১৫ অক্টোবর রোববার সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের নির্ধারিত কয়েকটি স্থান শব্দহীন ছিল। শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে সচেতনতার অংশ হিসেবে এই প্রতীকী কর্মসূচি পালন করে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা কেন্দ্র। প্রকৃতপক্ষে এক মিনিট বড় বিষয় নয়, বিষয়টি হলো একটি বার্তা সাধারণ জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়া। শব্দদূষণ যে একটি অপরাধ, সেই বার্তা দেওয়া।
শব্দসচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালন করি’ এই কর্মসূচিটি পালন করা হয়। এ কর্মসূচি সফল করতে ঢাকা শহরের ১১টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যথা- সচিবালয়ের পাশে ওসমানী মিলনায়তনের সামনে, শাহবাগ মোড়, উত্তরা, বিজয় সরণি মোড়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, গাবতলী, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান-১, কমলাপুর বৌদ্ধমন্দির ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা বা কর্মচারী, স্কুল-কলেজের স্কাউট সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা বা কর্মচারী, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ সচেতনতা তৈরির জন্য মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ, যাত্রী ও গাড়িচালকদের মধ্যে শব্দ সচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণসহ এক মিনিট হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
গাড়ির হর্ন শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী থাকলেও, আমাদের আধুনিক জীবনে সব কর্মকাণ্ডের কারণে শব্দদূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া সারা দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে মাইক বাজানোর মাধ্যমে ভয়াবহ শব্দদূষণ তৈরি করা হচ্ছে। ফলে শুধু দিনের বেলায় নয়, গভীর রাত পর্যন্ত এই শব্দদূষণের শিকার হয় মানুষ। বর্তমানে শব্দদূষণ একটি একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করছে। উচ্চমাত্রার শব্দযুক্ত স্থানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করার ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং এমনকি কার্ডিওভাসকুলারজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছাড়াও শব্দদূষণ, বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত করে এবং তাদের বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্রমবর্ধমান সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য, একটি দ্বিমুখী পদ্ধতি অপরিহার্য আর সেটি হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইন প্রয়োগ।
রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় শহরে শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা শহরের প্রায় সব ব্যস্ত এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। শব্দের উৎসগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। শহর এলাকায় শব্দদূষণের প্রভাব গ্রামাঞ্চল থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি। শুধু ঘরের বাইরে, রাস্তায়, কর্মস্থলে নয়; শব্দদূষণ ঘরের ভেতর আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন- ফুড ব্লেন্ডার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এবং প্রেসার কুকার ইত্যাদি থেকেও উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৫-১৭ দুই বছর মেয়াদে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন করেছে কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনার, লিফলেট বিতরণ, জেলা অফিসে সাউন্ড লেভেল মিটার প্রদান, টিভি স্পর্ট নির্মাণ ও প্রচার, সাপ্তাহিক সচেতনতামূলক টিভি অনুষ্ঠান প্রচার এবং জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। সারা দেশে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১টি স্থানকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০২১ সালে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্প’ হাতে নেয়, এর আওতায় অংশীজন মতামত, শব্দ সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, সাইন বোর্ড স্থাপন, সচেতনতামূলক স্টিকার লাগানো, শব্দ সচেতনতামূলক টিভিসি, ক্ষুদে বার্তা ও বিজ্ঞপ্তি প্রচার, ৬৪ জেলার শব্দের মানমাত্রা পরিমাপসহ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬)-এর যুগোপযোগী সংশোধনের কাজ করছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস)-এর ২০২২ সালে ঢাকার দুই সিটির করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে দুই গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি স্থানের মধ্যে নিউমার্কেট মোড়, নয়া পল্টন মোড় এবং প্রেস ক্লাব মোড় সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে। অপরদিকে আবুল হোটেল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় এবং জিরো পয়েন্ট মোড় এ তুলনামূলক কম শব্দদূষণ পাওয়া যায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এলাকায় ৪৫টি স্থানের মধ্যে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মোড়, শিয়া মসজিদ মোড় এবং মাসকট প্লাজা মোড় এ সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া যায় অন্যদিকে মিরপুর বেড়িবাঁধ মোড়, রবীন্দ্র সরণি মোড় এবং গুলশান-২ মোড় কম শব্দদূষণ পাওয়া যায়।
ক্যাপসের অপর একটি গবেষণা করে রাজধানীর ১৭টি হাসপাতালের সামনে। যেখানে শব্দদূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ রেকড করা হয় ৮৯.৯ ডেসিবল যা দিনের বেলায় নীরব এলাকার জন্য আদর্শ মান ৫০ ডেসিবলের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে সর্বনিম্ন এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে সর্বোচ্চ শব্দ মান পাওয়া যায়। ক্যাপসের ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, সময়ের ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে নীরব এলাকা ঘোষণার আগে যেখানে ৭০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ জরিপকালীন সময়ের প্রায় ৮৭.৫৭ ভাগ সময়ব্যাপী ছিল সেখানে নীরব এলাকা ঘোষণার পরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬.০৩ ভাগ সময়। অর্থাৎ নীরব এলাকা ঘোষণার পরে বাংলাদেশ সচিবালয় এলাকায় শব্দের পরিমাণ প্রায় ৮.৪৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর মূল কারণ হিসেবে গাড়িচালকদের মাঝে অসচেতনতা অন্যতম। ২০২০ সালে ক্যাপস ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্ব পালনরত ২০০ ট্রাফিক পুলিশদের শ্রবণ স্বাস্থ্যের ওপর প্রশ্নপত্র জরিপ করে। জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, শব্দদূষণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, সাধারণভাবে মোবাইলে কথা শুনতে তাদের অসুবিধা হয়। ১৯ দশমিক ১ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে তাদের টিভি দেখতে হয়। আর ৩৩ দশমিক ৯ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, অন্যরা উচ্চস্বরে কথা না বললে তাদের কথা শুনতে কষ্ট হয়। এদিকে ৮ দশমিক ২ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তারা ঘূর্ণিরোগ, মাথা ভনভন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগেন।
শব্দদূষণ রোধে যেই পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ বাস্তবায়নে তথ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসক এবং থানা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অন্তর্ভুক্ত করা; শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ সংশোধন সাপেক্ষে ট্রাফিক পুলিশকে এর প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা; পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নিয়মিত সমন্বয় সভা করা; হর্ন বন্ধে যৌথ অভিযান/মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা; আমদানি নীতির আলোকে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ট্রাফিক আইনে হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি করা; শব্দের মানমাত্রানুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া; চালকদের শব্দসচেতনতার স্তর যাচাই সাপেক্ষে লাইসেন্স প্রদান করা; বিধিমালা কর্তৃক সংজ্ঞায়িত জোনগুলো (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) চিহ্নিত ও গেজেট; নোটিফিকেশন দ্বারা সংশিষ্টদের অবগত করা; জেনারেটরের মানমাত্রা নির্ধারণ করা; শব্দের মানমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা; অনুমতি ব্যতীত সভা-সমিতি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ করা; শব্দ সৃষ্টিকারী এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা/প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিধিমালা সম্পর্কে অবহিত করা; বিধিমালা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত অংশীজনদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি করা; নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী, প্রশাসনের সমন্বয়ে কমিউনিটিভিত্তিক কমিটি করে শব্দদূষণসংক্রান্ত আইনভঙ্গের বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব প্রদান করা; বিধিমালার সংজ্ঞানুযায়ী চিহ্নিত জোনগুলোতে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট স্থাপন করা; যানবাহনসংক্রান্ত শব্দ হ্রাসে সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা; গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা; শিল্প-কারখানার শব্দ আটকানোর জন্য মালিক কর্তৃক জন্য প্রতিবন্ধক তৈরি করা; জেনারেটরের জন্য আচ্ছাদন তৈরি করা এবং ঘেরা দিয়ে নির্মাণ কাজের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
শেষ কথায় বলা যায় আমরা যারা শব্দদূষণ সৃষ্টি করছি তারাও প্রকৃত পক্ষে এর ক্ষতির শিকার হই। কাজেই সরকার গৃহীত কর্মসূচির পাশাপাশি শব্দ দূষণের উৎসগুলো বন্ধ করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার বা কোনো একটি সংস্থা কর্তৃক এককভাবে শব্দদূষণের মতো একটি জটিল সামাজিক ব্যাধির সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার। তাই সবাই মিলে শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে হবে ও নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। শব্দদূষণের মতো মারাত্মক ঘাতক থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক মণ্ডলী ও ছাত্রসমাজকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম-সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
মন্তব্য করুন