বাঙালি জাতির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়- সপ্তম শতকে গোড়া পত্তনের সময়কাল থেকে ঊনিশ শতকের ’৭১ সালের আগ পর্যন্ত হাজার বছরের অধিক সময়ে এ জাতি স্বাধীনতার মুখ দেখেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘকাল পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ জাতি হয়ত দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার এত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র ৫২ বছরের পথ পরিক্রমায় একটি জাতি এতটা সঙ্গীন হতে পারে তাও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশের প্রায় সব কাঠামো আজ ক্ষয়িষ্ণু। বুদ্ধিভিত্তিক এবং সহনশীল সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে আমরা বিজ্ঞান ও যুক্তি-তর্ক বিবর্জিত এক অসহিষ্ণু এবং রেষারেষির সমাজে পরিণত হয়েছি। এককথায়, জাতি হিসেবে টিকে থাকার সব নিয়ামক আজ প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত।
স্বাধীন জাতি হিসেবে এগিয়ে চলার ভিত্তি এবং কাঠামো তৈরি হয়নি। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথম দশকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা উত্থান-পতনে জাতি গঠনের সুযোগ হয়নি। ’৮০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বেশিরভাগ মানুষ সোচ্চার হলেও জাতি গঠনের সুযোগ তেমন ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লড়াই নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই তাদের ভেতর জাতি গঠনের তাগিদ অনুভূত হয়নি। সঠিক গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমেও জাতি গঠনের সুযোগ তৈরি হয়। ’৯০-এর দশকের শুরুতে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে অনেকটা আসার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধমেও জাতি গঠনের সুযোগ হাত ছাড়া হয়।
একটি দুর্বল কাণ্ড-বিশিষ্ট গাছ যেমন সামান্য বাতাসে হেলে পড়ে বা ভেঙে যায় জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থাও তাই। ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে একটি দমকা হাওয়ায় আমাদের পতন অনিবার্য। এখান থেকে মুক্তির কোনো পথ আমরা খোলা রাখেনি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ শক্তিহীন। ফলে তারাও অভিভাবকের ভূমিকা পালনের উপযুক্ত না। অন্যদিকে, দেশে আস্থাভাজন এবং দল নিরপেক্ষ কোনো সিভিল সোসাইটি, শিক্ষাবিদ কিংবা চিকিৎসক নেই, যারা এই ক্রান্তিকালে অভিভাবকের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারেন। বলতে দ্বিধা নেই, সবাই বিবেক বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জনগণের বর্তমান ও ভবিষৎ চিন্তা না করে শুধু নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। দুই-একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানকে অতীতে সাহসী ভূমিকায় এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও কী এক অজানা ভয়ে আজ তারা নীরব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ যদি আজ দল নিরপেক্ষ হতো, তাহলে হয়তো দেশের এই অবস্থা দেখতে হতো না। কিন্তু সে পথও আজ রুদ্ধ। অন্যদিকে, আমরা মেধাবীদের রাজনীতি এবং নেতৃত্বে আসার সব পথ বন্ধ করেছি। তাই আমাদের সঙ্গীন অবস্থা যে দীর্ঘস্থায়ী হবে তা সহজে অনুমেয়। ১৭ কোটির বিশাল জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডে বিদ্যমান ব্যবস্থার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এটা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বহিঃবিশ্বেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই তারা বিভিন্ন বেশে আমাদের উদ্ধারের নামে নব্যউপনবেশিক ব্যবস্থা কিংবা সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করবে যার লক্ষণ স্পষ্ট।
তবে কী আমাদের মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই? হ্যাঁ, আমাদের মুক্তির একটি পথ খোলা আছে আর তা হলো জাতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল হতে হবে এবং ভিন্ন মতপ্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। আমরা যেহেতু ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের দেশ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, সেহেতু এখন থেকেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের মতো ভাষা প্রয়োগ নীতি অনুসরণ করতে হবে। দেশের ইমেজ রক্ষার প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা যা করছি তাতে বহির্বিশ্বে আমাদের এত দিনে গড়ে ওঠা ইমেজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মুক্তি যুদ্ধের স্বপক্ষ এবং বিপক্ষ নিয়ে আমাদের মধ্যে যে বিভাজন গড়ে উঠেছে তার ইতি টানতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর কোনো দেশে এ ধরনের বিভাজন জিয়িয়ে রাখা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিভাজিত জাতি কখনো উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। এই বিভাজন বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সন্তানদের চরম মূল্য দিতে হবে। আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য ভূখণ্ড রেখে যাওয়ার নিমিত্তে বিভাজন বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মাতৃভাষা দিবস ও পহেলা বৈশাখে এবং ক্রিকেট কিংবা ফুটবলে জিতলে সব বিভাজন ভুলে পুরো জাতি যেমন একাকার হয়ে যায়, আসুন আমাদের সন্তান এবং নাতি-পুতিদের মঙ্গলের জন্য জাতিগত বিভাজন বন্ধে তেমনি প্রয়সী হই।
এক্ষেত্রে আইন পাস করে জাতিগত বিভাজনের প্রধান উৎস প্রথমে বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সব প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা এবং যার যার প্রাপ্য সম্মান প্রদান করা। এটা করতে পারলে প্রচলিত রেষারেষি, একে অন্যের প্রতি কালিমা লেপন এবং একে অন্যের অবদানকে মুছে ফেলার সংস্কৃতির পরিবর্তে আমরা সকলেই জাতীয় নেতাদের স্থায়ীভাবে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করার সুযোগ পাব। আশা করি সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে এক মত হয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে দেশে গ্রহণযোগ্য থিঙ্ক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন