মেধাবী সে তরুণটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। তার একাধিক প্রকাশনাও ছিল। একটি লেখায় তিনি লিখেছেন যে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আবেদন করে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত গিয়ে তিনি দেখলেন যে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় এক থেকে পাঁচের মধ্যে ছিলেন, এমন বেশ কয়েকজনও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নিয়োগের গল্পটি ভিন্ন। সেখানে মেধা বা ন্যায্য নির্বাচন অগ্রাধিকার পায়নি।
সেই মেধাবী তরুণটি তার লেখার উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, এই ধারা যদি এভাবে চলতে থাকে, আগামী ৫০ বছরেও এ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও শুধু মেধামানের ভিত্তিতে একটি ন্যায্য নির্বাচনী পর্ষদের মাধ্যমে কোনো নিয়োগই হবে না।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক বড় ধরনের রাজনীতিকরণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে রাজনীতি ও স্বার্থসিদ্ধি মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে না। এই রাজনীতিকরণের একটি প্রত্যক্ষ দিক হচ্ছে যে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে মেধা নয়, বরং বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে দলীয় স্বার্থ, রাজনীতি, ক্ষমতাসীনদের চাহিদা পূরণ, স্বার্থের আদান-প্রদান। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধামানের শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না, পাচ্ছি মধ্যমমানের শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে মেধা-নেতৃত্ব দেয়া। মেধা-নেতৃত্বের জন্যে মেধাবী ছাত্র যেমন আবশ্যক, তেমনি দরকার মেধামানের শিক্ষকের। মধ্যমমানের শিক্ষক দিয়ে উচ্চশিক্ষায় মেধা-নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকরণ এবং শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি বিস্তার লাভ করার কারণে রাজনীতি নিয়ে শিক্ষকরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের পক্ষে মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মেধা নেতৃত্বের জন্যে মেধাবী শিক্ষার্থী ও মেধামানের শিক্ষক আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। তার জন্য অন্য একাধিক শর্ত পূরিত হতে হবে। যেমন, মেধা-নেতৃত্বের জন্যে একটি পরিবেশের প্রয়োজন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা এবং একটি বৈশ্বিকবীক্ষণ ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধা-নেতৃত্ব দিতে পারবে না। একটি কূপন্ডুক পরিবেশে মেধা-নেতৃত্ব জন্মায় না।
দ্বিতীয়ত : উচ্চশিক্ষার একটি বাণিজ্যিকীকরণ হলে সেখানে মেধা-নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটবে না। জানা নয়, দক্ষতা অর্জন নয়, নিজেকে শাণিত করা নয়, বরং একটি সনদপ্রাপ্তিই যদি উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে সে বাণিজ্যিককৃত পরিবেশে মেধা-নেতৃত্বের বিষয়টি অচল।
তৃতীয়ত : মেধা-নেতৃত্বের ভূমি তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি ভূমিকা আছে। উচ্চশিক্ষা বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে তার প্রত্যাশা কি, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি রাজনীতির আখড়া হবে না জ্ঞানের পীঠস্থান হবে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার বড় প্রয়োজন। সে অঙ্গীকারের সূত্র ধরেই আসবে উচ্চশিক্ষায় অর্থায়নের ব্যাপারটি।
একটি পাদটীকা দিয়ে শেষ করি। যে মেধাবী তরুণটিকে নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, তিনিসহ আরও তিনজন মেধাবী প্রার্থী, যাদের মৌখিক পরীক্ষাতেই নাকচ করা হয়েছিল, নিয়োগ তে দূরের কথা, তারা আজ বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন বিভিন্ন বিষয়ে। দেশে শিক্ষকতা করার অভিপ্রায়ের বিরূপ অভিজ্ঞতার কারণে তারা যদি বিদেশে শিক্ষকতায় ঠাঁই নেন, সেটা হবে আমাদের ক্ষতি। মেধামানের সঠিক মূল্যায়ন না হলে মেধা-পাচার হয় বৈকি।
ড. সেলিম জাহান : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন