আজ ৩০ সেপ্টেম্বর আবুল কাশেম ফজলুল হকের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। তাকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭০-এর দিকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে এক সভায়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ‘কুসুমিত ইস্পাতের’ কবি হুমায়ূন কবির আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে দেখে ও তার বক্তব্য শুনে আমার একটি শব্দই মনে হয়েছিল - ‘ছিমছাম’। মনে হয়েছিল, দেখতে শুনতে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক যেমনি ছিমছাম, তার কথাও তেমনি ছিমছাম - পুরোপুরি বাহুল্যহীন।
আর একটি ব্যাপারে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক আমার হৃদয় আকর্ষণ করলেন। তার পোশাকের ধরনটি ঠিক আমার বাবার মতো। সেই ফুলপ্যান্টের ওপরে পুরোহাতা জামা - ও রকমের পোশাকেই তাকে আমি সর্বদা দেখেছি। ওই রকম জামাকে আমার বাবা ‘বুশশার্ট’ বলতেন। প্রথম জীবনে প্যান্টের ভেতরে শার্ট গুঁজে দিয়ে পরলেও বাবা পরের দিকে প্যান্টের ওপরেই সেই পুরোহাতা শার্ট পরতেন - শুধু শীতের সময়ে স্যুট না পরলে। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের পোশাকের রকমটিও ছিল সে রকম। আর একজন মানুষকেও ও রকম পোশাকে আমি দেখেছি - তিনি প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফ।
১৯৭৫ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পরে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। ততদিনে তার তিনটে বই পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল - ‘মুক্তিসংগ্রাম’, ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন’। সে সময়ে তার লেখা পড়ে ও তার বলা শুনে মনে হয়েছে নিরপেক্ষ চিন্তা ও তত্ত্ব তার চিন্তা-চেতনার মূল খুঁটি। স্বদেশ ভাবনা ও প্রগতিচিন্তাই তার মানস। মানুষটি ‘মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার’ ধারক ও বাহক। সেখানেও ছিমছাম নির্মেদ তার মন ও মানস।
১৯৮৪ সালে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এলে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে নানা জায়গায় দেখা হয়েছে। কখনো বা শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে, কখনো সখনো রাস্তা পার হতে নীলক্ষেত এলাকায়। শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে নানা আলোচনায় অনেকের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে অনন্য বলে মনে হতো - তার চিন্তার গভীরতা, জ্ঞানের ব্যাপ্তি, আলোচনার নির্মোহতার কারণে।
কারো প্রবন্ধের আলোচক হলে তিনি কখনও ভাসা ভাসা আলোচনা করেননি, বিষয়বস্তুর গভীরে গিয়ে পুরো লেখার নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ করতেন অনেকটা একজন দক্ষ শৈল্যচিকিৎসকের মতো। লেখকের যুক্তির অস্বচ্ছতা, রচনার মধ্যে যুক্তির দুর্বলতা থেকে শুরু করে বানান বিভ্রাট, গ্রন্থপঞ্জীর অপ্রতুলতা কিছুই তার মনোযোগ এড়াতো না। সেই সঙ্গে মিশতো তার নিজস্ব মতামত, চিন্তা-চেতনা এবং প্রবন্ধটিকে পরিশীলিত করার জন্য তার সুপরামর্শ। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক কখনো পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত না হয়ে ও প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না পড়ে আলোচনা সভায় আসতেন না এবং তার তীক্ষণ্ন শানিত বক্তব্যে আমাদের ঋদ্ধ করতেন। এমন অনন্য সাধারণ আলোচক আর সমালোচক আমি বড় একটা দেখিনি।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের পুত্র দীপন (ফয়সাল আরেফিন দীপন) সম্ভবত আশি বা নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। আমার শিক্ষক ও সহকর্মীদের অনেকের সন্তানই আমার বিভাগের বা আমার শিক্ষার্থী ছিল। তাদের কাউকে কাউকে জানতাম - যেমন শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় শোভন ও প্রয়াত সুমন, শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার কন্যা মিতি, কিংবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কন্যা রুচি। কিন্তু জানতাম না অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের কন্যা কাবেরীও আমার শিক্ষার্থী ছিল আশির দশকে। কিছুদিন আগে সে তথ্য জানা গেলে কাবেরীকে জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দিয়েছিল, ‘আমাদের বাড়ি থেকে সে রকমটা না জানানোরই চল ছিল, স্যার’। তাই আমি জানতাম না, দীপন আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকও কখনো বলেননি। সত্যিই এমন জানানোর চল ছিল না।
বহু বছর বাদে প্রয়াত দীপনের স্ত্রী জলির (ডা. রাজিয়া রহমান জলির) কাছে জেনেছি, দীপন অর্থনীতির ছাত্র ছিল। আসলে দীপনকে নয়, জলিকেই আমি চিনি ১৯৭২/৭৩ সাল থেকে - তার বাল্যকাল থেকে। জলিরা থাকত ফুলার রোড ১৬/ই তে। আমি প্রায়ই যেতাম ১৬/সি-তে বেনুর বড়বোন রীনু আপার বাসায়। জলির মা আমাদের জ্যৈষ্ঠভগ্নীতুল্য এবং সে এলাকায় ‘জলির আম্মা’ সবার প্রিয়পাত্র। জলি আসলে আদিতেই খ্যাতিমান হয়েছে তার মায়ের জন্যে - তার মায়ের সঙ্গে তার নামটা জুড়ে যাওয়ার জন্য।
আমরা বাইরে চলে আসি নব্বই দশকের প্রথম দিকে। কিন্তু জনান্তিকে খবর পেয়েছি যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্বদেশ চিন্তা সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বাংলাদেশের মুক্তি ও উন্নতির কর্মনীতি আটাশ দফা’ সম্ভবত : ২০০৫ বা ২০০৬ সাল নাগাদ।
পরে সময়ের বহু ঘটনাই জানা ছিল না আমার। জানতাম না, জলি আর দীপন ঘর বেঁধেছে। জানতাম না, দু’টো ফুট ফুটে শিশুর জনক-জননী হয়েছে তারা। জানতাম না, জলি ডাক্তার হয়েছে আর দীপন আত্মপ্রকাশ করেছে ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রকাশক হিসেবে। জানতাম না বহুকিছুই। জানতাম না দীপনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ছুরি শানাচ্ছে জল্লাদরা।
তার পরের ইতিহাস বড় কষ্টের আখ্যান। দীপনকে হত্যা করা হলো - নিহত হলো একটি শুভ বুদ্ধি, একটি সৃষ্টিশীল মন, একজন সৃজনশীল মানুষ। জলির কষ্টের কথা ভেবে পাই না। কিন্তু অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কী কষ্ট, কী অসহায়তা যে তিনি বুকে ধারণ করেছেন তখন, তা যেন তার কথায় বেরিয়ে এসেছে। সে সব পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি হয়তো কোনো সাধারণ মানুষ নন, এক অনন্যসাধারণ মানুষ! আহাজারি করেননি তিনি, ‘বিচার চাননি তিনি তার পুত্রের হত্যাকাণ্ডের’! হয়তো ভেবেছেন, কী হবে এ পোড়ার বিচারহীন দেশে দীপনের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে।
অন্যদিকে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে দীপনপুর মুক্ত বুদ্ধি আর মুক্ত চিন্তার তীর্থকেন্দ্র হিসেবে। উদারপন্থি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষরা, অন্যচিন্তার লেখকরা, কবিরা, সাহিত্যিকরা ভিড় জমিয়েছেন সেখানে। ‘জাগৃতি প্রকাশনী’ বের করেছে অনন্যসাধারণ বেশ কিছু বই। পেয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
বছর চারেক আগে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন আমার বই ‘বেলা-অবেলার কথা’র প্রকাশনা উৎসবে। ২০১৭ সালের বইমেলার সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
বহুদিন পরে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে দেখলাম। সান্ত্বনার কোনো ভাষা আমার মুখে জোগায়নি। কিন্তু তার অবয়বের এক ধূসর বিষণ্নতা আমার চোখ এড়ায়নি। মনে হচ্ছিল, তিনি তার মধ্যে নেই এবং তিনি এখানে নেই। বড় কষ্ট হল অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে দেখে।
সে অনুষ্ঠানে তিনি বললেনও ভারি সুন্দর - সেই ছিমছামভাবে। তার বক্তব্যের মায়াময়তা, বড় নরমভাবে গাঁথা বাক্যমালার মমত্ব, পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্মত্ব আমাকে মুগ্ধ করল। তিনি যে আমার পুস্তক প্রকাশনা উৎসবে এসেছেন, আমার বইয়ের কথা বললেন, তাতেই আমার মন ভরে থাকলো সারাক্ষণ।
সময়ের সিঁড়ি বেয়ে এ দীপন হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু তার পরেই ভাবি, কেমন আছে জলি, কী ভাবছে ওদের সন্তানরা। কিন্তু এ সব ভাবনা ছাড়িয়ে হৃদয়ে ভেসে ওঠে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মুখ। আমার মনে হয়, সে মুখ একজন সাধারণ মানুষের নয়, সে এক নিঃসঙ্গ সন্তের মুখ।
ড. সেলিম জাহান : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন