বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অবস্থা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে মার্কিন সাময়িকী ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’। নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ওপেন সোসাইটি ব্যারোমিটার (ওএসবি)-এর সমীক্ষার আলোকে নিবন্ধটি লিখেছেন মোবাশ্বের হাসান। কালবেলার পাঠকদের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন সরকার জারিফ।
বাংলাদেশের দোরগোড়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধীদল উভয়েই মনে করে নির্বাচনে তাদের পূর্ণ জনসমর্থন রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে এখন এটা বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, জনগণ আসলে কোন দলকে সমর্থন করছে। বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত এবং সমালোচনার ওপর সরকারের নানা পদক্ষেপে জনগণের কী ভাবনা- তা বোঝা বেশ কঠিন। বাংলাদেশে সর্বশেষ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের আমলে অনুষ্ঠিত দুই নির্বাচন নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এখন বাংলাদেশিরা দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে? ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ওপেন সোসাইটি ব্যারোমিটার (ওএসবি) এর সাম্প্রতিক জরিপ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে কিছুটা সাহায্য করবে।
আইআরআইর সমীক্ষায় জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৫ হাজার। তাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলা এবং ৮ বিভাগ থেকে মানুষরা এ সমীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এ সমীক্ষা। প্রতিষ্ঠানটি বিভাগীয় পর্যায়ে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) -এর আয়োজনও করে। অন্যদিকে আরেক গবেষণ প্রতিষ্ঠান ওএসবি বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশের প্রত্যেকটিতে এক হাজার পরিণত বয়সের মানুষের মতামত নিয়েছে।
যদিও আইআরআই মতামতবিষয়ক জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের ৫০ শতাংশ বিশ্বাস করে- গণতন্ত্রের অবস্থা হয় ভালো অথবা খুব ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে এর ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন পর্যায়ের জরিপ ভিন্ন চিত্র প্রকাশ করে। আইআরআইয়ের গবেষকদের অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ‘নড়বড়ে’ অবস্থায় আছে। তারা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের প্রধান গণতান্ত্রিক ঘাটতির মধ্যে রয়েছে বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতা। এ ছাড়া আরও রয়েছে- ভোট কারচুপি, বিরোধী মত দমন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার। দলীয় গণতন্ত্রের অভাবের মতো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারানোও আলোচনায় উঠে এসেছে। এক নারী আইআরআইকে জানিয়েছেন, ‘যদি আমি রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু বলি, তাহলে এর জন্য আমাকে প্রাণনাশের ভয়ে থাকতে হবে।’
ওবিএসের জরিপে অংশ নেওয়া দেশগুলোর জনগণের চেয়ে বাংলাদেশিরা খানিকটা ভিন্নমতাদর্শী। কারণ, বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে রয়েছেন ৩৬ শতাংশ মানুষ এবং অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের পক্ষে রয়েছে ২৮ শতাংশ মানুষ। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে সম্মান দেখানো এবং অন্যান্য সবার সঙ্গে নির্দিষ্ট ব্যক্তির অধিকারকেও সম্মান করা।
যদিও বাংলাদেশের কিছু বিশ্লেষক মানবাধিকারের বিষয়টিকে এড়িয়ে যান। তারা, কূটকৌশলকে বাংলাদেশি মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশের মানুষের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতি থেকে শুরু করে মানবাধিকারের প্রতি চরম আগ্রহ রয়েছে যা নীতিনির্ধারকদের আমলে নেওয়া উচিত।
ওএসবির জরিপ অনুযায়ী ৮২ শতাংশ মানুষ এটা জানিয়েছে মানবাধিকার তাদের বিশ্বাস ও আস্থাকে প্রতিফলিত করে। ৭৯ শতাংশ মানুষ মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিয়ে সরকারের দায়বদ্ধতা চায়। সম্ভবত সে কারণেই র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং বিরোধীদের কাছ থেকে জোরাল সমর্থন পেয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে আইআরআইর জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশিদের ৯২ শতাংশ ব্যালট বাক্সের রাজনীতিতে বিপুল আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তারা এটিও জানিয়েছেন, তারা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে চান। যদিও তাদের অনেকেরই ভোট নিয়ে কারচুপির বিষয়ে বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে। এদিকে বর্তমান সরকারের সমালোচকরা এ সমস্যাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অভিযোগও তুলেছেন।
জরিপকৃতদের ৮৭ শতাংশ বলেছেন, আওয়ামী লীগের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেওয়া উচিত। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তারা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন বা নির্দলীয় নির্বাচন প্রশাসনের প্রতি জনগণের সমর্থনের বিষয়টি আইআরআইর জরিপে উঠে এসেছে। খুব কম লোকই মনে করেন, এ বিষয়গুলো ছাড়া ২০২৪ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তবে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে এবং এ বিষয়ে অটল রয়েছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে কোনটি? আইআরআই এবং ওএসবি উভয়ের জরিপ অনুযায়ী উত্তর হলো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার নিম্নমান। ৫১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ঊর্ধ্বমূল্যের কথা বলেছেন। ওএসবির জরিপে ৫২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, ‘গত বছর থেকে তাদের পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করা কষ্টসাধ্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুর দিকে দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে জীবনযাত্রার সংকট নিয়ে এক দিনমজুরের মন্তব্য প্রকাশের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই দিনমজুর বলেছিলেন, ‘ভাত না দিতে পারলে স্বাধীনতা দিয়ে কী লাভ’। আওয়ামী লীগ সরকার শামসের বিরুদ্ধে ‘ভুল তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলার’ অভিযোগ করে।
রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ সরকার, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এবং নীতিনির্ধারকদের এই দুটি জরিপের ফলাফলের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। এ জরিপগুলোতে ত্রুটি থাকতে পারে, তবে মানুষের মনে কী চলছে তা জানার জন্য এগুলো দরকারি।
মোবাশ্বের হাসান : সিডনিভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক।
মন্তব্য করুন