‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ শিরোনামে জীবনানন্দ দাসের একটা কবিতা রয়েছে। সেখানে সমাজে বিরাজিত বিভিন্ন অসংগতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। আক্ষেপ করে বলা হয়েছে কী হওয়ার কথা ছিল আর হচ্ছেটা কি? এই খেদ পরম্পরা চলছে। তবে দিন যত যাচ্ছে এই আক্ষেপের মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির এ যুগের সঙ্গে আক্ষেপের যেন জন্ম-জন্মান্তরের মিতালি হয়ে গেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। হওয়ার কথা ছিল ভিন্ন। মানুষ ভুল করে। ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না। নিলে ভালো হতো। মানুষ ইতিহাস গড়ে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। নিলে পৃথিবীটা আরও অনেক নিরাপদ থাকত। মানুষ পাপ করে। কিন্তু অনুশোচনা করে না। করলে আমৃত্যু সুখী হতো। মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়। দিয়ে তৃপ্তি পায়। নিজে কষ্ট পেলে ক্লিষ্ট হয়। অথচ অপরের কষ্টের দাহ বুঝে না। বুঝতে চায় না। জাগতিক এ কঠিন পৃথিবীতে মানুষ বড় বড় ধাক্কা খায়, সাময়িক থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে শুদ্ধ পথে চলে না। কেউ কেউ নিজেকে শুধরে নেয়। তারা পবিত্র মানুষ। তাদের কথা কেউ মনেও রাখে না। যত ডামাডোল বীর পুঙ্গবদের নিয়ে। তা সে যে পদেরই হোক।
আমরা এতটাই বিস্মৃতপরায়ণ জাতি যে, ক’বছর আগের করোনার হিংস্রতাকে বেমালুম ভুলে গেছি। করোনা আমাদের কাছে এসেছিল শিক্ষা দিতে। কিন্তু আমরা তা থেকে শিক্ষা নেইনি। কথা ছিল একবার বেঁচে গেলে আমরা শুদ্ধ হবো, পবিত্র হবো। শুধরে নেব জ্ঞাত-অজ্ঞাত যত ভুল, যত অপরাধ, যত অবিচার, অনাচার। কথা ছিল একবার প্রাণ ভিক্ষা পেলে পৃথিবীটাকে বদলে দেব আতর-গোলাপ জল দিয়ে ধুয়ে। মানুষের কাছে তো বটেই পশু-পাখী আর প্রকৃৃতির কাছে কৃত অপরাধের মাশুল হিসেবে মায়া দেব, ভালোবাসা দেব, আর সুন্দর ভবিষ্যৎ দেব। ধর্মে যাদের বিশ্বাস ছিল না অথবা ঘাটতি ছিল প্রচুর তারাও ঘরে বসে দম নিয়ে চোখ মুঁদে প্রার্থনা করেছে যার যার নিয়মে। একটিবার জীবন ভিক্ষা চাওয়ার সে কি আকুতি! একে একে পরম আত্মীয়দের বিয়োগ ব্যথায় বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকা ছাড়া তখন আর কোনো পথ ছিল না। তখন কেবলই মনে হতো উপরওয়ালা এই বুঝি করুণা বারি ঢেলে দেবেন, এই বুঝি অলুক্ষণে বাতাস তার যাত্রা পথ ঘুরিয়ে চলে যাবে পৃথিবীর বাইরে কোথাও।
তখন একেকটা দিন ছিল অন্যরকম। দেখিনি এর আগে এরূপ কখনো, কোনোদিন। শুনিওনি কোনোদিন আগে কারও কাছে। তখন রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। কোনো যুদ্ধ না, কোনো কারফিউ না, অবরুদ্ধ ফিলিস্তিতের মতো কোনো দশাও না। কেউ দিব্যি দিয়ে বলেনি বাইরে বেরুলে বংশ নাশ হবে, গুলি করে মারা হবে। অথচ আমরা স্বপ্রণোদিত অনুশাসনে অষ্টপ্রহর ঘরেই থেকেছি। থেকে থেকে নাভিশ্বাস হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। তবু সুবোধ বালকের মতো নিজেদের শৃঙ্খলিত রেখেছি বিনা বাক্য ব্যয়ে। তখন কেবলই মনে হতো এ জীবন তুচ্ছসম। মৃত্যুই অবধারিত গন্তব্য। ধর্মই তার একমাত্র ম্যানুয়েল। পরোপকার হলো জীবনের একমাত্র এজেন্ডা। সুবিচার প্রতিষ্ঠাই জগতে শান্তি বজায়ের একমাত্র উপায়। তখন কেবলই মনে হতো যাদের সম্পদ নেই, থাকলেও নামমাত্র তাদেরও আমাদের সম্পদে অংশ আছে। এতদিন হেলাফেলায় সেই দেনা পরিশোধ করা হয়নি। এখন সময় এসেছে শোধ করার। তখন মনটা কেবলই ক্ষণে ক্ষণে স্পঞ্জের মতো নরম আর তুলতুলে হয়ে যেত। মনে হতো পরিস্থিতি একবার স্বাভাবিক হলে বকেয়া সব ভালো ভালো কাজগুলো এক এক করে দ্রুত কাজা করে নেব। তখন গরিবদের জন্য মনটা কঁকিয়ে উঠত। ভাবতাম, অনেক দিন তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। যৎসামান্যও করা হয়নি ওদের জন্য কখনো। বস্তিবাসীর কথা খুব মনে হতো। গ্রামের গরিব স্বজন আর সুজনের কথা মনে হতো। শহুরে খেটে-খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের ভংগুর মুখ ভেসে আসত। চিকিৎসা কাতর রোগীদের বাঁচার তাগিদের কথা স্মরণ হলেই গা কাটা দিয়ে উঠত। দিল আরও নরম হয়ে যেত। তখন আরও বেশি বেশি মনে হতো এ জীবন দু’দিনের খেলাঘর মাত্র। এই আছি, এই নাই। কি হবে এত খাই খাই করে? দেখাদেখি করে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে এত রেশারেশি, এত মারামারি, এত প্রবঞ্চনা, এত জুলুমবাজী আর এত এত মিথ্যার বেসাতি করে? তখন ঘুরেফিরে একটা কথাই মনে হতো একবার জীবন ফিরে পেলে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে পালটে ফেলব যাপিত জীবনের ধারা। সাদা ভাত আর মোটা কাপড় হলেই যথেষ্ট। বাকি সব সবাইকে নিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়ে দেয়ে কাটিয়ে দেব বাকিটা জীবন।
তখন টিভি ছিল একমাত্র দ্রষ্টব্য। প্রতিদিন দেখা যেত পৃথিবীজুড়ে লাশের স্তূপ, রোগীদের আর্তচিৎকার আর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহে নিদারুণ অসহায়ত্ব। কোনো কিছুতেই যেন বশে আনা যাচ্ছিল না করোনার অণুজীবকে। কোন কোন রাষ্ট্রের নিয়োজিত বাহিনী তো ঘরে ঘরে হানা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ধরে ধরে নিয়ে যেত আক্রান্তদের। পুড়িয়েও ফেলত কোনো কোনো খানে। উন্নত তাবত বাঘা বাঘা দেশের কোনো কিছুতেই চব্বিশ ঘণ্টার সেই উদ্দামতা ছিল না। নাইট ক্লাবগুলো যেন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। জুয়ার আসরগুলো ছিল বন্ধ। হোটেলে ছিল না কোনো পর্যটক। বীচগুলো পড়েছিল এতিমের মতো পরিত্যক্ত। তখন পৃথিবীর কোনো রাস্তায় কোনো গাড়িঘোড়া ছিল না। মানুষের চলাফেরা ছিল না। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতি অবলোকনে বণ্যপ্রাণীরা রাস্তার দখল নিয়েছিল। আকাশে পাখীদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা দিয়েছিল। বিমানগুলো বন্দরে বন্দরে পড়ে থেকে ভাঙারির মাল হয়ে যাচ্ছিল।
উপাসনালয়গুলো ছিল বন্ধ। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি আসত ঠিকই কিন্তু তাতেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তখন ‘হাইয়া আস সালাহ’ ধ্বনির পরিবর্তে দেওয়া হতো ‘আসসালাতু ফি বুয়ুতিকুম’। তখন ঘরে ঘরে ঈদের নামাজ আদায় করা হতো। সীমিত পরিসরে ফাঁক ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আদায় করা হতো নামাজ। বাবা চাচারাও এরূপ দেখেননি কোনো দিন। মনে হতো কেয়ামত বুঝি চাক্ষুষমান হতে চলেছে।
আমাদের অবস্থা ছিল করুণ। এই অণুজীবকে মোকাবিলা করার কোনো তরিকা আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল না। ডাক্তাররা ছিল ভীত, তাদের ছিল না পিপিই। হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ ছিল না, ছিল না অক্সিজেন । কবরখানায় জানাজায় ছিল না মুসল্লি। শহরের বুক চিড়ে ক্ষণে ক্ষণে সাইরেন বাজিয়ে চলা অ্যাম্বুলেন্স যেন ছিল মূর্তিমান আতংক। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা, মার্কেট-দোকানপাট ফেলে চাচা আপন জান বাঁচা দর্শনে ছিল লা-পাত্তা। তখন দৈনন্দিন এরূপ চিত্রই ছিল স্বাভাবিক। এর বিপরীতে আবিষ্কৃত হলো কতিপয় ডাক্তারের অসাধুতার সচিত্র প্রমাণক, ভ্যাক্সিন ও ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেট নিয়ে নির্মম শঠতা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রণোদনার টাকা নিয়ে নানা কথা, ব্যবসায়ীদের মুনাফা লিপ্সা, সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ও আশীর্বাদপুষ্টদের আত্মসাৎ ও আত্মীয়করণের চিরচেনা কাহিনি।
তখন একটা কবিতা খুব বেশি ভাইরাল হয়েছিল। বেশিরভাগ লোকই ভুলভাবে এই কবিতাটা জীবনানন্দ দাসের নামে ছেপেছিল। অথচ তা জীবনানন্দ দাসের ছিল না। জীবনানন্দীয় ধাঁচে লেখা কবিতাটা ছিল মূলত: পার্থ মুখার্জির। কবি মন দেখতে চেয়েছিলেন মহামারি শেষে আমাদের আবার দেখা হোক জিতে ফিরে এসে, জীবানু হেরে গিয়ে ঘুমোলে, কান্নার ওপারে, সবুজ সকালে সুখের শহরে আগের মতো। আশাবাদী কবি অন্তরে যা ধারণ করেছিলেন তা কোটি কোটি মানুষের প্রাণের কথা ছিল। কিন্তু যতই পরিস্থিতি অনুকূলে আসতে শুরু করল ততই আমরা সস্থানে পুনর্বহালের প্রতিযোগিতায় শরিক হয়ে গেলাম। এক সময় ভুলেই গিয়েছি যে, একটা সময় করোনার মতো মৃত্যু দানব নিয়ে আমাদের বসবাস ছিল।
কবির মনস্কামনা অনুযায়ী, আমাদের এখন আর সেভাবে দেখা হয় না। আমাদের দেখা হয় স্বার্থ পকেটে রেখে। মানবিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। বৈষম্যের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছায় না। অন্যের আমানতে আমাদের ছিনতাইয়ের হাত পড়ছে অহরহ। হক নাশে আমাদের হৃদয় এতটুকু কেঁপে ওঠে না। প্রবঞ্চনা, জোচ্চুরি আর শঠতায় আমরা নিত্যনতুন সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছি। ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করতে আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। হত্যা, ধর্ষণ, পরকীয়ায় আমাদের রুচি আরও ভয়ানক হচ্ছে। সামান্য বিত্ত-বৈভব প্রাপ্তি আর পদ-পদবির লোভে আমরা ফেউ হয়ে ঘুরতেও লজ্জাবোধ করি না। মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করে একই কোরাস গীত গেয়ে চলেছি, যাতে সত্য অপসারিত হয়, মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়। লাজ-লজ্জা-বেহায়াপনার রেকর্ড ভঙ্গ করতে যেন আমরা উঠেপড়ে লেগেছি। ধর্ম আমাদের মোটেই ভীত করে না। আমাদের হৃদয়কে প্রশস্ত করে না। দান মেরে, গলা কেটে, পাচার, জোরজুলুম, জোচ্চুরি ইত্যাদি করে পবিত্র তীর্থস্থান দর্শন করে এলেই জীবনের ডেবিট-ক্রেডিটের ব্যালান্স অনুকূলে থাকবে বলে গভীর বিশ্বাসও জন্মেছে আজকাল। কিসে আমাদের তৃপ্তি, কিসে আমাদের মুক্তি, আমরা কি রেখে কি করব তাও জানি না। দৌড়ানোর নামই যেন জীবন। থামা মানেই পিছিয়ে পড়া। আর রেস থেকে নাম সরিয়ে নেওয়ার অর্থই হলো হেরে যাওয়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, অন্যদের ভোগের মধ্যে চলে যাওয়া।
জীবনানন্দ দাস তার কবিতায় এমনটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন। যারা অন্ধ আজ তারাই সবচেয়ে বেশি দেখে, যাদের হৃদয়ে প্রেম-প্রীতি আর করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী আজ অচল যেন তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। অন্যদিকে মানুষের প্রতি যাদের গভীর আস্থা রয়েছে, আজও যাদের স্বাভাবিক বলে মনে হয় তাদের হৃদয় যেন আজ শেয়াল-কুকুরের খাদ্য। কি চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী!
করোনা এসেছিল। যাকে পেয়েছে তাকেই ছুঁয়ে তুলে নিয়ে গেছে পরপারে। যাদের রেখে গেছে তারা করোনার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে বেঁচে আছে। পৃথিবীতে আজ তারাই নতুন নতুন বচন আর ছবক দিয়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবী অচল আজ এদের ছাড়া। আসলে আমাদের কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। আমরা যেন করোনার কেরিয়ার সদৃশ মানবাকৃতির দানব।
আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
মন্তব্য করুন