গতকাল ১০ অক্টোবর পালিত হলো আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই প্রসংগে দেশীয় প্রেক্ষিতে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে এ নিবন্ধের অবতারণা।
বেশ কয়েক বছর আগে টিভির একটি বিজ্ঞাপন সবার নজর কেড়েছিল। সেটি ছিল একটি ওষুধের প্রচার-বিজ্ঞাপন। তাতে বলা হয়েছিল বিষণ্নতা একটি রোগ। তখন থেকেই আমরা নড়েচড়ে বসেছি। বলা চলে বিষণ্নতাকে নিয়ে তখন থেকে ভাবতে শুরু করি। তাই বলে আমাদের মধ্যে যে এর আগেও বিষণ্নতা বোধ ছিল না তা নয়। হয়তো সেভাবে বিষয়টিকে দেখা হয়নি। আজ এত বছর পর এত এত উন্নয়নের পরও চারদিকে দেখছি বিষণ্নতাকে নিয়ে আমাদের বসবাস। এটি যেন বিনাশী এক প্যারাসাইটিস।
বিষণ্নতা একটি মানসিক সমস্যা সন্দেহ নেই। এর লক্ষ্মণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে প্রায় সময় মন খারাপ থাকা, আগে যে কাজে আনন্দ পাওয়া যেত এখন তাতে ভাটা পড়া, কাজে ও চিন্তায় ধীর গতি আসা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা ঘটমান সব খারাপ অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করা ইত্যাদি। আরও আরও লক্ষ্মণ থাকতে পারে। এটি চিকিৎসক আর মনোবিজ্ঞানীদের সাবজেক্ট।
বিষণ্নতার কারণে ব্যক্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি তার পারিবারিক, সামাজিক জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। চিকিৎসক আর মনোবিজ্ঞানীরা কি বলবেন তাতে না গিয়ে আমরা যারা অতি সাধারণ তারা এই বিষণ্নতাকে নিয়ে একটু অনুসন্ধান কার্য করতে পারি। বলাবাহুল্য, বিষণ্নতার এই প্যারাসাইটিসকে আমরাই বড় করেছি। আমাদের একটা নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল। তাতে ঋতুভেদে রকমারি আবহাওয়া দোল দিয়ে যেত। আমরা আন্দোলিত, উদ্বেলিত হতাম। এতে আমাদের বেশিদিন ভালো লাগেনি। আমরা জীবনে তরঙ্গ চেয়েছি। তাই উত্তুঙ্গ হয়েছি। বিদেশি কালচার ভাড়া করে তাতে মজেছি।
আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের দর্শন ছিল, মোটা কাপড় মোটা ভাত। তথা প্লেইন লিভিং প্লেইন থিংকিং। আমরা তাতে নানা ভ্যারাইটি যুক্ত করেছি। আমাদের উদ্দীপনা মন্ত্র ছিল মানবিক গুণাগুণ ও মূল্যবোধ। আমরা তার স্থলে আমদানি করেছি চাকচিক্যময় প্রদর্শনীর দর্শন। সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের স্থলে প্রতিস্থাপন করেছি ব্যক্তিক সংকীর্ণ অভীপ্সা। দশে মিলিয়া করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ- এই মূল সংগীতকে একপাশে সরিয়ে একলা চলো রীতি রপ্ত করেছি। আমরা কেউ হারার মানসিক ভার সহ্য করতে পারি না। হারিয়ে যাওয়া মানেই পিছিয়ে যাওয়া, ক্রমে ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া- এই নেতিবাচক বোধ আমাদের কাছে প্রিয় বলে উদ্ভাসিত হয়েছে। আমরা সবাই জিততে চাই। এজন্য অন্যকে মাড়িয়ে ও হৃদয় বিদীর্ণ করে ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে চৌ প্রহর ব্যতিব্যস্ত থাকছি। এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিরন্তর দৌড়াচ্ছি, কিন্তু অভীষ্টের মাইল পোস্ট যেন ক্রমাগত সম্মুখবর্তী হচ্ছে।
আমরা আমাদের প্রত্যাশার গণ্ডিকে আকারে, প্রকারে ও পরিমাণে এত বড় করেছি যে, দিনশেষে এর সঙ্গে প্রাপ্তিগুলো বড় ম্রিয়মাণ বলে মনে হচ্ছে। এতে আমাদের খেদ আরও বাড়ছে। খেদের চোটে আমরা আরও ক্ষিপ্র হয়ে ছুটছি। ফলে আমাদের মাংসপেশিতে টান পড়ছে, হার্ট পাম্প করে কুল পাচ্ছি না। স্ট্যামিনায় ঘাটতি পড়ছে। তবু দৌড়ানোর কমতি নেই।
আগে শিক্ষিত হওয়ার দীক্ষা ছিল। সুশিক্ষিত মানুষ সমাজ প্রগতিতে মূল্যবান ভূমিকা রাখত। লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে- এই প্রবাদ লোভনীয় ছিল। এর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পেরেশানি-প্রস্তুতিও ছিল ব্যাপক। সেই শিক্ষার সঙ্গে মানবিক গুণাবলির দীক্ষাও ছিল। আগে শিক্ষার জন্য একঝাঁক কারিগর ছিল। মূল্যায়ন তরিকা সহীহ ছিল। মেধাবীরা তাদের প্রাপ্য বাস্তবজীবনে প্রবেশ করা মাত্রই পেত। আজকাল শিক্ষা ক্ষেত্রে দারুণ বিপ্লব এসেছে। আগেকার সেই জীর্ণশীর্ণ বিদ্যায়তন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে সুদৃশ্য ও সুউচ্চ দালান উঠেছে। আগেকার সেই ভাঙ্গা বেঞ্চ আর টেবিল নেই। এতে রমরমা অবস্থা যোগ হয়েছে। শ্রেণি শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা উঠে গেছে। ছাত্রদের সামনে কোনো অভীষ্ট নেই। অভিভাবকও জানে না তার সন্তানের পাঠ কি, গন্তব্য কি? শিক্ষকও জানে না কী করতে হবে, কীসের জন্য? মোটকথা শিক্ষার কাঠামোগত হার্ডওয়ারের কাজ বেশ হয়েছে কিন্তু সফটওয়্যারের কাজটিই সঠিকমতো হচ্ছে না।
সবাইকে জিপিএ ফাইভ বা গোল্ডেন ফাইভের নেশায় পেয়ে বসেছে। অনায়াসে তা মিলেছে। উচ্চশিক্ষা আসক্তি আরও প্রবল হয়েছ। কিন্তু সার্টিফিকেটের ওজন বাড়ছে না। বিশ্বের মানদণ্ডে প্রথম আটশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশের কোনো স্থান নেই। অথচ আমরা এই খাতে যথেষ্টই ব্যয় করছি। শিক্ষা শেষে কর্ম নেই। তাই তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশমুখি হয়েছে। ডলার বিচারে দোষের কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃত মেধাবী জনগোষ্ঠীর আর ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই। বেকারত্ব বাড়ছে কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় ঝোঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবাই জেনারেল লাইনে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। দেশীয় চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না। তাই লাখ লাখ তরুণ জীবিকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখান থেকেই বিষণ্নতা দানা বাঁধিতে শুরু করছে।
আগে যা ভালো লাগত এখন তা আর ভালো লাগে না। পৃথিবীর সবকিছুই যেন উপহাস করছে বলে মনে হচ্ছে। অন্যরা যা পারছে আমি কেন তা পাচ্ছি না, এ জাতীয় প্রদাহ সারাক্ষণ হচ্ছে। তখন এর জন্য ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ বলে নিজের কপালকেই অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। এই জীবন রেখে কি লাভ জাতীয় মনস্তত্ত্বেরও সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক জীবনেও এর আছর পড়ছে। পাশের বাড়ির অমুক সর্ব বিচারে হীন হলেও তার রমরমা দশা গৃহদাহের সৃষ্টি করছে। যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তারা হয় অযোগ্যদের পিছু পিছু কাচুমাচু করছে নয়তো ছা-পোষা জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে বিশেষ পরিহাসের বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে সবারই দৈনন্দিন বাজার করতে হাপিত্যেশ অবস্থা সেখানে অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে। তাদের দাপট পরিবার, সমাজ ছাপিয়ে রাজনীতির চাতালকেও অধিগ্রহণ করেছে। হাজার কোটি টাকা এখন আর ব্যাংকের মূলধন না এটি অনেক ব্যক্তির একক মূলধন হিসেবে দেশে-বিদেশে সৌরভ ছড়াচ্ছে। এরূপ বিসদৃশ চিত্র আজকাল সর্বত্র ভাইরাল হচ্ছে। আগে সাদা মনের মানুষদের সর্বসমক্ষে তুলে ধরা হতো। এখন হয় না। মিডিয়ার কাজ এখন রাজনীতিবিদ, আমলা আর মডেল-তারকাদের নিয়ে।
বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতে লোকজন আজকাল ছুটি পেলেই দেশের আনাচে-কানাচে থাকা পর্যটন স্পটে ছুটে যায়। সেখানে খেয়ে না খেয়ে পয়সার শ্রাদ্ধ করে নির্মল শ্বাস নিতে যায়। কিছুদিন পরপর মিডিয়াতে তার চিত্র দেখা যায়। আমাদের সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে বিষণ্নতা ভর করেছে। এখান থেকে মুক্তির পথ কী? উত্তর কারও জানা নেই। কেউ এটি নিয়ে চিন্তাও করছে না। পাবলিক না পাচ্ছে আয়ের পথ না পারছে ব্যয় সংকুচন করতে। সরকারি সেবা পেতেও বিরাট হ্যাপা। অথচ এসব নিয়ে আলোচনা নেই। সমালোচনা করলে তো নির্বান্ধব হতে হবে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কেবলই বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে হেনস্তার অবস্থাও চাউর হচ্ছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিষণ্নতাক্রান্ত পাবলিক কেবলই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। যেন দাঁড়াইলেই ক্ষতি। দম নিলেই বিষণ্নতা-ভীতি পেয়ে বসবে।
আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে বিষণ্নতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নানাবিধ সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান রইল। মনে রাখতে হবে বিষণ্নতা একটি রোগ।
আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন