দেশে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। উন্নয়ন এখন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারও কাছে উন্নয়ন দৃশ্যমান। কারও কাছে তা বাহুল্যপূর্ণ। সর্ব বিষয়ে আমাদের এই আপাতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছে বিভাজন। গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, শিবির, জোট, মহাজোট ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত হচ্ছে আমাদের মানব পরিচয়। আমরাই আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে জমাটবদ্ধ করতে ভালোবাসি। ফলত: পাশাপাশি থেকেও আমরা আলাদা আলাদা জীবনযাপনে সিদ্ধ হয়ে পড়ছি। একের দাহ আমাদের স্পর্শ করে না। অন্যের যাতনা আমাদের ক্লিষ্ট করে না।
অন্যের আনন্দে আমাদের বুক ভাঙে। আমার জয়ে অন্যে বুকে কষ্ট পেয়ে থাকে। সব কিছুতেই আমরা পাটিগণিতের ব্র্যাকেট বসিয়ে দিতে ভালোবাসি। তাই ‘আমরা আর মামুরা’ ছাড়া কোনো কিছুই ভাবতে পারি না। আর এই সমাজচিত্রের বেশিরভাগজুড়েই রয়েছে গোষ্ঠী-প্রীতির সংস্কৃতি। আমাকে বাঁচতে হলে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করেই বাঁচতে হবে- এই ধরনের কর্কট রোগে আমাদের পেয়ে বসেছে।
আমাদের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভাজনের ফলে জাতীয় ইস্যুতে আমাদের কোনো ঐকমত্য নেই। আছে উপেক্ষার কদর্য প্রতিশোধ। অপরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েই যেন আমাদের শান্তি। অন্যের উত্তম কিছুকে মেনে নিতে আমরা একেবারেই অপারগ। বিরোধিতাই যেন আমাদের একমাত্র বিকল্প। ফলত: পরস্পরবিরোধীদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আমাদের জাতিসত্তাকে করছে কলংকিত ও দুর্বল। আমাদের উন্নয়ন অভিধায় সবার অংশগ্রহণ নেই। আমরা নিজেরাই একে আন্তর্জাতিক সীমারেখার মতো সীমানাবদ্ধ করে রেখেছি।
বিরোধিতার কারণেই বিরোধিতা করা আমাদের কাছে এখন প্রাথমিক ও একমাত্র দীক্ষা হয়ে গেছে। এই মনস্তত্ব থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না কিছুতেই। আমরা ব্র্যাকেটবন্দি হয়েই থাকতে ভালোবাসি। যেন এটাই আমাদের নিরাপদ বলয়।
আমরা কাউকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে ভুলে গেছি। কারও একক উৎকর্ষ সাধনে গোষ্ঠীর লেজুড় জুড়ে দিয়ে যেন শান্তি পাই। যেন এই একক কৃতিত্ব সম্ভব হয়েছে শুধু গোষ্ঠীর মাহাত্ম্যে। ফলে একক কৃতিত্বের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যায়। ব্যক্তির, প্রতিভার ভবিষ্যৎ অংকুরোদগম আর সেভাবে হয় না। হতাশা বোধ নতুবা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বীকৃতির লোলুপতা পেয়ে বসে। সময় বা কালকেও আমরা নিস্তার দেই না। আমাদের কালে এমন হয়েছে, আমরা এই করেছি, সেই করেছি- এরূপ ফলাও প্রচারের টার্গেট শুধু প্রতিপক্ষকে হেয় করা বা ঘায়েল করা। তা মোটেই প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে উৎসারিত নয়।
দেশের উন্নয়নে দশের তথা সবার অংশগ্রহণের যে সুযোগ অবারিত থাকার কথা তা আমরা ভুলে যাই। কোনোকিছু শুরু করার আগেই আমরা তার সার্বিকতাকে প্রকল্পের মতো টার্গেট গ্রুপে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। যাতে করে এর সুবিধা বা সুঘ্রাণ টার্গেট গ্রুপের বাইরে থাকা লোকদের মনে দাহ দেয়, খোঁটার যাতনা দেয়। আমরাই কেবল ভালো কিছু করি, অন্যরা লুটেরা বা হায়েনা- এই তকমা সেঁটে আমরা পরস্পরের প্রতি একধরনের জিঘাংসা ও আস্থাহীনতার জন্ম দিয়ে থাকি।
বিভাজন আমাদের আজ এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, আমরা উদারতা, মানবিকতা, সার্বজনীনতার প্রকৃত অর্থ ভুলে গেছি বা কদর্থ করছি। এর জের এখন সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনভাবে প্রোথিত যে, আমরা এর বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি বা চিত্তবৈকল্যে ভুগছি।
দশ বন্ধু একত্রে জড়ো হলে আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে হয়তো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করার চেষ্টা করি আমাদের মধ্যে কারা কারা শহুরে শিক্ষিত, কারা ক্যাডেট বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছবকপ্রাপ্ত। কারা আশরাফ, কারা অতরাফ। কারা ইংলিশ আভিজাত্যে আর কারা বাংলা মিডিয়ামের স্মেল নিয়ে বেড়ে উঠেছি। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তালাশ করি কাদের শিক্ষার ব্যাকগ্রাউন্ড কারিগরি, কাদের ডাক্তারি, কাদের সামাজিকবিজ্ঞানে, কাদের সাধারণ কলায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাজন তো আছেই। কে কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টুয়িংকল স্টার আর কে কে প্রাইভেটের অনুজ্জ্বল তারা। ব্যস! শুরু হয়ে গেল বিভাজনের পদধ্বনি। আর রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলে তো অংকুরোদগমন পর্যায়েই তা মুখ থুবড়ে পড়বে।
দশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব ঔৎসুক্য নিয়ে অচিরেই তাতে দেখা দিবে ফাংশনাল সম্পর্কের হাই-হ্যালো। যা হতে পারত দশের শক্তি তা আপনাআপনি বিভাজিত হয়ে অদৃশ্য বা দৃশ্যমান অন্তত দুটি ফেডারেশনে, ন্যূনপক্ষে তিন-চার সিন্ডিকেটে এবং একই ছাতার নিচে কমপক্ষে ছয়-সাত মিনি সার্কেলে পরিণত হয়ে যাবে। এভাবেই সম্মিলিত উদ্যোগ শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আমরা তো স্বল্পমেয়াদি কোনোকিছুতেই স্থির থাকতে পারি না। দীর্ঘমেয়াদি বিষয় তো বহুত দূর কা বাত।
কথায় আছে, দশের লাঠি একের বোঝা। তা প্রবাদ। বাস্তবপ্রদ নয়। আমরা ইম্প্রোভাইজ করে তাতে আংশিক সংশোধনী এনেছি। দশ এখন আর সার্বজনীন গাণিতিক সংখ্যামাত্র না। তা এখন একইরূপ বা গোত্রের জোট আবদ্ধ সমজাতীয় সংখ্যা নির্দেশক। এই ফর্মূলা মেনে যাবতীয় কাটাকুটি শেষে হয়তো উত্তর ইতি বা নেতি বা শূন্য বাচক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এভাবে উন্নয়ন যাত্রা টেকসই হয় না।
দেশ সবার ওপর। এর সম্পদে সবার অংশ রয়েছে। তাই এর দেখভালে সবার মতামতের অধিকার রয়েছে। এর মাধ্যমেই উন্নয়ন-ভোগ তৃপ্তিকর হতে পারে। ব্যক্তি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। তবে তা দেশ ও জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করে নয়। শুধু মুখে উপ্ত বাক্য দিয়ে কথার ফুলঝুরি হয়তো হবে, তবে তা ক্ষণিক বাদেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে বাসি ফুলের কটু গন্ধ আর পোকামাকড়ের দংশনে।
দীর্ঘ বন্ধুর পথের অভীষ্ট অর্জনে চারপাশের কণ্টকাকীর্ণ বাধা সরিয়ে সম্মুখবর্তী হতে সবার সহিষ্ণুতা আর বিবেকের আলোকছটা দরকার। সবাই পারে, আমরাও পারব- এই ঐকান্তিক ইচ্ছাটাই জরুরি। রবী বাবু প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে’? তার উত্তরটাও তিনি দিয়ে গেছেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’। স্থির প্রত্যাশার এই মর্মবাণীই হতে পারে আমাদের চালিকাশক্তি।
আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন