সাম্য, স্বাধীনতা ও বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স। ছবির দেশ, কবিতার দেশ। অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় এক দেশ ফ্রান্স। ১৯৭২ সাল থেকে বিভিন্ন সরকারের সময় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। মর্ত্যের অমরাবতী প্যারিস মহানগরীর ১০৯, এভিনিউ হেনরি মার্টিন, ৭৫০১৬- এ বাংলাদেশের দূতাবাস অবস্থিত। ২০১৯ সালে দূতাবাসে যুক্ত হলো ডিফেন্স বা প্রতিরক্ষা উইং। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্যারিস সফরের সময় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ (আগ্রহপত্র)। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এই মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ভবিষ্যতে দুই দেশের সামরিক-কৌশলগত সম্পর্ক ও সামরিক কূটনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
২০২৩ এর ১০-১১ সেপ্টেম্বরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ১৮ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে এসে বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করে গেলেন। এই তরুণ ফরাসি রাষ্ট্রনায়ক মুগ্ধ নয়নে দেখলেন- বন্ধুত্বপূর্ণ, সম্ভাবনাময়, সংস্কৃতিবান, উদার, ধর্মপ্রাণ, রেজিলিয়েন্ট ও সংগ্রামী মানুষের বাংলাদেশ। তুরাগ-সেইন নদী, ঢাকা প্যারিস মহানগরী বন্ধুত্ব, শুভেচ্ছা ও কল্যাণকামিতায় যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। খুলে গেল দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্কের স্বর্ণালি দুয়ার।
দীর্ঘদিন ধরে নেপোলিয়ন ও দ্য গলের দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, ফ্রান্স-বাংলাদেশের সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে অধিকতর সহযোগিতা এখন সময়ের দাবি। এই লেখায় মূলত ফ্রান্স-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও সহায়তার সামরিক-কৌশলগত কিছু দিকের ওপর আলোকপাত করা হবে।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকায় ১৮ ঘণ্টার সফরটি ছিল কর্মচাঞ্চল্যময়। সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল : প্রেসিডেন্টের সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত নৈশ ভোজ, ‘জলের গান’-এর সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দের গান শোনা, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শনে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, শীর্ষ বৈঠক ও তুরাগ নদ বা কহর দরিয়া ভ্রমণ...।
ফ্রান্স-বাংলাদেশ সম্পর্ক : ইতিহাসের সুলুক সন্ধানে
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই সৌহার্দ্যপূর্ণ। সুদূর অতীতেই এ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ফরাসিরা সপ্তদশ শতাব্দীতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রথম ঢাকা শহর এবং দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকায় সম্পর্ক স্থাপন করেন। সেসময় ব্রিটিশদের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ব্রিটিশ বাহিনীর (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) সঙ্গে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেদিন নবাবের সহায়তায় হাত বাড়িয়েছিল এক দল ফরাসি সৈনিক। তখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীতে (তোপ) ফরাসি অধিনায়ক সাঁ ফ্রের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মতো ফরাসি সৈন্য ছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে সাঁ ফ্রেঁর অধীনে গোলন্দাজ বাহিনী ৪০টি কামান দিয়ে ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে চলেছিল। ইংরেজদের ছিল ৮টি কামান। লর্ড ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেন ‘(আম্রকুঞ্জে) আমাদের সুবিধাজনক অবস্থান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। তাদের (নবাবের গোলন্দাজদের) কামান স্তব্ধ করে দেওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল’। ফরাসি গোলন্দাজদের সহায়তায় নবাবের বাহিনী যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে। ঠিক সেই সময়ে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় ও চক্রান্তের কারণে যুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ফরাসিদের অবদান চিরস্মরণীয়। ফরাসি সরকার নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। বিখ্যাত ফরাসি ব্যক্তিত্ব, লেখক ও চিন্তাবিদ আঁদ্রে মালরো মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার তাগিদে সুদূর ফ্রান্স থেকে ভারতে ছুটে এসেছিলেন। এই চিরকালের মুক্তিযোদ্ধা ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। মালরো বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে এক ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’ গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। ১৯৭৩ সালে আঁদ্রে মালরো ছুটে আসেন তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। তিনি দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জঁ ক্যা নামে একজন মানবতাবাদী ফরাসি যুবক ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশি শরণার্থীদের ওষুধ ও চিকিৎসসামগ্রীর দাবিতে একটি পাকিস্তানি বিমান (পিআইএ) ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে বিষয়টির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ঘটনার পর ফরাসি সরকার বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরে ২০ টন ওষুধ আর চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আঁদ্রে মালরোসহ বেশ কয়েকজন ফরাসি নাগরিককে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
ফ্রান্স-বাংলাদেশ সম্পর্ক ১৯৭২-২০২৩
বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ফ্রান্স সরকার সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর পরের মাসেই, ১৭ মার্চে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফ্রান্সে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন আবুল ফাতাহ।
বিগত ৫০ বছরে দুদেশের মধ্যে বেশ কিছু উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে ফ্রান্স সফর করেন। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তিনবার ফ্রান্স সফর করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরাসি বিপ্লবের ২০০তম বার্ষিকীতে যোগদান। ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সফরে প্যারিসে যান। এর ২২ বছর পর ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার ফ্রান্স সফর করেন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ৩টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। মন্ত্রিপর্যায়েও বেশ কটি সফর দুদেশেই হয়েছে যার মধ্যে ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লির ২০২০ সালের ঢাকা সফর উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উৎযাপিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া মিতেরাঁর ঢাকা সফর ও বন্যা-কূটনীতি
প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করেন। এই সময় বন্যার স্থায়ী সমাধান নিয়ে মিতেরাঁর ভূমিকা এবং বাংলাদেশ সরকারের বন্যা-কূটনীতি নিয়ে মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হয়েছিল। এই সফর নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক কাজী জওয়াদ লিখেছিলেন- ‘মিতেরাঁর ঢাকা সফর, বন্যা-কূটনীতির সাফল্য’।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ভয়ংকর বন্যার কবলে পতিত হয়েছিল। বন্যার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ফ্রান্সের ‘ফাস্ট লেডি’ মাদাম দানিয়েল মিতেরাঁ ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ঢাকায় আসেন। সফরকালে বন্যা দুর্গত এলাকার অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতি দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হন।
মাদাম মিতেরাঁ ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা জাক আতালি ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁকে এবং সরকারের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা জানান। বন্যাকবলিত মানুষের কষ্টে সমাজতান্ত্রিক এই ফরাসি প্রেসিডেন্ট বিচলিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন। এই বিশ্ব নেতা তখন বাংলাদেশের বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নিজেই নেমে পড়েন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কোনো বিশ্বনেতার এমন ঘটনা বিরল। বন্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনের লক্ষ্যে ফরাসি উদ্যোগ শুরু হয়। ফরাসি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের নদীব্যবস্থা ও বন্যার ওপর সমীক্ষা চালান। একটি বন্যা পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়।
মিতেরাঁ নিজে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বন্যা পরিকল্পনা নিয়ে এলেও পরবর্তী পর্যায়ে পরিবেশবাদী ও ইকোলজিস্টদের বিরোধিতার জন্য এই পরিকল্পনা পুরাপুরি বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানা যায়। যা প্রেসিডেন্টে মিতেরাঁর জন্য একটি হতাশাজনক বিষয় ছিল। স্মৃতিগ্রন্থে এমনটাই লিখেছেন সেই সময়ে ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে এম শেহাবউদ্দিন (দেয়ার অ্যান্ড ব্যাক এগেইন এ ডিপলোমেটস টেল)।
নতুন পর্যায়ের সম্পর্ক
ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ১২ সেপ্টেম্বর যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথাই বলেছেন। এদিন দুই নেতার উপস্থিতিতে ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে দুটি চুক্তিও সই হয়েছে। চুক্তিগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়নে ২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা ও ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি। এ ছাড়াও এয়ারবাস কোম্পানি থেকে ১০টি বিমান ক্রয়ের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিও উল্লেখ আছে এই বিবৃতিতে।
ফ্রান্স-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক
সামরিক ক্ষেত্রে ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিময় অবশ্য এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সাম্প্রতিককালে এ ক্ষেত্রে গতি ও যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর দুপক্ষের মধ্যে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ (আগ্রহপত্র) স্বাক্ষরের আগে ও পরে সামরিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাড়ছে ও বিভিন্ন কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে। ভবিষ্যতে সামরিক কূটনীতির ক্ষেত্রটি প্রসারিত হওয়ার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
১৯৭২ সালে একদল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। সাবেক সেনাপ্রধান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীরবিক্রমের মধ্যে অন্যতম।
প্যারিসের আইকনিক আইফেল টাওয়ারের কিছুটা দক্ষিণ পূর্বে পাবলিক গ্রিন স্পেস ‘চ্যাম্প দ্য মারস’ (যুদ্ধ দেবতার মাঠ) অবস্থিত। এর পাশেই বিখ্যাত ‘যুদ্ধ জয়ের প্রতিষ্ঠান’ ইকোলে মিলিটেয়ার। ১৯৮০ দশকের মধ্যভাগে ফ্রান্সের এই ঐতিহ্যবাহী সামরিক প্রতিষ্ঠানে (ইকোলে মিলিটেয়ার) উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য (ওয়ার কোর্স) তৎকালীন উইং কমান্ডার জামাল উদ্দিন আহমেদ (পরে এয়ার মার্শাল ও বিমানবাহিনী প্রধান) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন : এডমিরাল মোহম্মদ নিজামউদ্দিন আহমেদ, সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ও লে. জেনারেল আবদুল হাফিজ, সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অফ জেনারেল স্টাফ। দীর্ঘ বিরতির পর বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছেন। উল্লেখ্য, ১৯৯২-৯৩ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীর মেজর উইলি লালাওস বাংলাদেশের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২০২০ সালের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সামরিক প্রতিনিধি দল (ডেলিগেশন) সফর করেছেন। ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি ২০২০ সালে ঢাকা সফর করেন। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ‘ইন্দো প্যাসিফিক’ সেমিনারে বাংলাদেশের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত সেমিনার ‘ইমার্জিং বাংলাদেশ ’-এ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, ফ্রান্সে বাংলাদেশের নাগরিক ও ফ্রান্সের সিভিল সোসাইটির সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি টিম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সেনাবাহিনীর একটি দল ফ্রান্সে ‘ওয়ার গেম এক্সাসাইজ’-এ অংশ নিয়েছে। জানা যায়, ফ্রান্স বাংলাদেশ পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা- ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্রয়ের (মিলিটারি হার্ডওয়ার) ধরন, মান, সংখ্যা ও উৎসের পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ তার অস্ত্র সরঞ্জামাদির ক্রয়ের প্রধান উৎস দেশ চীনের ওপর নির্ভতা কমিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের (ন্যাটো সদস্য) দেশ থেকে অস্ত্র সরঞ্জামাদি কিনছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মিলিটারি হার্ডওয়ার ক্রয়ের উৎস বহুমুখীকরণ করছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইটালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও তুরস্কের মতো দেশগুলোও বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধির আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, ফ্রান্সও এগিয়ে এসেছে। ফ্রান্স ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম, কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট, সামরিক যান এবং কিছু কমবেট ইঞ্জিনিয়ারিং ইকুয়েপমেন্ট সরবরাহ করেছে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্মের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ‘ফ্রেঞ্চ কানেকশন’ রয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর (কিলো ফ্লাইট) পরিচালিত অন্যতম প্রথম মিশনটি পরিচালিত হয়েছিল (ভারত- সরবরাহকৃত) ফ্রান্সের একটি এলুয়েট-৩ হেলিকপ্টার দিয়ে। ভারতের ত্রিপুরা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল, বিমানবাহিনীর প্রধান, বীর উত্তম) ও ফ্লাইট লে. বদরুল আলম (পরে স্কোয়াড্রন লিডার, বীর উত্তম) একটি এলুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেল শোধনাগার ধ্বংস করেন। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে এলুয়েট হেলিকপ্টারটি পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধন করেছিল।
ফ্রান্স থেকে রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের বিষয়টি মিডিয়াতে আলোচিত হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে যখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান (মালটি রোল ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট) কিনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছিল এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রস্তাব এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। ফ্রান্স তাদের রাফায়েল যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের কাছে বিক্রির আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনার জন্য ২০২০ সালে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরও করেছিলেন। এ ব্যাপারে ফ্রান্সের এখনো যথেষ্ট আগ্রহ ও উৎসাহ আছে।
২০২৩ এর জুলাই মাসে ফ্রান্সের যুদ্ধ জাহাজ ‘এফএস সারকওফ’-এক শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ও যৌথ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। রিয়ার এডমিরাল ইমানুয়েল স্লারস্, (চিফ অফ ফ্রেন্চ জয়েন্ট ফোর্সেস, ইন্ডিয়ান ওশান) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফ্রান্স বাংলাদেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী । উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রগ্রাফিক সামর্থ্য বাড়াতে ফ্রান্স সহায়তা করেছিল। এডমিরাল স্লারস লেবাননে (ভূমধ্যসাগরে) জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে (ইউনিফিল) মাল্টিন্যাশনাল মেরিটাইম টাস্ক ফোর্সের অংশ হিসেবে নিয়োজিত বাংলাদেশের যুদ্ধ জাহাজের (বিএনএস সংগ্রাম) দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করেন। যেখানে ফরাসি নৌবাহিনীও দায়িত্ব পালন করছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও নৌবাহিনী গঠনে ফ্রান্সের একটি অধ্যায় বেশ ইনটারেস্টিং। সেটি হলো, ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের তুলঁন বন্দরে প্রশিক্ষণরত একদল বাঙালি নৌসেনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। ১৯৭১ সালে তুলঁন পোতাশ্রয়ে ফ্রান্স এর তৈরি সাবমেরিন ‘পিএনএস ম্যাংগ্রো’-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন ১৩ জন তরুণ বাঙালি সাবমেরিনার। সাবমেরিনটি ৩১ মার্চ পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল। তরুণ বাঙালি নৌসেনারা ২৬ মার্চ বিবিসির সংবাদে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার খবর জানতে পারেন।
সেই পরিস্থিতিতে ৯ জন সাহসী সাবমেরিনার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ৩১ মার্চ তুলঁন ত্যাগ করেন ও জেনেভার দিকে ট্রেনে রওনা হন। বহু নাটকীয় ঘটনার পর আটজন নৌসেনা মধ্য এপ্রিলে ভারতে পৌঁছান। নৌ কমান্ডো গঠনের সিদ্ধান্ত হলে এই সাবমেরিনাররা প্রথমে প্রশিক্ষক হিসেবে ও পরে বিভিন্ন নৌঅভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ভগিরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী প্রান্তর। এখানে স্মৃতিখণ্ডে লেখা আছে ‘ব্যাটেল ফিল্ড অব পলাশী ১৭৫৭’। ১৯৭১ সালে, স্মৃতিখণ্ডের কাছেই ভাগীরথী নদীর পাড়ে স্থাপন করা হয় নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। দুর্ধর্ষ নৌ-কমান্ডো-মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্প থেকে বাংলার জলসীমায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক মরণঘাতী অভিযান পরিচালনা (অপারেশন জ্যাকপট) করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
পালিয়ে আসা সাবমেরিনারদের মধ্যে অন্যতম হলেন, কমডোর আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী, বীর উত্তম, বীর বিক্রম। উল্লেখ্য, গত ১১ সেপ্টেম্বর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা সাবমেরিনসাররা স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে একদিন যুক্ত হবে সাবমেরিন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারের পেকুয়ায় সাবমেরিন ঘাঁটি (বিএনএস শেখ হাসিনা) নির্মিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের যৌথ বিবৃতি
১১ সেপ্টেম্বর দুই নেতার মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে স্বাধীনভাবে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী ঢাকা ও প্যারিস। উভয় দেশের অংশীদারত্বকে কৌশলগত স্তরে নেওয়ার জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছেন দুই নেতা। ওই যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবরতনের সহায়তা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুপক্ষের সহযোগিতা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক সহযোগিতা
২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছিল। এই ব্যাপারে আবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসংক্রান্ত ‘লেটার অব ইনটেন্ট (আগ্রহপত্র)’ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ফ্রান্স বাংলাদেশকে তার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছিল। এই সমঝোতার আলোকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায় ফ্রান্স। এ ছাড়াও অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন- সমুদ্রের নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়েও দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
সব দেশের নিজস্ব কৌশলগত সার্বভৌমত্ব যাতে বজায় থাকে সে ব্যাপারেও দুই দেশ সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যাতে ফ্রান্সে বিভিন্ন স্তরে প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় সে জন্যও তারা দ্বার উন্মুক্ত করতে সম্মত হয়েছিল। এটি বাস্তবায়নে নতুন করে দৃষ্টি দেওয়ার আগ্রহ এবারের যৌথ ঘোষণায় আছে।
ফ্রান্স ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধানের ক্ষেত্রে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে ব্যাপারে তারা কাজ করতে প্রস্তুত আছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের যে পদক্ষেপগুলো আছে, যেমন—দ্য হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা চলছে, সে ব্যাপারে ফ্রান্সের পূর্ণ সমর্থন থাকবে এমনটিই বোঝা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ইতোপূর্বে ফ্রান্সের সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ। সমস্যার শুরুর দিকেই ফ্রান্স জাতিসংঘে বেশ কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন
ফরাসি প্রেসিডেন্ট আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিসংঘ মিশনে মোতায়েন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- ফ্রান্সের জাতিসংঘ ও শান্তি বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে আফ্রিকায় বাংলাদেশের অগ্রণী অবদানের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স জাতিসংঘ কার্যক্রমের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে এবং মিশনের আদেশ এবং প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটে তাদের বাস্তবায়নের বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ করতে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই নিবন্ধকার কম্বোডিয়ায় নিয়োজিত ফরাসি সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী ব্যাটালিয়ন (ফ্রেঞ্চ লিজিয়ন) ও ফরাসি পুলিশ (জান্ডামারি) এর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শান্তিমিশনে ফরাসি শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে কাজ করেছেন ও করছেন। ইউরোপের বসনিয়ায় বাংলাদেশ ও ফরাসি শান্তিসেনাদের সাক্ষাৎ হয় অন্য ভাবে। বসনিয়ার শান্তিরক্ষা মিশনে (আনপ্রফর) ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন (১০ ইস্ট বেঙ্গল) একটি ফরাসি ব্যাটালিয়ন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ‘বিহাচ পকেটের’ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই দিন চেবালিচি ক্যাম্পে সংক্ষিপ্ত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফ্রান্সের পতাকা নামিয়ে (জাতিসংঘের পতাকার পাশাপাশি) ইউরোপের বুকে বাংলাদেশের পতাকা উঠিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের বীর শান্তিরক্ষীরা।
আফ্রিকার আইভরি কোস্টে শান্তিরক্ষী মিশনের পটভূমিতে ‘ধুসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ নামে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন, কথাশিল্পী কাজী রাফি (মেজর কাজী জহিরুল ইসলাম)। এটি পাঠকদের নিয়ে যায় রোমান্সের ভিন্ন জগতে। আফ্রিকার আইভরি কোস্টে, ফরাসি সেনাবাহিনীর নারী অফিসার এলমা আর বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নের শান্তিরক্ষী অথৈ। এই গ্রহের ছোট ছোট ক্ষতগুলোকে হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে সারাতে গিয়েই অথৈ জলে জড়িয়ে যায় লাস্যময়ী ফরাসিনি এলমার সঙ্গে।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল
ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে খুবই সক্রিয়। ফ্রান্স হলো একমাত্র ইউরোপীয় দেশ, যার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজস্ব টেরিটরি রয়েছে। যেখানে প্রায় ৮,০০০ ফরাসি সৈন্যও অবস্থান করছে। ফ্রান্স নিজস্ব কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে ২০১৮ সালে। ফ্রান্সের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্র প্রকাশের পর ২০২০ সালে এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনার জন্য প্যারিসে সভা আহ্বান করা হয়েছিল। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন থিংক ট্যাংক বিআইপিএসএসের সভাপতি, মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (অব.)। এই বিষয়ে তিনি বলেন- ফ্রান্স সব সময় মনে করছে, ইন্দো-প্যাসিফিক তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল। তারা বলে আসছে, ভারত মহাসাগরে তারা একটি রেসিডেন্ট পাওয়ার বা স্থায়ী শক্তি। বর্তমানে তারা এ অঞ্চলে তাদের ক্ষমতা বা প্রভাবের যে বলয় আছে তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। ফ্রান্স এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেছে। ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
উল্লেখ্য বিশ্বে এ পর্যন্ত যে দেশগুলি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বা দৃষ্টিভঙ্গী ঘোষণা করেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলছে। কৌশলগত পর্যালোচনায় ফ্রান্স বিভিন্ন সময় মনে করছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বর্তমানে যে ধরনের কৌশলগত টানাপড়েন চলছে, তার কারণে অনেক ক্ষুদ্র দেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ এসেছে এবং আরও আসতে পারে। ফ্রান্স এই অঞ্চলে ‘তৃতীয় সমাধান’ দেওয়ার দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। অন্য কোনো শক্তি যদি এখানে বলয় সৃষ্টির জন্য বেশি চাপ সৃষ্টি করে এবং সে কারণে কোনো দেশ যদি তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, তাদের সঙ্গে ফ্রান্স থাকবে।
মেরিটাইম নিরাপত্তা সহযোগিতা
প্রতিরক্ষাবিষয়ক সহযোগিতার আগ্রহপত্রে মেরিটাইম (সমুদ্রবিষয়ক) নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ও উল্লেখ আছে। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ একটি মেরিটাইম নেশন। ফ্রান্স বাংলাদেশকে মেরিটাইম নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করতে আগ্রহী। ২০২৩-এর জুলাই মাসে, একটি ফরাসি যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রামে যৌথ প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণ করে। ফ্রান্সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় অসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা বাহিনীও রয়েছে। বাংলাদেশ এসব বিষয়ে ধারণা নিতে পারে।
আফ্রিকা থেকে ফরাসি নজর এখন এশিয়ায়
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্স ও পশ্চিমা-বিরোধি মনোভাবের জন্য ফরাসিদের নজর এখন এশিয়ায়। প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ সাম্প্রতিককালে পাপুয়া নিউগিনি, নিউ ক্যালিডোনিয়া, ভানুয়াতু, শ্রীলংকা ও ভারত সফর করেছেন। এর আগে তিনি মঙ্গোলিয়া সফর করেন। এই আলোকে বলা যায়, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ফ্রান্সকে হয়তো অধিকতর সক্রিয় দেখা যাবে।
এমানুয়েল ম্যাখোঁ এমন সময় দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিলেন, যখন আফ্রিকার পশ্চিম অংশে ফ্রান্স বিরোধী গণজাগরণ চলছিল। আফ্রিকায় একটার পর একটা দেশে সামরিক অভুত্থান হচ্ছে। চাদ, গিনি, মালি, বুরকিনা, নাইজার এবং সর্বশেষ গ্যাবনে ক্যু হয়েছে। এ রকম প্রতিটি অভ্যুত্থানের একক বৈশিষ্ট্য- ফ্রান্স বিরোধিতা। এই অঞ্চলে ফ্রান্সের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য এখন ভাঙনের পথে। ফরাসিবিরোধী আন্দোলনের ফলে আফ্রিকায় চলমান শান্তিরক্ষী মিশনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের (প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম) বিরুদ্ধে যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে রাশিয়া ও চীন। আফ্রিকার দেশে দেশে ফরাসি ‘উপনিবেশবাদ’ বিরোধী চীনপন্থি/রাশিয়াপন্থি সরকারগুলো উত্থানের এই সময়ে ফ্রান্স চাইছে চীন বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিকে আরও উদ্যোগী হতে।
‘ফ্ল্যাগশিপ’ এই সফর নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা
ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই ‘ফ্ল্যাগশিপ’ ভিজিট নিয়ে দেশে-বিদেশে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কোন কোন গণমাধ্যম ফ্রান্সের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য (এয়ারবাস ও স্যাটেলাইট বিক্রয়) ও ভূ-রাজনৈতিকের (ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল) বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। এমানুয়েল ম্যাখোঁ মানবাধিকারের চেয়ে ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন- বলে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন দেশটির জিআইজিএ ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক জেসমিন লর্চ।
যৌথ ঘোষণায় ‘গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ও ঘাটতির বিষয়গুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও মানবাধিকার নিয়ে কোনো যৌথ অঙ্গীকার নেই’- এমন সমালোচনাও হয়েছে। এয়ার বাস ও দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ক্রয়ের যৌক্তিকতা ও মূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকার উচিত বিষয়োক্ত ক্রয়গুলো চূড়ান্তকরণের সময় মূল্যের বিষয়টি পুনঃবিবেচনা ও দরকষাকষি করা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্রান্স-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও সহায়তা
দুই দেশের মধ্যে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাতে নতুন নতুন মাত্রা (এয়ার বাস ও স্যাটেলাইট ক্রয়) যোগ করার চেষ্টা চলছে। ফ্রান্স বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য বিশেষত তৈরি পোশাকের। বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখতে হবে। বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নে ফ্রান্সের সহযোগিতাও রয়েছে।
১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর বাংলাদেশে সফরের মধ্য দিয়ে এই সহযোগিতার সূচনা হয়। সেই সফরে, ফ্রান্স বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ প্রকল্পে সাহায্য করে। বর্তমানে, বাংলাদেশে পানি শোধনাগার, পরিবেশ প্রকল্পসহ বেশ কটি ফরাসি প্রকল্প ও যৌথ ব্যবসা রয়েছে। উল্লেখ্য, ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (এএফডি) মাধ্যমে ফ্রান্স বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে থাকে। অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি, ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ প্রযুক্তি সহায়তাও (প্রথম স্যাটেলাইট-বঙ্গবন্ধু-১) পেয়েছে। আধুনিকতম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে।
বিগত ৫২ বছর ধরে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক বা ‘ক্রস কালচার’ রিলেশনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে ফরাসি ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে। ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারের জন্য আলিয়ঁস ফ্রঁসেস (১৯৫৯ থেকে) কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ফ্রেঞ্চ জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশ কিছু বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি ফরাসি ভাষা শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও তরুণদের মাঝে ফরাসি সংগীত, সিনেমা এবং দর্শন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
একই সঙ্গে, ফরাসি সমাজেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে ফ্রান্সে বাংলাদেশের ডায়াসপোরা কমিউনিটি (লক্ষাধিক) বড় হচ্ছে। ফ্রান্সে কর্মরত বাংলাদেশি একইসঙ্গে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে, সেইসঙ্গে দেশে রেমিটেন্সও পাঠাচ্ছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের এক উর্বরভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে, ফরাসি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বর্তমান ফরাসি প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আগ্রহ রয়েছে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য, বেসরকারি সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’-এর পানসি নৌকায় (ফ্লেচেডি অর) তুরাগ নদ বা কহর দরিয়া ভ্রমনকালে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জলবায়ু নিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশি ক্লাইমেট-বিশেষজ্ঞ/অ্যাক্টিভিস্টের ইনফর্মাল আলোচনা (জলবায়ু আড্ডা) হয়েছিল।
প্যারিসের খোলা জানালা
দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তনশীল গতিশীলতার মধ্যে কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে। অংশীদার হিসেবে পরস্পরকে পাশে চায় ঢাকা-প্যারিস। মোটা দাগে, একদিকে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে পৌঁছানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন (২০৪১) এবং অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের নির্ভরযোগ্য অংশীদার খোঁজার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এই সফরের মাধ্যমে।
এশিয়ার মধ্যে ভারত, চীন ও জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করেছে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করার প্রয়াসের মাধ্যমে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করছে ঢাকা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্যতম বড় শক্তি ফ্রান্স এবং একইসঙ্গে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ শক্তির একটি। ফলে প্যারিসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহজ হবে।
ইউরোপের যে কয়টি দেশে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন; ফ্রান্স তন্মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রত্যাশা, ফ্রান্স আরও বাংলাদেশি অভিবাসী গ্রহণে আগ্রহী হবে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশ হবে, তখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হতে ফ্রান্সের সাহায্য প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল রাখতে জিএসপি প্লাস স্কিমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ফ্রান্সকে আধুনিক কূটনীতির জন্মস্থান বলা হয়। বাংলাদেশের তরুন কূটনীতিকদের জন্য ফ্রান্সে কূটনীতি ও ফরাসি ভাষার প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয়েছে ফ্রান্স। এটি বাংলাদেশের জন্য চমৎকার সুযোগ। ফরাসি সরকার কালচারাল (সাংস্কৃতিক) ডিপ্লোমেসিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ এ বিষয়টি থেকে ধারণা নিতে পারে।
এই অঞ্চলে বর্তমানে ফ্রান্সের তেমন প্রভাব না থাকলেও ফ্রান্সের কূটনৈতিক সমর্থন আদায় করতে পারলে বাংলাদেশেরই লাভ। কারণ ফ্রান্স জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ফ্রান্স ভূরাজনৈতিক নানা বিষয়ে কাজ করছে, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। তাদের কূটনৈতিক সমর্থন বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
শেষের কবিতা
সর্বোপরি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, দুই দেশের ভেতর বর্তমানে যে ধরনের উচ্চপর্যায়ে আলাপ-আলোচনা ও সফর চলছে, ভবিষ্যতে তারা এগুলো আরো বৃদ্ধি করতে চায়। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের সম্পর্ক দুই দেশই সার্বিকভাবে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে চায়। এসব দিক বিবেচনা করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে হয়।
ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্র হয়তো খুব অল্প সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন হবে না। তবে এক্ষেত্রে শক্ত ভিত্তি তৈরি করলে ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে অবশ্যই সামরিক ক্ষেত্রে ক্রেডিবল ‘ডেটেরান্স’ অর্জন করতে হবে। ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশ এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সহায়তা করতে পারবে।
বাংলাদেশকে এই নতুন উন্নিত সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ভিশনারি, গতিশীল ও ইনোভেটিভ এপ্রোচ। ফ্রান্স বা যে কোনো দেশ থেকে এ ধরনের সুযোগ অন্বেষন ও গ্রহণ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় পূর্বক ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ (ইউনিফাইড অ্যাপ্রোচ) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের রাষ্ট্র প্রধান/সরকারপ্রধান পর্যায়ে সফরসহ অন্যান্য ফাংশনারি ও ওয়ার্কিং গ্রুপ পর্যায়ে সফর প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ সামরিক এক্সারসাইজ, নিরাপত্তা সংলাপ ও বিভিন্ন ধরনের বিনিময় কর্মসূচি। সর্বোপরি প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সদিচ্ছা।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরটি মাত্র আঠারো ঘণ্টার হলেও বাংলাদেশ-ফ্রান্সের সম্পর্ক উন্নয়নে ভবিষ্যতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই সম্পর্ক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশের কূটনীতিকদের কাজ করতে হবে। আশা করি, ফ্রান্সে বাংলাদেশের গতিশীল কূটনীতিকরা এই সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেবেন। দুই দেশের আগামী দিনের সম্পর্ক স্নাত হোক ফরাসি সৌরভে।
মো : বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, লেখক, গবেষক
মন্তব্য করুন