আনোয়ার হাকিম
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:২১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আনোয়ার হাকিম

প্রবীণ দিবসে প্রবীণের ভাবনা

১ অক্টোবর, বিশ্ব প্রবীণ দিবস। ছবি : সৌজন্য
১ অক্টোবর, বিশ্ব প্রবীণ দিবস। ছবি : সৌজন্য

‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।

কবিতাটি আপাত রোমান্টিকতা আর বেদনা বিধুরতার অনুপম দৃষ্টান্ত হইলেও এর গুঢ় রহস্য আরো ব্যাপক। জীবনানন্দ দাশ দিনশেষে অন্ধকারে মুখোমুখি বসিয়া জীবনের সব লেনদেন শেষ করিতে চাহিয়াছিলেন। পারিয়াছিলেন কি না তাহা লইয়া গবেষণা হইতে পারে। কিন্তু আমরা যান্ত্রিক ট্রামের নিচে তাহার দেহদান চাক্ষুষ করিয়াছি। কবিতাটির এই কয়েকটি চরণ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে স্মরণ করিয়া কিছুটা বিশ্লেষণে প্রয়াসী হইয়াছি।

প্রবীণদের লইয়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নানাবিধ কল্যাণমুখী ও সেবা ধর্মী সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। প্রবীণদের চাহিদা, তাহাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা লইয়া চিন্তার মেলা ক্ষেত্র উন্মোচিত হইয়াছে। আর অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশে প্রবীণদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোতে প্রবীণদের লইয়া অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হইলেও এখনো অনেক কিছু করার বাকি রহিয়াছে। বৈশ্বিক গ্রামের সার্বিকতাকে মাথায় লইয়া জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করিবার পাশাপাশি বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন বিষয় লইয়া গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইহার অনুবৃত্তিক্রমে ১৯৯১ সাল হইতে প্রতি বছরের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে দেশে দেশে পালিত হইয়া আসিতেছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ৬৫ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হইলেও আমাদের দেশে ৬০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণ বলিয়া ধরা হইয়া থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু সাড়ে ৭০ বছর হওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। সেই হিসেবে দেশে প্রবীণ জনসংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি হইতে পারে।

আমাদের দেশের প্রবীণদের সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা ভিন্ন হইলেও মোটা দাগে সারা বিশ্বের প্রবীণদের সমস্যা একইরকম। ইহাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক, পারিবারিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাই প্রকট। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান একটি বড় সমস্যা। সঙ্গত কারণে প্রবীণরা ইহার অন্যতম ভুক্তভোগী। এখনকার বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তিই সবচাইতে বড় শক্তি বলিয়া স্বীকৃত বাস্তবতা। সামাজিক সমস্যা আবহমানকাল হইতে জারি থাকিলেও ইদানীং ইহার নানাবিধ সাইড ইফেক্ট দেখা যাইতেছে। আগে প্রবীণরা অবসর জীবনযাপনে সামাজিক বিশেষ মর্যাদা পাইত। এই প্রাপ্তি তাহাদের মানসিক দৃঢ়তা যোগাইত।

এখনো যে তাহাদের উপযোগিতা রহিয়াছে তাহা অনুভব করিত। এখন ইহাতে যথেষ্ট ভাটা পরিলক্ষিত হইতেছে। অন্যদিকে তাহাদের উপযোগী সামাজিক বিনোদনের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হইতেছে না। দিনে দিনে পরিবারের আকার ছোট হইয়া যাওয়ায় এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েনে পরিবারের সক্ষম জনবলের উদয়াস্ত বাহিরে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকার কারণে পরিবার মধ্যে তাহাদের বিনোদনের সুযোগ হইতেছে না। তাই কেবলমাত্র ধর্মকর্মের মধ্যেই তাহাদের আত্মীক বিনোদন খুঁজিয়া লইতে হয়। মানসিক সমস্যা প্রবীণের জন্য আরেক বড় সমস্যা।

একসময় পরিবারের স্টিয়ারিং হাতে থাকিলেও প্রবীণতা তাহাকে অবসরের কঠিন বাস্তবতায় লইয়া যায়। তখন হঠাৎ করিয়া পরিবারের মধ্যে তাহার গুরুত্ব হ্রাস পাইলে মনস্তাত্ত্বিক যাতনা শুরু হয়। সমাজ তাহাকে উপেক্ষা করিতেছে, যথাযথ গুরুত্ব দিতেছে না বা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখিতেছে না এই বোধ তাহাকে মানসিকভাবে সারাক্ষণ যন্ত্রণা দেয়। আর এইসবের সবকিছুকে ছাপাইয়া স্বাস্থ্যগত দিক তাহাকে পর্যুদস্ত করিয়া ফেলে।

আমাদের মতো দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রতুল না। সহজলভ্যও না। আবার তাহা যথেষ্ট ব্যয়বহুলও বটে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার গণ্ডি সম্প্রসারিত না হইলে প্রবীণের এই ভোগান্তির শেষ হইবে না।

মোটা দাগে আমাদের মতো দেশে প্রবীণদের চাহিদা খুব সীমিত। যেমন : মানসিক, সামাজিক, মনস্তাত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্বাস্থ্যগত ও ধর্মকর্মের। প্রবীণের সমস্যাগুলো হইলো পরিবারে গুরুত্ব না থাকা, রাগ বৃদ্ধি পাওয়া, নালিশের প্রবণতা বৃদ্ধি, একাকীত্ব, সমাজ হইতে বিচ্ছিন্নতা, কথা বেশি বলার প্রবণতা, নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করা, ঘন ঘন অপমান বোধ জাগ্রত হওয়া, অবহেলার শিকার বলিয়া নিজেকে মনে করা ইত্যাদি। বিপরীতে প্রবীণের সম্ভাবনাও প্রচুর। অনেকেই হয়ত ইহাতে হাস্যরসের উপাদান খুঁজিয়া বেড়াইবেন। কিন্তু বিষয়টি এতটা হাল্কা নয়।

প্রবীণের অভিজ্ঞতা অনুজদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তাহাদের অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শ বা যুক্তিসঙ্গত মতামত হইতে উপকৃত হইতে পারে। পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখভাল করার ক্ষেত্রে তাহারা আন্তরিক সেবা প্রদান করিতে পারে। যাহা মোটা টাকার বিনিময়েও কেয়ার গিভারের নিকট হইতে আশা করা যায় না। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রকৃষ্ট শিক্ষকের দায়িত্বও তাহারা পালন করিতে পারে। ইহা ছাড়া সমাজের ও পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে পারিবারিক, সামাজিক কাইজ্যা-ফ্যাসাদ ও বিরোধ নিষ্পত্তিতেও তাহারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখিতে পারে।

প্রবীণদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। যদিও বয়ষ্ক ভাতাসহ সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি পাইতেছে। তবু তাহা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। সরকারি-বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বিকাশমান হইলেও এই ব্যবস্থা আমাদের সমাজব্যবস্থায় সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায় নাই। এই ব্যবস্থার দুই দিকই ধারাল। বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থা প্রবীণদের জন্য সুখকর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা হইতে পারে না।

সমাজ ও পরিবারকেই প্রবীণদের দায়িত্ব লইতে হইবে। ইহার জন্য নানাবিধ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবাগত নতুন নতুন প্রণোদনা দেওয়া যাইতে পারে। বিদ্যমান সেবা সুবিধার সম্প্রসারণ করা আবশ্যক। রাষ্ট্রকে এই খাতে অতি আবশ্যিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করিতে হইবে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রবীণদের এই চাহিদা ন্যুনতম। সর্বোপরি, প্রবীণদের প্রতি সামাজিক মনোযোগ আরো বৃদ্ধি করিতে জনসচেতনতা মূলক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি করিতে হইবে। বয়স ও পটেনশিয়ালিটি বিবেচনায় তাহাদের জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং ও কর্মক্ষেত্র তালাশ করিতে হইবে।

মোটকথা, প্রবীণবান্ধব সামাজিক একটা আবহ তৈরি করিতে হইবে। প্রবীণের স্নেহ ছায়ায়, অভিজ্ঞতা পুষ্ট দিক নির্দেশনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রাণের আনন্দে জাগ্রত হউক ইহাই আজকের এই দিনে সবার কাম্য। প্রবীণের প্রত্যাশাও তাই। নতুবা জীবনানন্দ দাশের মতো দিন শেষে অন্ধকার আসিলেও মুখোমুখি থাকিবে একরাশ হতাশা আর যাতনা।

আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন / জনরায়ের অপেক্ষায় কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ, আ.লীগের ৩ নেতা গ্রেপ্তার

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা ৮৮ শতাংশ

ক্যাশ অফিসার নিচ্ছে ওয়ান ব্যাংক

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন নেতানিয়াহু

পঙ্গুত্বের পথে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সুজন

সিলেটে জমি নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১ 

কাগজের নৌকা ভাসাতে গিয়ে স্রোতে ভেসে গেল শিশু

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরও ১৫১ প্রবাসী

নিউইয়র্কে কমলা হ্যারিসের জয়

১০

বিএনপির মিছিলে হামলা, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১১

বগুড়ায় আন্দোলনে শহীদ ১৯ জনের নামে স্মৃতিফলক

১২

০৬ নভেম্বর : টিভিতে আজ দেখা যাবে যেসব খেলা

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে ভোট গণনা চলছে, এগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প

১৪

ক্যানসার প্রতিষেধক ননী ও করোসল চাষে সাফল্য

১৫

সাতক্ষীরায় থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তলসহ গ্রেপ্তার ২

১৬

০৬ নভেম্বর : নামাজের সময়সূচি

১৭

৬ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল

১৮

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নবনিযুক্ত পরিচালকের সঙ্গে সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাক্ষাৎ

১৯

ঢাকায় মধ্যরাতে বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি

২০
X