সরিষা উচ্চমাত্রার ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, আমিষ এবং ওমেগা-৩ ধাঁচের ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ একটি ভোজ্যতেল ফসল। সরিষার তেলে কিছু অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকায় মানবদেহে ক্যান্সার, ব্যাকটেরিয়া, চত্রাক ও ভাইরাস প্রতিরোধী এবং ক্ষত নিরাময়ে কাজ করে। এই তেলে থাকা উচ্চ মাত্রার ওমেগা-৩ ধাঁচের ফ্যাটি অ্যাসিড, যেমন আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড বাতরোগজনিত ব্যথা ও প্রদাহ প্রশমনে সহায়ক। অধিকন্তু রুচিগুণ এবং নিম্ন ক্যালরিসম্পন্ন এই তেল সহজেই উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন খাদ্যের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তা ছাড়া উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন খাদ্যের ক্যালরি সরিষার তেলের নিম্ন ক্যালরি দ্বারা প্রতিস্থাপিতও হতে পারে। সরিষার তেলের আইসোথায়োসায়োনেটস নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মানবদেহে ডায়াবেটিস এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে ভূমিকা রাখে।
সরিষার তেল বাঙালি পরিবারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে যুগে যুগে সমাদৃত ছিল। সরিষার তেল শুধু পুষ্টিকর ভোজ্যতেল হিসেবে শাক-সবজি, মাছ-মাংস রান্নার কাজে নয়; বিভিন্ন রকম পিঠা-পুলি তৈরিতেও ব্যবহৃত হতো। শরীরে মালিশ ও মাথার কেশ তৈল হিসেবেও সরিষার তেলের যথেষ্ট কদর ছিল। চিকিৎসার উপকরণ, বিশেষত সর্দি-কাশি আক্রান্ত রোগীকে সরিষার তেলে পেঁয়াজ ও রসুন গরম করে খাওয়ানো এবং শরীরে মালিশ করার মাধ্যমে উপশম লক্ষণীয় ছিল। নবজাতক শিশুর রোগ প্রতিরোধ, সুস্থ ও শারীরিক বিকাশের জন্য দেহে সরিয়ার তেল নিয়মিত মালিশ সচরাচর দেখা যেত।
গত চার দশক বিদেশ থেকে আমদানীকৃত সয়াবিন তেলের গুণাগুণ অতিমাত্রায় প্রচার এবং সে সঙ্গে সরিষার তেল সম্পর্কে অতিরিক্ত নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করায় দেশে সরিষার তেলের চাহিদা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। ফলে দেশে কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলেও সরিষার উৎপাদন অন্যান্য ফসলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি। অন্যদিকে দীর্ঘ চার দশকেও সয়বিন চাষ আমাদের দেশে জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি। পরিণতিতে দেশে উৎপাদিত তেল জাতীয় ফসল থেকে তেলের চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ হয়। অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর। তাই আমাদের দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করে বিদেশ থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়।
বিভিন্ন সময় হঠাৎ করে সয়বিন তেল আমদানিতে ভাটা পড়ে এবং দেশে মূল্য অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। বিশেষত গত তিন বছর বিশ্বব্যাপী করোনার অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। এ ছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সমগ্র বিশ্বে খাদ্যসহ সকল পণ্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। আমাদের দেশে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় সয়াবিনসহ সকল ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সুদূরপ্রসারী অভীক্ষা ও তার প্রক্ষেপণের আলোকে দেশে সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে তেল আমদানি ৫০ ভাগ হ্রাস করা। এ জন্য দেশে সরিষার উন্নত জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, ধান উৎপাদন ব্যাহত না করে অধিক পরিমাণ জমি সরিষা চাষের আওতায় আনা এবং সরিষা চাষিদের প্রণোদনা প্রদান। এরই মধ্যে কৃষকদের উন্নত জাতের সরিষার বীজ ও সার সরবরাহ, সরিষার চাষ পদ্ধতি, রোগ ও পোকামাকড় দমন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। তেলবীজ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের অংশ হিসেবে মৌমাছি পালন বৃদ্ধি ও মৌচাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরিষার জমিতে মৌমাছির কলোনি স্থাপন করলে ফুলের পরাগায়ন সুনিশ্চিত হয় এবং সরিষার ফলন ২০ থেকে ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে মৌমাছির কলোনি থেকে লাভজনক মধু আহরণ সম্ভব হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ হাজার টন মধুর চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ হাজার টন। আমাদের দেশে প্রায় ২৫ হাজার মৌচাষি রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার চাষি মৌমাছির বাণিজ্যিক খামার গড়ে তুলেছে। মৌ কলোনি থেকে মধু ছাড়াও মোম, রাজচিত মোরব্বা রস (রয়্যাল জেলি), পরাগ রেণু (পোলেন), মৌকাই (প্রপোলিস) ও মৌমাছির গরল (ভেনম) মূল্যবান উপজাত পাওয়া যায়। সরকার গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে সরিষার চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাণিজ্যিক মৌখামারও বিকশিত হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কর্মচাঞ্চল্যের মাধ্যমে বর্তমান রবি মৌসুমে দেশে সরিষা উৎপাদনের ব্যাপকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল সরিষার জাত বারি সরিষা ১৪, বারি সরিষা ১৫ এবং বারি সরিষা ১৭ চাষে কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সরিষা একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল। সঠিক সময়ে বপন করে যথাযথ পরিচর্যা করলে এর তেমন কোনো রোগ ও অনিষ্টকর পোকামাকড়ের সংক্রমণ হয় না। তবে নাবীতে বপন করলে এবং ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে জাব পোকার সংক্রমণের শঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ফ্লি বিটল, ফল ছিদ্রকারী পোকা (পড বোরার) ও স-ফ্লাই পোকা সরিষা ফসলে আক্রমণ করে থাকে। জাব পোকার আক্রমণ হলে থায়ামিথোক্সাম জাতীয় কীটনাশক ২৫ ডব্লিউ জি প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ২ গ্রাম মিশিয়ে প্রয়োগ করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। ফল ছিদ্রকারী পোকার সংক্রমণ রোধকল্পে ক্লোরান্টানিলিপ্রোল ও থায়ামিথোক্সাম জাতীয় কীটনাশক ভলিয়াম ফ্লেক্সি ৩০০ এস-সি প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৫ মিলি কার্যকর। ফ্লি বিটল দমনের জন্য ল্যামড়া-সায়ালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক ক্যারাটে ২ দশমিক ৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতগুলোতে স-ফ্লাই পোকার আক্রমণের মাত্রা অর্থনৈতিক ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় না। সরিষা ফসলে চত্রাকজনিত কাণ্ড পচা রোগ সংক্রমণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জমিতে এজোক্সিস্ট্রবলিন ও ডাইফেনোকোনাজল জাতীয় চত্রাকনাশক এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
সুদীর্ঘকাল থেকে সরিষা আমাদের দেশে চায় হয়ে আসছে। এ দেশের মাটি ও আবহাওয়া সরিষা চাষের অনুকূল। রবি ফসল হিসেবে আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে সরিষা চাষ করা যায়। বাংলাদেশের প্রায় ৪৬টি জেলায় কমবেশি সরিষার আবাদ হয়। তবে ব্যাপক চাষের উপযোগী জেলাগুলো হলো মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম এবং সিলেট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে তেল আমদানি ৫০ ভাগ হ্রাস করা একটি সময়োচিত গৃহীত প্রকল্প। বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনা ও নিরলস তত্ত্বাবধানে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রকল্পটি যথাযথ বাস্তবায়ন করে দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি করবে বলে আমরা আশাবাদী। এ বছর বাংলাদেশে আট লাখ বার হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ছয় লাখ সত্তর হাজার টন। ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক দশ লাখ বিঘা জমিতে চাষের জন্য কৃষকদের মাঝে উন্নত জাতের বীজ ও সার প্রণোদনা হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে।
সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি সঙ্গে সরিষার দাম যেন পড়ে না যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষক ফসল ঘরে তোলার সময় সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরিষা ক্রয় করলে কৃষক উপযুক্ত মূল্য পেতে পারে। অন্যথায় কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষক ক্রমাগতভাবে দুই মৌসুম ন্যায্যমূল্য না পেলে প্রকল্পের সুফল কঠিন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। তাই প্রকল্পের সুফল টেকসই করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক সরিষা চাষের এলাকাগুলোতে সরকারি গুদাম নির্মাণ এবং মৌসুমকালীন সরকারিভাবে সরিষা ক্রয় করার প্রকল্প গ্রহণ সমীচীন।
ড. মো. রুহুল আমীন : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
মন্তব্য করুন