মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৪৩ এএম
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সজ্জন রাজনীতিকের বিদায়

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

গত ২৪ অক্টোবর মধ্যরাতে মোবাইল ফোনে একটি খুদে বার্তা পেলাম—‘সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মারা গেছেন।’ বার্তাটি দেখে বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য তখনই সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিগত সহকারী সমীরকে ফোন করলাম। ঢাকায় তখন ভোররাত সাড়ে ৪টা হবে। সমীর কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, সৈয়দ আবুল হোসেন স্যার আড়াই ঘণ্টা আগে (২৫ অক্টোবর ২টা ৫ মিনিটের দিকে) ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা গেছেন। সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত উপর্যুপরি কয়েকটি হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়বর্গ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, দেশবাসীসহ দেশ-বিদেশে তার হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ ভাবতে পারেননি এভাবে হঠাৎ তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাবেন। তবে মহান আল্লাহতায়ালা আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মাধ্যমে তার নিজের, পরিবারের সদস্যদের ও আত্মীয়স্বজনসহ দেশবাসীর জন্য কতটুকু কাজ করিয়ে নেবেন।

নানা কারণে সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি আমি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মরত থাকাকালে অফিসে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’-এর ক্যালেন্ডার ও ডায়রি পাই। পরে অবশ্য তার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে দেখাও হয়। ২০০৮-০৯ সালে আমি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নেগোশিয়েশনে অন্যদের সঙ্গে আমিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব ভাবলেন আমার সঙ্গে যেহেতু বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা—সবারই সুসম্পর্ক রয়েছে, তদুপরি আমার সচিব আমারই ব্যাচমেট মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা আমার কাজের প্রশংসা করেন, সেহেতু আমাকে সেতু বিভাগের সচিব করা হলে ওই বিভাগের কাজে আরও গতি আসবে। তিনি অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে সেতু বিভাগের সচিব করার প্রস্তাব করেন। আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় অবশেষে ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি আমাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব করে আদেশ জারি করা হয়। নিউইয়র্ক থেকে ফিরে আমি ৩ ফেব্রুয়ারি সেতু বিভাগের সচিব পদের দায়িত্ব গ্রহণ করি।

সৈয়দ আবুল হোসেনের শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে আমার আগে থেকেই জানা ছিল। তবে তার সঙ্গে কাজ করে তার মেধা, চিন্তা, কর্মদক্ষতা, দেশপ্রেম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য, বিশ্বাস ও আস্থার বিষয়গুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করি। সেতু বিভাগের যাবতীয় কাজে তিনি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দিতেন। কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তার মধ্যে ছিল না। পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ সেতু বিভাগের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ছোট-বড় বহু ঠিকাদারি কাজ ছিল। আমরা নির্বিঘ্নে আইন ও বিধি মোতাবেক সেসব কাজে ঠিকাদার নিয়োগ করতাম। তিনি কারও জন্য কোনো রাজনৈতিক সুপারিশ করতেন না। পরিচিত কেউ তদবিরে এলে তিনি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আমি ভদ্রভাবে বিধিবিধানের বিষয় বলে দিতাম।

আমি সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে যোগদানের পর বুঝতে পারি আমার মাথার ওপর একজন মুরুব্বি আছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যার নিবিড় সম্পর্ক। যেসব নথিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন সেসবের সারসংক্ষেপ তিনি নিজ হাতে নিয়ে তাৎক্ষণিক সই করিয়ে আনতেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কাজ ও দক্ষতার প্রশংসা করতেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী আমাকে ভালো জানতেন বলে শুনেছি।

মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কর্মতৎপরতা ও উন্নয়ন দর্শন বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করব। এখন তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্ম ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার কালকিনি থানার ডাসার গ্রামে। তার পিতা সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন ওই এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই সৈয়দ আবুল হোসেনের সুরুচি, ভদ্র আচরণ, সবার সঙ্গে মেলামেশা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়া ইত্যাদির কারণে সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সে সুবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বড় বোন শেখ হাসিনার সান্নিধ্যে আসেন। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ থেকে ম্যানেজমেন্টে এমকম পাস করার পর তিনি কিছু সময়ের জন্য টিসিবিতে চাকরি করেন। ১৯৭৫ সালেই তিনি নিজ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকো (SAHCO) ইন্টারন্যাশনাল গড়ে চাকরি ত্যাগ করেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা ভাগ্য খুব ভালো। তার প্রতিষ্ঠান সড়ক, সেতু, রেলযোগাযোগ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি অবকাঠামো নির্মাণে বিখ্যাত বিদেশি ঠিকাদারের স্থানীয় এজেন্ট বা পার্টনার হিসেবে কাজ করে। দরপত্র প্রস্তাব, চুক্তিপত্র ইত্যাদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহযোগে তার অফিসে প্রণীত হয় এবং তার প্রতিষ্ঠান থেকেই দরপত্র জমা দেওয়া হয়। তিনি নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এসব কাজের তদারকি করতেন। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—সব সরকারের আমলেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভালো করেছে। অনেকে বলেন, টিসিবির একজন সামান্য অফিসার থেকে ব্যবসা করে এত বড়লোক, এত টাকাপয়সা কামালেন কীভাবে। তারা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন, তিনি কারও কাছ থেকে কোনো অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেননি। কোনো ব্যাংকের টাকা চুরি করেননি। তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করেছে তার মেধা, বুদ্ধি ও দক্ষতার কারণে। পৃথিবীর বহু দেশের নামিদামি কোম্পানির সঙ্গে তার ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল; তবে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল সবচেয়ে বেশি। সুবাদে চীন সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার সদ্ভাব ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর দরবার শরিফের গদ্দীনশিন পীর খাজা মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনের মেয়ে খাজা নার্গিসকে বিবাহ করেন। তার দাদাশ্বশুর খাজা মোহাম্মদ ইউনুস আলী ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং এনায়েতপুরী পীর বংশের প্রতিষ্ঠাতা। সৈয়দ আবুল হোসেনের দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়্যাত ও সৈয়দা ইফফাত উভয়ই উচ্চশিক্ষিতা ও গুণী।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাহচর্য্যে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসেন। পার্টির জন্য তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে অর্থ খরচ করতেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আব্দুল মুহিত কথা প্রসঙ্গে একদিন আমাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগে অনেক ব্যবসায়ী নেতা রয়েছেন কিন্তু আবুল হোসেনের মত মুক্ত হস্তে পার্টির জন্য টাকা খরচ করতে কাউকে দেখিনি। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকে পার্টির দুর্দিনে আবুল যা করেছে তার কোন তুলনা হয় না। ১৯৯৪-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় পার্টির পক্ষ থেকে প্রণীত স্মারকলিপি, কাগজপত্র ইত্যাদি তার কাছে দেয়া হলে এক রাতের মধ্যে ফটোকপি, বাইন্ডিং ইত্যাদি করে পরদিন সকালের মধ্যে সকল বিদেশী দূতাবাস, বহুজাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজ প্রভৃতি সকলের কাছে তার লোকদের মাধ্যমে গাড়ি করে বিলি করে দিতেন।’

সৈয়দ আবুল হোসেন প্রচলিত ধারার রাজনীতি করতেন না। তিনি কোনো মিছিল বা জনসভায় যেতেন না। শুধু নিজ জেলা বা নির্বাচনী এলাকার জনসভা হলে তথায় যোগদান করে বক্তৃতা করতেন এবং মঞ্চে বসতেন। তবে তিনি পার্টির গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যোগদান করতেন। আওয়ামী লীগে তিনি দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে আন্দোলনরত অনেক নেতার ছিল ‘দুর্দিন’। শোনা যায়, নিজ দল এবং সমমনা অন্যান্য দলের অনেকের কাছে তিনি নিয়মিত ‘প্যাকেট’ পাঠাতেন। এমনকি বিরোধী দলে থাকাকালে বিদেশ ভ্রমণে তিনি পার্টির নেতাদের বিমান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বহন করেছেন।

সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ এলাকার শিক্ষা বিস্তার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দরিদ্রদের দান-অনুদান ও অন্যান্য সহায়তা করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, তার জন্য এলাকার লোকজন তাকে চিরদিন মনে রাখবে। তিনি পিতা-মাতা, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং নিজ নামে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ ছয়টি কলেজ ও স্কুল এবং ১৫০টির মতো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরে জাতীয়করণ করা হয়েছে। ছাত্রাবাসসহ কলেজগুলো পাঁচতলাবিশিষ্ট। প্রকাণ্ড মাঠসহ চারদিক দেয়ালঘেরা। প্রতিবছর বেশ কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী এসব স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বেরোচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হয়ে বা বিসিএস পাস করে বহু ছাত্রছাত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দোয়া নিতে তার অফিসে এসে দেখা করতেন। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। শুধু নিজ এলাকায় নয়, বাংলাদেশের অনেক এমপি বা রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা বা অনুদান নিয়ে নিজ এলাকার স্কুল-কলেজের কাজে লাগিয়েছেন। তিনি এলাকায় বহু রাস্তাঘাট নিজ অর্থে নির্মাণ করে জেলা-উপজেলায় বড় রাস্তার সঙ্গে সংযোগ করে দিয়েছেন। নিজ গ্রাম ডাসারকে থানা ও উপজেলায় উন্নীত করেছেন। এর ফলে মাদারীপুর জেলা ‘সি’ থেকে ‘বি’ গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। এসব করার জন্য তিনি নিজে সংশ্লিষ্ট সচিব, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করতেন। সৈয়দ আবুল হোসেন দেশে যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার নজির শুধু বাংলাদেশ কেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বিরল। শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবার জন্য তিনি ২২টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়া তিনি ২০টি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন।

সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে চারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর পুনরায় ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেন। অবশ্য একটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি মেয়াদ পূর্তির আগেই পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে তিনি সড়ক, রেলপথ ও সেতু বিভাগে বহু নতুন নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করে একনেক সভায় নিয়ে গেছেন। প্রায় তিন শতাধিক প্রকল্প প্রণয়ন করে পরবর্তীকালে বাস্তবায়নের জন্য তালিকাভুক্ত করেন। এসব প্রকল্পের অনেকেই এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বেশ কিছু প্রকল্প এখনো বাস্তবায়নাধীন।

সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে সচিব হিসেবে আমার কর্ম অভিজ্ঞতা খুবই সুখকর ছিল। তিনি কখনো কোন কাজে অনৈতিক তদবির বা আদেশ প্রদান করতেন না। তার সাথে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করেছি। সরকারের সচিবদের তিনি খুব সম্মানের চোখে দেখতেন। আমাকে সব সময় ‘সচিব মহোদয়’ সম্বোধন করতেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের প্রতিটি ধাপেই অগ্রগতি মনিটর করতেন। মন্ত্রীমহোদয়কে সাথে নিয়ে আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যেতাম। আমাদের টার্গেট ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সরকারের মেয়াদকাল অর্থাৎ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই শেষ করা। মন্ত্রী মহোদয় মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে প্রকল্প পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তা, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ দ্বারা গঠিত এক্সপার্ট কমিটি এবং ডিজাইন পরামর্শকদের সাথেও আলোচনা করতেন। কাজের খুঁটিনাটি ও টেকনিক্যাল বিষয়াদিও তিনি ভাল বুঝতেন।

পদ্মা সেতুর কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তাগণ যোগাযোগ মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন, তবে কেউ কেউ সন্দেহ করেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’ এর কর্মকর্তাগণ পদ্মা সেতুর কাজ পেতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে গোপনে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংক অভিযোগও উত্থাপন করে। দেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় বিশ্ব ব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে তখন দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের একাংশ সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তীব্র সমালোচনা করে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সরকার বিশ্ব ব্যাংকের কয়েকটি অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হয়। আমাকে বাধ্যতামূলক ছুটি প্রদান করা হয়। অর্থমন্ত্রীসহ কতিপয় মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা ও সুধীজনের চাপাচাপিতে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তার পদত্যাগ পত্র দিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় ১০ দিন এ পদত্যাগের বিষয় প্রকাশ করেননি। সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রণালয়ে অফিস করা থেকে বিরত থাকায় মিডিয়ার সন্দেহ হয় এবং কোন কোন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় যে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন। তার পদত্যাগ গৃহীত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশে তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যায়িত করেন, কারণ দেশের স্বার্থে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন।

পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় আমাকে প্রধান আসামি করে ছয়জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। আমাকে ও অন্য আরও দু’জন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলায় না জড়ানোর কারণে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়। দেশের মিডিয়া, সিভিল সোসাইটির সদস্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি সরকার, দুদক এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করে এবং প্রচার করে যে সৈয়দ আবুল হোসেনের কারণে পদ্মা সেতু হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। আমাকে দুদক কর্তৃক গ্রেফতার করা হলে সৈয়দ আবুল হোসেন খুবই বিচলিত হন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে জেল থেকে বেরিয়ে ক’দিন বিশ্রামের পর আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে তার ব্যবসায়িক অফিসে দেখা করতে যাই। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার গ্রেফতার, থানা ও জেল হাজতবাসসহ নানা দুরবস্থার বিবরণ শুনে তিনি খুবই ব্যথিত হন ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি আমার ধৈর্যের প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, আমার মত অবস্থা যদি তার হতো, তবে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারতেন।

পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি না করা হলেও দুদক এর ভাষায় তাকে ‘সন্দেহভাজন’ তালিকায় রাখা হয়েছিল। তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও আসামি করা হতে পারে মর্মে দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারগণ মিডিয়ায় প্রায়ই বলতেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মিথ্যচার ও অপপ্রচারে সৈয়দ আবুল হোসেন খুবই দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন।

আমার মামলা পরিচালনা ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন নানাভাবে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে সহায়তা করেছেন এবং সাহস যুগিয়েছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আপনি আমার সাথে কাজ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন, কষ্ট করেছেন। আমার সচিব জেলে গেলেন, আমি কিছুই করতে পারলামনা, এজন্য একটা অপরাধবোধ সবসময় আমাকে পীড়া দেয়।” অবশেষে অধিকতর তদন্ত শেষে দুদক মামলা নিষ্পত্তি করে আসামীদের বেকসুর খালাস দিলে আমি রেহাই পাই এবং তিনিও শঙ্কামুক্ত হন।

পদ্মাসেতুর কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সন্দেহের তীর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডঃ মসিউর রহমানের দিকেও বর্ষিত হয়েছিল। সেজন্য পরবর্তীতে আমাদের তিনজনের মধ্যে আরো সখ্যতা গড়ে ওঠে। বেশ কয়েকবার আমরা একসাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাসায় গল্প করে সময় কাটিয়েছি এবং ডিনার করেছি। সৈয়দ আবুল হোসেনের পরিবারের সদস্যগণও আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তার বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। অবসর গ্রহণের পরও তিনি আমার পরম সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আমাকে প্রধানমন্ত্রী এনবিআর এর চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করায় তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণামতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে ২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী এ সেতু উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনস্থলে প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, ডঃ মসিউর রহমান ও আমাকে তার পাশে নিয়ে বোতাম টিপেন। তার বক্তৃতায়ও আমাদের অবদান ও ত্যাগ স্বীকারের কথা উল্লেখ করেন। এটি আমাদের জন্য বিরাট পাওয়া। শুধু পদ্মা সেতু নয় ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল, বেশ কিছু বৃহৎ সেতু এবং রেলের বিভিন্ন প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা শুরু করেছিলাম। এসব মেগা প্রকেল্পর সাথে জড়িত থাকতে পেরে আমি গর্বিত। আমাকে সচিব পদে নিযুক্তির জন্য মহান আল্লাহ তা'আলা ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমি চির কৃতজ্ঞ।

সৈয়দ আবুল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। জার্মানিতে বসেও মাঝে মাঝে তার সাথে টেলিফোনে কথা হতো। তিনি সরকারে না থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজন ও প্রিয়পাত্র ছিলেন। বিদেশে অবস্থান করার কারণে তার মৃত্যুর সময় ও জানাযায় উপস্থিত থাকতে না পারায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীও ২৫-২৬ অক্টোবর ব্রাসেলস অবস্থান করছিলেন। নিশ্চয়ই তিনিও খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। দেশে ফিরে তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনের গুলশানের বাসভবনে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন ও সান্ত্বনা দেন।

সৈয়দ আবুল হোসেন একজন অতিশয় সজ্জন ও পরোপকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কখনো কাউকে কটু কথা বলতেন না, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন না বা ক্ষতি করার চেষ্টা করেননি। তার কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণকারী অনেকে তার বিপদের সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

দুদকের মামলা নিষ্পত্তি এবং কানাডীয় আদালত কর্তৃক পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রের মামলায় সব আসামি বেকসুর খালাস পাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘সরকারের উচিত সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দেওয়া।’ তিনি জীবিতকালে মন্ত্রিত্ব ফিরে পাননি, তবে অসংখ্য উপকারভোগী ও দেশবাসীর দোয়া, প্রশংসা এবং প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসা ও স্নেহাশীষ পেয়েছেন। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে মাফ করে দিয়ে বেহেশত দান করুন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের অপূরণীয় ক্ষতি সহ্য করার শক্তি দান করুন।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া : সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘আ.লীগ ভিন্ন রাষ্ট্রের আদেশ বাস্তবায়নে ক্ষমতা দখলে রেখেছিল’

ঢাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ

কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে : নাছির উদ্দীন 

তিনবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ গ্রেপ্তার

শিল্পকলায় প্রদর্শিত হলো সার্কাস

৮ দফা অবিলম্বে বাস্তবায়ন দাবি ঐক্য পরিষদের

পুলিশ পরিচয়ে দখলবাণিজ্য এসপি শামীমা ইয়াসমিনের

ওয়ানডে সিরিজেও মুশফিককে নিয়ে শঙ্কা

বিধানসভা উপনির্বাচন / পশ্চিমবঙ্গে ৬ আসনেই তৃণমূলের জয়

জোর করে পদত্যাগ করানো সেই উপাধ্যক্ষের হৃদরোগে মৃত্যু!

১০

বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে পরীমণির স্ট্যাটাস

১১

টেস্টে হাসানের দারুণ রেকর্ড

১২

নির্দোষ ব্যক্তিদের নামে হওয়া মামলা আইন মেনে প্রত্যাহারের নির্দেশ

১৩

ব্র্যাকের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হটলাইন ‘মনের যত্ন’ চালু

১৪

৮ মাসে হাফেজ হলেন ৮ বছরের ওমর

১৫

নৌবাহিনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী

১৬

বিধানসভা নির্বাচন / ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি-কংগ্রেসের, মহারাষ্ট্রে বিজেপি জোটের জয়

১৭

বেসিস ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্যান্ডিং কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত

১৮

নেতাদের বাঁচার উপায় বাতলে দিলেন তারেক রহমান

১৯

গল্পে গল্পে পাপনকে খোঁচা ফারুকের

২০
X