বাংলাদেশের অর্থনীতি সর্বগ্রাসী হুন্ডির কবলে পড়েছে। শত চেষ্টা করেও এই অর্থনীতি খেকো হুন্ডির গায়ে না লাগানো যায় বিষাক্ত তীর- না লাগানো যায় বন্ধুকের গুলি। অনবরত গিলছে তো গিলছেই। এতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। কারণ এর ভীত বড় শক্ত এবং শেকড় বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। কী বলছেন সম্মানিত পাঠক- হুন্ডির পূর্বাপর কথা জানতে চাচ্ছেন? হাঁ হুন্ডির কথাই বলছি। ঘোড়ার স্ত্রী লিঙ্গ যেমন ঘুড়ি, সেই রকম হুন্ডার স্ত্রী লিঙ্গ হুন্ডি, তা কিন্তু নয়। গঠন প্রণালির দিক দিয়ে এটি সামান্য একটি অনানুষ্ঠানিক কাগজের টুকরা (বিনিময় বিল) বই আর কিছু নয়। কিন্তু ম্যাগনিচিউড অনেক বেশি। যাহোক, এতক্ষণ রূপকভাবে কথা বললেও এবার আসুন দেখা যাক হুন্ডি কী, কী তার প্রকৃতি এবং কেন আমাদের অর্থনীতিকে এত বড় ভয়াল থাবাতে জীর্ণশীর্ণ করে তুলেছে?
হুন্ডি (Hundi) বলতে সাধারণত নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে কিম্বা অননুমোদিত চ্যানেলে বিভিন্ন কৌশল ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ আনয়ন বা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। হুন্ডি হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা মধ্যযুগীয় ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনে ব্যবহারের জন্য উদ্ভূত হয়েছিল। সাধারণত হুন্ডি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ প্রেরণের জন্য রেমিট্যান্স পদ্ধতির একটি মাধ্যম, যা ক্রেডিট উপকরণ হিসেবে অর্থ দেনা-পাওনা বা IOU এবং যুগপৎ বাণিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে বিনিময় বিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা হয়।
আসলে হুন্ডির মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। হুন্ডির কার্যক্রম প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। একটা সময়ে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ। এখনো তা নিরাপদ, তবে বৈধ না। অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সিল্ক রুটে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। ডাকাতির ভয়ে তখন নগদ অর্থ বা মূল্যবান কিছু বহন করা নিরাপদ ছিল না। আর সেই সময় থেকেই হুন্ডির প্রসার।
বস্তুত হুন্ডি বা হাওয়ালা একই প্রপঞ্চ। হাওয়ালা কথাটা এসেছে আরবি থেকে। আর হুন্ডি এসেছে সংস্কৃতি হুন্ড শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো সংগ্রহ করা। হুন্ডি কথাটি আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়। আর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতে হাওয়ালা কথাটা প্রচলিত এবং এর অর্থ হচ্ছে লেনদেন বা কোনো কিছু পাঠানো। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সে সময়ে ভারত উপমহাদেশের লোক এতটাই সরল ও খোলামেলা ছিল যে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন অপরিচিত ব্যক্তি কোনো সররাফের (কথিত ব্যাংক) কাছে সাক্ষী ছাড়া অর্থ জমা দিতে দ্বিধাবোধ করত না। অবশ্য এক্ষেত্রে সিলমোহর ও খাম ছাড়া শুধু একটি চিরকুট পেত। আর পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি আবার দূরে কোনো তার চাহিদা মতো স্থানে সররাফের কর্মচারী গোমস্তা বা এজেন্টের কাছে ওই চিরকুট উপস্থাপন করলে কোনো বাক-বিতণ্ডা বা ঢিলেমি ছাড়াই অতি সহজে টাকা হাতে পেয়ে যেত। আসলে এদেশে এটিই হুন্ডির অন্যতম আদি কথা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, হুন্ডি মোগল অর্থনীতির অধীনে বিকশিত একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ লেনদেন পত্র। মূলত হুন্ডি বলতে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আর্থিক দলিল। অর্থ প্রেরণের উপায়, ঋণ প্রদান এবং বাণিজ্যিক লেনদেনে বিনিময় বিল হিসেবে হুন্ডি ব্যবহৃত হতো। কৌশলগত দিক দিয়ে এটি হলো এমন একটি লিখিত শর্তহীন আদেশ, যা এক ব্যক্তির নির্দেশ অনুযায়ী অন্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়। এই হুন্ডি অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অংশ হওয়ার কারণে এই আইনগত কোনো অবস্থান নেই। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ১৭ শতকে বাংলা থেকে দিল্লিতে ভূমি রাজস্ব বা খাজনা পাঠানো হতো কফিল অথবা গরুর গাড়ির মাধ্যমে। এ পদ্ধতি ছিল একদিকে ব্যয়বহুল এবং অন্যদিকে অনিরাপদ।
এতদ্বতীত রাজকীয় অর্থ পাঠানোর কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে মুদ্রার সংকট দেখা দিত। আর এই কারণে সেই সময়েই হুন্ডির বাজার বিকশিত হয়। মজার ব্যাপার হলো, হুন্ডি ব্যবস্থা শুধু মুদ্রা অর্থনীতির উত্থানেই অবদান রাখেনি। বরং সামরিক অভিযান ও দূরবর্তী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তাছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সু-সম্পর্ক স্থাপন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এক্ষেত্রে ইউরোপের উপকূলবর্তী প্রায় সব দেশের বণিকরা যখন এ উপমহাদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আসে। তখন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পর হুন্ডি ব্যবস্থা তাদের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রকাশ থাকে যে মোঘল আমলের পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে জগৎ শেঠ ও মাহতাব চাঁদের হুন্ডি গৃহ সর্বজন বিদিত ছিল।
১৮ শতকের শেষার্ধে বাংলায় আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ১৯ শতকের প্রথমার্ধে হুন্ডি ব্যবস্থার ততটা গুরুত্ব থাকে না। তবে একসময় যে হুন্ডি ছিল নিরাপদ অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা, সেটাই এখন অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা। প্রকাশ থাকে, ঔপনিবেশিক আমলে, ব্রিটিশ সরকার হুন্ডি প্রথাকে আদিবাসী বা ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করত, তবে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। এমনকি তারা এতে হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক ছিল কারণ এটি ভারতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল এবং তারা এই ব্যবস্থার অধীনে লেনদেনের ওপর কর পর্যন্ত আরোপ করতে চেয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, সরকারি হুন্ডিগুলো রানি ভিক্টোরিয়াসহ ব্রিটিশ রাজাদের ছবি সমেত রাজস্ব স্ট্যাম্প যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধের কারণে প্রায় সময়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হতো। তাই অনেক সময় এই ব্যবস্থাটি লুকোচুরির আওতায় সম্পাদন হতো।
হুন্ডি অনেক প্রকারের। তবে বহুল ব্যবহৃত হুন্ডি দুই প্রকারের। যেমন : ১. দর্শনি হুন্ডি এবং ২. মুদ্দাতি হুন্ডি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, দর্শনি হুন্ডি দৃশ্যমান, যা সচারচর চোখে পড়ে এবং এটি প্রাপ্তির পরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ প্রদান করতে হয়, যা চাহিদা বিলের অনুরূপ। অন্যদিকে মুদ্দাতি হুন্ডি টাইম বিলের মতো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে দিতে হয়।
এখন প্রথম পর্বের উল্লিখিত সেই কথা দিয়ে শুরু করছি, যা হলো- ‘এক সময়ে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ। এখন তা নিরাপদ তবে বৈধ নয়।’ এর সপক্ষে একটি গল্প মনে পড়ে যায়। তবে গল্পটি সত্য কী মিথ্যা, তা জানি না। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে জনৈক বন্ধু বলেছিল যে কোনো একটি সরকারি সংস্থার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি প্রায় দুই কোটি টাকা অবৈধ পথে অর্জন করেন। কিন্তু এই কালো টাকা নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লে তারই একজন বন্ধুর পরামর্শে তার (সভাপতি) যে ছেলে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিল। সেই ছেলের নিকট হুন্ডি মারফত ওই অর্থ পাঠায়। পরে ছেলের প্রবাসী আয় দেখিয়ে বাটা দিয়ে হুন্ডি মারফত ফেরত এনে সেই টাকা হোয়াইট বা হালাল করেন। এই ধরনের ঘটনা না কি চক্ষুর আড়ালে অহরহ হচ্ছে।
আসলে আগে হুন্ডির কার্যক্রম তখনকার সময়ের উপযোগী হলেও এখন খারাপের দিকটাই বেশি। তাই হুন্ডি ব্যবসা কোনো দেশেই ভালো চোখে দেখে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, কোনো এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মহোদয় বলেছিলেন যে দেশে প্রবাসী আয় আনুষ্ঠানিক বা অফিসিয়াল চ্যানেলে আসে ৫১ শতাংশ, আর হুন্ডিতে ৪৯ শতাংশ।
এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে, তা হলো ৪৯ শতাংশ হুন্ডিতে আসলেও প্রবাসীর আত্মীয়স্বজন দেশিও টাকা পায়। অথচ এর ক্রিম (Creame) ডলার বেহাত হয়ে যায়। আর একটি কথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে এক ডলার মানে এক ডলার নয়। এর সঙ্গে স্যাডো প্রাইজ (Shadow Price) হিসেবে আরও ২৫% যোগ করতে হয়। যা হোক, হুন্ডি কার্যক্রম উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তার পেছনে উল্লেখ্য, প্রবাসীরা ডলারের বেশি দর পেতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী বলে হুন্ডির চাহিদা তথা পরিমাণ বাড়ছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলেন, দেশে ডলারের চাহিদা বেশি হলে হুন্ডিওয়ালারা এ সুযোগ নিয়ে থাকে। সত্যি কথা বলতে কী, অর্থ পাচার একটি অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকী স্বরূপ। এর মধ্যে লাখো-কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এক্ষেত্রে জনৈক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ বলেন, এই উন্নয়নশীল অর্থনীতি আরও বেগবান হতো, যদি অর্থ বা পুঁজি পাচার না হতো। আর পাচারের দিক দিয়ে প্রায় অর্থনীতিবিদ হুন্ডিকে দায়ী করেন।
তবে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে যে পরিমান অর্থ পাচার হয়েছে, তার চেয়ে ১০ গুণ হয় বাণিজ্যের আড়ালে (ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং)। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে অর্থনৈতিক প্যারামিটারগুলোর একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্তপূর্বক মিথস্ক্রিয়ার আওতাভুক্ত বিধায় বর্তমান বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে আলু, পেঁয়াজ, মরিচ ও ডিমসহ শাকসবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এক্ষত্রে হুন্ডির নেতিবাচক কর্মকান্ডের পরোক্ষ ভূমিকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অবশ্য অনেকে সিন্ডিকেটের কথাও বলে থাকেন।
বর্তমান হুন্ডি ব্যবসা রমরমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া বিভাগের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জো লিউ শি এবং পরামর্শক শিয়াও জু লিখেছেন, সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ঠিক রাখতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু এতে উল্টো ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে সংকট আরও বাড়ছে। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, সরকার যখন বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। তখন হুন্ডির চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।
বিশেষ করে, আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খুলতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলে ছোট ছোট আমদানিকারকরা হুন্ডির ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তখন বেশি দরে ডলার ক্রয়ের কারণে হুন্ডির লেনদেনের পথ সুগম করে থাকে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারর্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ (এবিবি) কর্তৃক ডলারের হার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই নির্ধারিত ডলারের হারের চেয়ে বাজারে ডলারের দাম বেশি বলে হুন্ডির কার্যক্রম তৎপর হয়ে উঠেছে। যদিও অনেক ব্যাংক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বেশি দামে ডলার কিনছে। কেননা নির্ধারিত রেটে ডলার কিনতে গেলে বাজারে অধিক দাম থাকায় রেমিটেন্স ডলার কেনা সম্ভব হয় না। তখন ওগুলো হুন্ডিওয়ালার কবজায় চলে যায়। এক্ষেত্রে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও সমন্বয়হীনতা আরও তালমাতাল করে তুলেছে।
সত্যি কথা বলতে কী, যতগুলো কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো হুন্ডির তেলেসমাতি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, গত ০৮.১১.২০২৩ তারিখে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, রিজার্ভ না কি এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বস্তুত মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা আর্থিক প্রণোদনা প্রবাসী আয়কে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। কেননা দেশীয় মুদ্রা যদি দুর্বল অবস্থায় থাকে। সেক্ষেত্রে প্রবাসী আয় পাঠাতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হলেও স্বল্প মেয়াদে প্রবাসীদের কাছে সরকারি হার আকর্ষণীয় হতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে যতক্ষণ না পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতা ঠিক রাখা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ হুন্ডির দিকে ঝুঁকে থাকবে। ইতোমধ্যে প্রণোদনা দিয়ে ও টাকার বড় অবমূল্যায়ন করেও প্রবাসী আয়কে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তাই এর জন্য সবার আগে পুরো আর্থিক খাতকেই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ এবং অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আসলে এই সমস্যাটি ক্যান্সারের মতো জটিল এবং সহজে সমাধা করা দুরূহ ব্যাপার। এদিকে মানি লন্ডারিং আইন মোতাবেক সঠিক ডকুমেন্টসবিহীন লেনদেন দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু অবস্থাভেদে প্রতীয়মান হয়, আইন করে বা পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে হুন্ডি বন্ধ করা অলীক কল্পনা মাত্র।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কার্ভ নিম্নমুখী। এদিকে মানি মার্কেটসহ খোলা বাজারে চলছে ডলারের তীব্র সংকট। যে ভাবেই বলি না কেন, রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রবাসী আয়। অথচ হুন্ডিই হলো এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরেই সংঘবদ্ধ চক্রগুলো অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে চলেছে। এটি মানি লন্ডারিংর আওতায় থাকলেও তারা কোনো কিছু ভ্রুক্ষেপ করছে না। বলতে গেলে এখন উভয় সংকট। কেননা ডলারের বেঁধে দেওয়া দর কার্যকর করতে গেলে বিপত্তি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে খোলাবাজারে ছেড়ে দিলে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই অনেকে বলেন, এক্ষেত্রে হুন্ডির জয়জয়কার। অতীতে যাই হোক না কেন, বর্তমানে হুন্ডি নৈতিকতাবর্জিত ব্যবসা। এটি প্রকারান্তরে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না।
বাস্তবে দেখা যায়, উন্নয়নশীল তথা মধ্যম আয়ের দেশে হুন্ডির নেতিবাচক কার্যক্রম ঠেকানো মুশকিল। আবার সামনে জাতীয় নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের সময়ে সাধারণত দেখা যায়, পাচার তুলনামূলক বেড়ে যায়। যা হোক, পরিশেষে বলতে চাই, হুন্ডির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অপকাণ্ড ঠেকাতে মানি মার্কেটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নড়ে চড়ে বসতে হবে। নতুবা অর্থনীতি খেকো হুন্ডি রোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব : বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক
মন্তব্য করুন