সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি, কোয়াড নিরাপত্তা সংলাপ এবং ভারত ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক পুনর্গঠনের পটভূমিতেই চীনের অনেকটা কাছে চলে এসেছে বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশ কীভাবে এবং কেন চীনের নৈকট্য লাভ করল? বাংলাদেশ এবং চীনের এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী বার্তা বহন করে?
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ২০১২ সাল। ওই বছর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতু মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিল। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগকে নিজের ওপর আঘাত হিসেবে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে চীনের সহায়তা চেয়েছিলেন।
৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি ২০২২ সালে উদ্বোধন করা হয়। পদ্মা সেতু এখন রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সংযুক্ত করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা চীনের আগে থেকেই ছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাংলাদেশে চীনের সেই কৌশলগত উপস্থিতি প্রসারিত করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে চীনকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এই বিশেষ আগ্রহের কারণ – ভারত এবং পশ্চিমা, বিশেষ করে আমেরিকান প্রকল্পগুলো ঋণ দেওয়ার জন্য যে ধরনের শর্ত আরোপ করে সেই তুলনায় চীনা ঋণের শর্ত একেবারেই কম। এ ছাড়া চীনা প্রকল্পগুলো তুলনামূলক লাভজনক হওয়ায় বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের কাছে তা বিশেষ পছন্দের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে চীনা প্রকল্পের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৬ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ যোগ দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, রেললাইন, রাস্তা, টানেল, বন্দর আধুনিকায়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নসহ ১৭টি প্রকল্পে চীনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে বলে জানা গেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্কও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫-২০১৯ মেয়াদে বাংলাদেশের অস্ত্র চাহিদার ৭৪ শতাংশ চীন থেকে আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে চীনের আরও কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের প্রতি যে নীতি অবলম্বন করেছে আমেরিকা তা ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছে বাংলাদেশি মানবাধিকার গোষ্ঠী, বিরোধী দল, জনসাধারণ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচকরা। তবে এখানেও সরকারকে সমর্থন করেছে চীন। এমনকি চীন বলেছে, বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে তারা। ২০২১ সালে যখন গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তখনও বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
বাইডেন যখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করেছিলেন, তখন সেই জোটে শরিক হওয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের যোগদানের স্পষ্ট বিরোধিতা করে চীন। চীন প্রকাশ্যে বলেছিল, ‘বাংলাদেশের উচিত ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা এবং ব্লকের রাজনীতি পরিহার করা’। চীনের এই শক্ত অবস্থান বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগদান থেকে নিরুৎসাহিত করে।
বাংলাদেশ পরবর্তীতে একটি নিরপেক্ষ জোটের ওপর ভিত্তি করে তার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রকাশ করেছে। সেখানে স্পষ্ট করা হয় যে- মার্কিন-চীন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো পক্ষ নিতে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রায়ই এক চীন নীতির পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেছে, যে নীতিতে বিশ্বাস করা হয় যে, তাইওয়ান চীনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি এমন একটি অবস্থান যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে তার ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করে থাকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচকরা বলছেন, বাংলাদেশের পরবর্তী শাসনব্যবস্থা চীনা মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাংলাদেশ এমন একটি শাসনব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নেই, নির্বাচন একটি লোক দেখানো ব্যাপার, বাক স্বাধীনতা সীমিত এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের আড়ালে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, সমগ্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মানুষ গণতন্ত্র এবং তাদের মানবাধিকারকে সম্মান করতে চায়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং উন্মুক্ত সংলাপের মাধ্যমে আমরা এমন একটি অঞ্চলের জন্য পথ প্রশস্ত করতে চাই যেটি কেবল স্থায়ীই নয় বরং সমৃদ্ধি লাভ করে।’
গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব হ্রাস করে বাংলাদেশ মূলত এমন একটি পক্ষ বেছে নিচ্ছে যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ-চীন কিছু প্রকল্প ভারতের জন্যও উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শেখ হাসিনার সরকার বারংবার ভারতকে জানিয়ে আসছে যে, চীন শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদার, নিরাপত্তা অংশীদার নয়। বাংলাদেশে চীনের অংশিদারিত্বের সম্প্রসারণ নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে চীনের নির্মিত অবকাঠামো ভারতকে উপকৃত করতে পারে বলেও জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ভারতের স্বার্থে বেশ ভালোভাবেই কাজ করছে। ভারত তার মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের স্থল ও জলপথ ব্যবহার করে। ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো হলে সেটা ভারতের জন্যও ভালো।’
বাংলাদেশে চীনা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের ফাঁদে ফেলে দিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমালোচকরা। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খানের মতে, বাংলাদেশ চীনা ঋণের ফাঁদে পড়বে এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, বাংলাদেশে বিনিয়োগের রিটার্ন তহবিল ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের একমাত্র বা প্রধান ঋণদাতা নয়। বাংলাদেশ তার ঋণের উৎসকে বহুমুখী করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৭২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের মধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমান ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, এরপর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, জাপান থেকে নেওয়া ঋণের পরিমান ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়া থেকে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, চীন থেকে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং ভারত থেকে নেওয়া ঋণের পরিমান ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আব্দুল মোমেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ চীনা বলয়ের মধ্যে আরও গভীর ভাবে ঢুকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুষ্ঠু নাও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং দেশের বিত্তশালী একটি শ্রেণির স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। ফলে সরকার হয়তো বেশি দিন যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলতে পারবে না। বাংলাদেশের চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই প্রয়োজন। কিন্তু এই দেশগুলোর মধ্যে একটি মাত্র দেশ বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের দিকে নিতে চাচ্ছে আর সেটি চীন নয়।
বাংলাদেশ তার পক্ষে পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। তবে বর্তমান সরকারের জন্য এ খেলায় জয়ী হওয়াটা কঠিন হতে পারে।
মোবাশ্বের হাসান : সিডনিভিত্তিক তাত্ত্বিক এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক।
ইংরেজী থেকে ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন