাফিক পুলিশ।
এলাকা ও গুরুত্ব ভেদে স্টেশনের আকার ও সুযোগ-সুবিধার হেরফের হয়ে থাকে। জংশন স্টেশনগুলো আকারে, ব্যস্ততায় ও রকমারি কাজে সদা কলরব মুখর থাকে। এখানে যাত্রীরা ট্রেন পরিবর্তন করে তাদের গন্তব্যমুখী ট্রেন ধরে। কখনো কখনো এখানে ট্রেনের ইঞ্জিন তার মাথা পরিবর্তন করে। সবচেয়ে ভালো লাগত ক্রসিংয়ের জন্য কোনো ছোট্ট গ্রামীণ স্টেশনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার কাল। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্রড গেজ আর বাকি অঞ্চলে মিটার গেজ বা ন্যারো গেজ লাইন আছে।
তখন মালবাহী বা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কয়লা চালিত ইঞ্জিন ছিল। সেগুলো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে ঊর্ধ্বকাশে ধুয়া উদগিরণ করতে করতে ছুটত। কয়লা চালিত আর ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের শব্দে তারতম্য থাকলেও দু’টোই হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যেত। এখন আর কয়লা চালিত সে ইঞ্জিন নেই। ঢাকা ও চিটাগাংয়ে রেল ভবনের সামনে তা এন্টিক হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দৃশ্যমান আছে। ছেলেবেলায় এই রেলকে ঘিরে বেশ কিছু স্মৃতি ও অযৌক্তিক ভাবনা জড়িয়ে ছিল। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ট্রেনের শব্দ আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা ছড়া কাটতাম- ঝিকিরঝিকির ময়মনসিংহ, আইতে যাইতে কতদিন? এরকম আরও। রাতে জানালার পাশে বসে অপলক নয়নে বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতাম পূর্ণ চাঁদ আমাদের সাথে সাথে চলছে। চাঁদের বুড়িকেও যেন স্পষ্ট দেখতাম চড়কিতে সুতো কাটছে। পাশাপাশি দুই ট্রেনের ছুটে চলার প্রচণ্ড শব্দ উপভোগ করতাম। ব্রিজের ওপর দিয়ে চলার সময় ট্রেনের ভিন্ন শব্দও ভালো লাগত। ছুটে চলা ট্রেনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো প্রচুর নির্মল হাওয়া খাওয়া। ট্রেনের বুফে কারের খাবার মনে হতো সবচেয়ে সেরা, সুস্বাদু। প্রায় প্রতিটি স্টেশন চৌহদ্দিতে বয়সী বট-বৃক্ষ শোভা পেত। সেখানে বাঁদুর, কাক, বকসহ রকমারি পাখীরা বাস করত। এখনো তা আছে কালের সাক্ষী হয়ে। মোট কথা দূরপাল্লার যাতায়াতে রেল ছিল সবচেয়ে নিরাপদ, আনন্দদায়ক চলাচল মাধ্যম।
কালে কালে রেলের চমকে-ঠমকে অনেক কিছু যোগ হয়েছে। আজকের ট্রেনের রঙ চিত্তাকর্ষক হয়েছে। লোকোমটিভ, বগী, ইক্যুইপমেনন্ট ও ট্রেনের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। লোকবল নিয়োগ হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুযোগ-সুবিধা। রেলের বাজেটও বেড়েছে অনেক গুণ। এতকিছুর পরেও যাত্রী সেবায় ঘাটতি আপামর জনগণকে আশাহত করে। ডিজিটাল যুগে টিকেট ব্যবস্থাপনাটাও আমরা নিষ্কণ্টক করতে পারিনি। প্ল্যাটফর্মের অবস্থা সুন্দর হয়েছে। স্টেশন আকারে- প্রকারে ব্যাপক হয়েছে। হয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত। অবকাঠামোগত উন্নতিও হয়েছে। সম্প্রসারণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। ঢাকা-কক্সবাজার রেল ভ্রমণ এখন অতি বাস্তব। দেশের অন্য জেলা-উপজেলার সাথে রেল যোগাযোগের সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে স্বপ্নের ট্রেন এখন দক্ষিণের যাত্রাকে করেছে আয়াস সাধ্য। মেট্রোরেল দিয়েছে ভিন্ন ফ্লেভার। এত কিছুর পরেও রেলকে ঘিরে জন সন্তোষে ঘাটতি থেকেই গেছে। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, সেকেলে মানসিকতার কারণে রেল তার পূর্ণ যৌবন মেলে ধরতে পারছে না। দক্ষ জনবলের অভাব, যথাযথ পদায়ন না হওয়া, নিম্নপদস্থদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি যথাযথ মনোযোগ না দেওয়াও এর পেছনে কাজ করছে। প্রায়ই রেলের কালো বিড়াল জনসম্মুখে থলে থেকে বেড়িয়ে পড়ে। মনে হয় রেল-বিড়াল উৎপাদনের উর্বর জায়গা।
সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর প্রিয় মাধ্যম এই রেলের পরিসরকে আরো বিস্তৃত করতে হবে। এর অবকাঠামো আরও মজবুত ও টেকসই করতে হবে। দেশে পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। রেল হতে পারে এর অন্যতম বৃহৎ অংশীজন। জনশ্রুতিতে আছে বাসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রেলকে ভেবে নিয়ে রেলের ভেতরের ও বাইরের সিন্ডিকেট সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনার ফাঁদ পেতে বসে আছে। এই জনশ্রুতি বাজারি গুজবের মতো অসার হোক। রেলকে নিয়ে রুনা লায়লার একটা বিখ্যাত গান আছে : ‘ইস্টিশনের রেলগাড়িটা, মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা, প্ল্যাটফর্মে বইসা ভাবি কখন বাজে বারোটা, কখন বাজে বারোটা’। রেল চলুক ঘড়ির কাঁটা মেপে। যাত্রীসেবা প্রদানের উন্নত মানসিকতা নিয়ে। বারোটা বাজার অশনি সংকেত না বাজিয়ে। রেল হোক জনগনের আনন্দ, প্রয়োজন আর আস্থার প্রতীক। হোক যাত্রী সাধারণের প্রিয় নিত্যসঙ্গী।
আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন