নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কষ্টে থাকলেও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অঞ্চল তার নির্বাচনী এলাকার মানুষ বেশ ভালো আছে বলে দাবি করেছেন একজন মন্ত্রী। সেই ভালো থাকার ‘প্রমাণ’ ফ্যাশনে পড়েছে বলেও মনে করেন তিনি। দাবি করেছেন, তার এলাকার নারীরা এখন ‘লিপস্টিকে মন দিয়েছে।’
মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, “আমার এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, আলুভিত্তিক অর্থনীতি। লোকজনের কোনো কষ্ট নেই। মহিলারা দিনে তিনবার করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে, চারবার করে স্যান্ডেল পাল্টাচ্ছে।”
মন্ত্রীর এহেন বক্তব্যের সমালোচনা করছেন নেটেজেনরা। বেশি লিপস্টিক ব্যবহারের কারণে মন্ত্রীর কাছ থেকে খোঁটা শুনতে হল বলে কেউ কেউ গোঁসা করেছেন। আবার নারীবাদীরা একে দেখছেন অপমান হিসেবে। সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ সরগরম।
অথচ মন্ত্রীর এই দূরদর্শী বক্তব্য শুনে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। শুধু তাই না, তার পড়াশোনার গণ্ডি যে কতটা বিস্তর সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না আমার। তিনি আসলে প্রকারান্তরে এটাই বলতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! সেটা বলতে গিয়ে এমন এক উপমা ব্যবহার করেছেন, যা সাধারণের বোধগম্যের বাইরে। কীভাবে? অর্থনীতির নগণ্য ছাত্র হিসেবে অর্থনীতিরই প্রচলিত থিউরি দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা যাক।
অর্থনীতিতে যখন প্রবল মন্দাভাব দেখা দেয় এবং হাতে নগদ টাকার অভাবে মানুষ দামি জিনিসপত্র কিনতে পারে না, তখন নিজেদের মনমেজাজ ঠিক রাখার জন্য সস্তা বা কম দামি জিনিস কেনার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। আর এটা কে না জানে যে, কেনাকাটার প্রতি পুরুষের তুলনায় নারীদের ঝোঁক বেশি থাকে। মূলত: এ রকম এক পরিস্থিতিকেই ‘লিপস্টিক থিউরি’ বা ‘অর্থনীতিতে লিপস্টিক প্রভাব’ বলা হয়। ইংরেজিতে বলে lipstick effect to economy. বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি এস্টি লউডারের প্রধান লিওনার্দো লউডার ২০০১ সালে এই থিউরি প্রবর্তন করেন। ২০০১ সালে অর্থনীতিতে প্রবল মন্দার সময় তার কোম্পানির উৎপাদিত লিপস্টিক বিক্রির পরিমাণ ১১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
২০০১ সালে আমেরিকার টুইন-টাওয়ারে হামলার পর সেখানকার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, মানুষজন নিদারুণ মন্দায় পতিত হয়। দামি জিনিস কেনার সক্ষমতা হারায়। কিন্তু কেনাকাটা এমন এক বিষয়, যেখান থেকে হুট করে সরে আসা যায় না। ফলে সে অবস্থা থেকে নিজেদের মনোযোগ সরাতে তারা সস্তা জিনিস কেনার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। শুধু তাই না, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সালের মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও লিপস্টিক কেনায় ধুম পড়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ-পরবর্তীতে আমেরিকায় লিপস্টিক বিক্রির পরিমাণ বেড়েছিল ৪৪ শতাংশের মতো। লিপস্টিক থিউরির অন্য ব্যাখ্যা হলো, মানুষ অন্তর্গতভাবে খারাপ থাকলেও লিপস্টিকের মতো চাকচিক্য কিন্তু কম দামি জিনিস ব্যবহার করে নিজের খারাপ অবস্থা প্রাথমিকভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
খেয়াল করে দেখবেন, নারীরা তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হতে গেলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কোনও মিটিংয়ে ঢোকার আগে চুলে দ্রুত চিরুনি চালিয়ে নেয়। হাল্কা করে ঠোঁটে লিপস্টিক টেনে দেয়। এতে তার অন্যান্য অগোছালো অবস্থা বা চেহারার অবসাদ সহজে ঢাকা পড়ে যায়। গবেষণায় এটিও দেখা গেছে যে, লিপস্টিক যত উজ্জ্বল রঙের হয়, বিষাদ বা অবসাদ তত বেশি ঢেকে রাখা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কাজ করে লাল রঙের লিপস্টিক! এতে কেউ যখন কারো দিকে প্রথমবারের মতো তাকায়, তখন তার সমস্ত মনোযোগ ঠোঁটে চলে যায় এবং চেহারায় বা পোশাকে ফুটে ওঠা অন্য দুর্বলতাসমূহ ঢাকা পড়ে যায়। অবশ্য আমাদের মন্ত্রী এটা বলেননি যে, তার এলাকার নারীরা ঠিক কোন রঙের লিপস্টিক বেশি ব্যবহার করছেন।
একইভাবে স্যান্ডেলের থিউরিও সত্য। এটিও অর্থনীতিতে মন্দার সাথে সম্পর্কিত।
দেশে মন্দা শুরু হলে কাজের অভাব কমে। বেকারের সংখ্যা বাড়ে। পূর্বে থেকে কাজে থাকা লোকজনও নতুন করে চাকরি হারায়। ফলে বেকাররা চাকরি খুঁজতে শুরু করে। নানা জায়গায় ধরনা দিতে হয় বলে লোকজনকে প্রচুর হাঁটতে হয়। এতে স্যান্ডেলের ক্ষয় হয় এবং ঘনঘন স্যান্ডেল পাল্টাতে হয়।
এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন যে, আমাদের মন্ত্রীর বক্তব্য কতখানি দূরদর্শী। বরং এটি আমাদেরই দুর্ভাগ্য যে পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবে ওনার বক্তব্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি।
কতখানি শিক্ষার অভাব আমাদের! ভাবা যায়?
রাজু নূরুল : উন্নয়ন সংগঠক, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে উন্নয়ন নীতিপরামর্শ বিষয়ে অধ্যয়নরত
মন্তব্য করুন