মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। বড়ই অদ্ভুত। তারা যা বলে নিজের মতো করে বলে। স্বার্থ ছাড়া এক পা ফালায় না। এক ছত্র লিখেও না। তারা প্রবাদ বানিয়ে কোনো পণ্য, বস্তু বা বিষয়কে তাদের মতো করে বিশ্লেষণ করে। কিন্তু যাদের নিয়ে তাদের এই রচনা তথা ঠাট্টা-মশকরা তাদের নিয়ে এতটুকুও ভাবে না। নিজেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়। অথচ জড়বস্তুর বেলায় এর অন্যথা করে। এটা রীতিমতো জুলুমের শামিল। সৃষ্টির আদিকাল হতে এরূপ চলছে। যুগে যুগে কত অযুত-নিযুত বুদ্ধিজীবী আর মানবতাবাদীর আবির্ভাব হলো। কেউ এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে জড়বস্তুর অন্তর্দাহ তথা সুপ্ত কথা অনুধাবন করার চেষ্টাও করেননি। জড়বস্তুর পক্ষে এটা যেমন বেদনাদায়ক তেমনি তাদেরও কিছু মজা করার বা দেখার বিষয় রয়েছে।
মানুষ তাদের প্রয়োজনে বা শখে বা বাণিজ্যের খাতিরে কত দিবসই যে সৃষ্টি করে তার ইয়ত্তা নেই। দিবসের আতিশয্যে মনেই থাকে না কবে কোন দিবস আসে আর যায়। তবে এসব দিবসের মধ্যে আমাদের নিয়েও যে একটি দিবস আছে তা জেনে অতিশয় আনন্দ আর পুলক বোধ হয়। আজ বিশ্ব ডিম দিবস।
আমাদের নিয়ে একদল লোক ১৯৬৪ সালে আন্তর্জাতিক ডিম কমিশন গঠন করেছিল। ১৯৯৬ সালে ভিয়েনায় এটি বিশ^ ডিম দিবস হিসেবে প্রথম পালিত হয়। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৮০। এই কমিশনের লক্ষ্য হলো আমিষ জাতীয় খাদ্য ঘাটতি পূরণ, খাদ্য নিরাপত্তা প্রদান আর সার্বিক কল্যাণে ডিমের প্রচার চালনা। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠনই উদ্দেশ্য। তবে অতি আবশ্যক হিসেবে বাণিজ্য তো আছেই। বাংলাদেশ এনিমেল এগিকালচার সোসাইটি ( বিএএএস) ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক ডিম কমিশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের জন্য ডিম’। প্রতিপাদ্য বিষয় দেখে বুকের ছাতি গর্বে ফুলে ওঠে। কিন্তু ডিম নিয়ে এ দেশে যা হচ্ছে তা রীতিমতো তুঘলকি কারবার। ফলে এক শ্রেণি হর্ষোৎফুল, এক শ্রেণির চোখে সর্ষে ফুল আরেক শ্রেণি হোপ ফুল। ডিমের অগ্নিমূল্য নিয়ে আজ আর বলার কিছু নেই, তবে আম পাবলিক হচ্ছে প্রতিনিয়ত বেওকুফ।
এ দেশে সবকিছুর শুরু হয় ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে। পরবর্তীতে এর সাথে মধুমক্ষিকারা যুক্ত হওয়ায় উদ্দেশ্য প্রচারে আর ব্যানারে শোভা পেলেও মূলত বাজারের নামে এক শ্রেণির লোকের পোয়াবারো হয়। ডিম নিয়ে এখন এ অবস্থাই চলছে। এর শেষ কবে, কোথায়, কীভাবে কারও যেন জানা নেই। ডিমের এই ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের লাগাম চেপে ধরার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াসের শেষ নেই। ইতোমধ্যে ডিম মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে। পাবলিক এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ। অনেকের কাছে পাবলিক সবকিছু নিয়েই হাউকাউ করে থাকে। আবার কারও কাছে তা সোনার ডিমের মতো। সে যা-ই হোক, ডিম নিয়ে তেলেসমাতি দেখে হাসিও পায়, কান্নাও আসে। সব ছাপিয়ে ভীষণ রাগও হয়। আগে পাবলিক সরকারের দিকে আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু এখন তারাও বুঝে গেছে সরকার আন্তরিক হলেও সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করে থাকেন। এ নিয়ে মিডিয়া সরগরম হয়। পাবলিক মজা পায়। আর কামেল লোকেরা তাদের কাজ ডোন্ট কেয়ার ম্যুডে চালিয়ে যায়। ডিম নিয়ে যা-ই হচ্ছে তার সবই করছে মানুষ। মাঝখান থেকে ডিম থেকে যাচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ডিম কমিশন তথা এ দিবসের সৃষ্টি তার প্রধানতম উদ্দেশ্য, জনগণের আমিষ (পুষ্টি) চাহিদাপূরণ, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
মানুষ তার প্রয়োজনে ভাব প্রকাশে ডিম দিয়ে প্রচুর বাণিজ্য করেছে, এখনো করছে। এ হেন খাদ্য সেই যাতে ডিমের ছোঁয়া নেই। আবার মানুষই ডিম নিয়ে নানা রস যোগ করেছে। অশ্ব ডিম্ব তার একটি। বাস্তবে নেই অথচ এরূপ শব্দ আবিষ্কারের আবশ্যকতা কী তা বোধগম্য নয়। ডিমকে ঘিরে অনেক কুসংস্কারও রয়েছে। পরীক্ষার দিন ডিম খেয়ে গেলে খাতায় মিলবে ডিম অর্থাৎ শূন্য। এটি ডিম জাতির প্রতি চরম অবমাননাকর অপবাদ। সারা বছর সন্তানকে ডিম গিলিয়ে মেধাবী করে পরীক্ষার দিন এরূপ অপবাদ দেওয়া মানবাধিকার লংঘনের মতো জঘন্য অপরাধ। আবার কাউকে চরমভাবে অপমান করতে চাইলে মাথায় বা শরীরে ডিম নিক্ষেপ একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। এই ডিমকে নিয়ে নিবর্তনমূলক কথাবার্তাও আছে। ডিম থেরাপি তার মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ। এর মাহাত্ম্য কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে। অথচ পৃথিবীব্যাপী এই একটি খাদ্যই রয়েছে যা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই খুব আয়েশ করে ভোগ করে। যারা হারাম হালাল বেছে চলেন, বিশেষত বিদেশ-বিভুঁইয়ে তাদের কাছে এটি দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদার নির্ভেজাল খাদ্য। অথচ এ দেশে ডিম নিয়ে যা হচ্ছে তা অকল্পনীয় তো বটেই রীতিমতো অপরাধমূলকও। আমাদের নিয়ে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলা কবে বন্ধ হবে কে জানে? যারা ডিম নিয়ে নাটাই ঘুরাচ্ছেন তাদের জন্য ডিম থেরাপি হতে পারে মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু ডিম তো আর মানুষ না।
ডিমের মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে সরকার পেরেশান। শেষমেশ আমদানি পণ্য হিসেবেও তাকে স্ট্যাটাস দিতে হয়েছে। সরকারের খাস পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে ডিমের মূল্য পর্যন্তও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের লোকেরা সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে বাজারে হানা দিয়ে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ভেস্তে যাচ্ছে সিন্ডিকেট নামক শক্ত অলিগার্কের কাছে। আমাদের দেশে নানা ডামাডোলের সময় এক শ্রেণির সিন্ডিকেট বিভিন্ন জিনিসের ওপর আসর করে। এদের আবার ক্ষেত্র ভাগ করা আছে। তাদের রয়েছে নিজ নিজ সিন্ডিকেট। আবার রয়েছে ফেডারেশন টাইপের বৃহৎ ছাতাও। ডিম অতি ক্ষুদ্র একটি পণ্য। অথচ তাকে নিয়ে যে কায়কারবার হচ্ছে তা যেন সবকিছু ছাপিয়ে এখন হাস্যরসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী হতাশ, ভোক্তা অধিকারের লোকেরা হাপিত্যেশ আর পাবলিকের পশ্চাৎদেশে বাঁশ। ডিমের যদি চলৎশক্তি থাকত তাহলে ডিম অনেক আগেই নিত ফাঁস।
এবারের ডিম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো : স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের জন্য ডিম। অথচ সেই ডিমই এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের খাবার তালিকা থেকে বিদায় নিয়েছে। স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী প্রজন্মের মুখে অন্তত দৈনিক একটা করে ডিম তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই দিবসের উদ্দেশ্য খানিকটা হলেও পূরণ হতে পারে। এই কাজটি কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? সরকারের, ব্যবসায়ীদের, সুশীল সমাজের, পেশাজীবীদের? এর উত্তর এক কথায় হয়তো দেওয়া যাবে না। তবে প্রতিটি গোষ্ঠীরই নৈতিক করণীয় আছে বলে মনে করি। ডিমের দ্যুতি যেন ডিম লাইটে পরিণত না হয়।
মন্তব্য করুন