ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের ভেতরেও বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাথাপিছু আয়ে ২০১৯ সালে ভারত ও ২০১৬ সালে পাকিস্তান— উভয় দেশকে পেছনে ফেলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বাইরের শক্তিগুলোর কাছে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা হিসেবে হাজির করেছে। তবে কূটনীতি ঢাকার স্থবির রাজনৈতিক চিত্রের প্রভাব পড়ছে।
বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সঙ্গী যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম বহাল রেখে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে চায়।
যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা সরকার দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ঢাকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শক্তির বিপরীতে ভারত সরকার প্রতিবেশীর বিদ্যমান সরকারের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে আঞ্চলিক প্রধান শক্তিগুলোর প্রতি বাংলাদেশের চরিত্র আগামীতে কী হবে, তাও নির্ধারণ হবে।
যেহেতু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকার চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হতে চলেছেন। নীতিনির্ধারকরা এ কারণে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখছেন। দিল্লির সঙ্গে সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আসন্ন নির্বাচন এবং ঢাকার সমস্যাগ্রস্ত রাজনীতি বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, দুর্নীতি এবং দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার যথা আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মধ্যকার চিরায়ত দ্বন্দ্বে জর্জরিত।
প্রতিবার নির্বাচন আসলেই বিরোধীদলের বিক্ষোভ এবং এ-সংক্রান্ত সহিংসতা তীব্র হয়। এদিকে সরকার খালেদা জিয়ার মতো বিরোধী নেতাদের গৃহবন্দি করে রেখেছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিরোধী দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলের পদত্যাগের দাবি তুলেছে। অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতার বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং দুই দলের বিক্ষোভকারীরা বারবার একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত সাত হাজার মানুষ আহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বে ইন্দো-প্যাসিফিকের চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপআঞ্চলিক জায়গার একটি দক্ষিণ এশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক নিয়ে আগ্রহী হওয়া বাংলাদেশের জন্য এ বার্তা দেয় যে, দেশটি বেইজিং বা ওয়াশিংটনের সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে যাবে। ওয়াশিংটনের নীতি ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী স্বচ্ছ নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার কথা বলা হলেও এটার অর্থ এমন নয়, ঢাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ ব্যতীত ঢাকা বহুমুখী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে। যা বিশ্বের ক্ষমতাধর পরাশক্তি ওয়াশিংটনের কৌশলগত বাধ্যবাধকতার বিপরীত একটি রীতি। ২০২১ সালের পর থেকে এসব নিয়ে কিছু দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্যারা-মিলিটারি বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ওয়াশিংটন ও ঢাকার সম্পর্কের আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। এরপরেও বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গার্মেন্টসের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার। এটি ওয়াশিংটনকে চীনের উৎপাদিত পণ্য থেকে দূরে থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য পেতে সহায়তা করে। এটি ঢাকাকে উচ্চমূল্যের রপ্তানি খাত যেমন চামড়া ও হালকা প্রকৌশল শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
চীনের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান রয়েছে।
যাইহোক, জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বহুল প্রত্যাশিত জয় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। যদি নির্বাচনটি সুষ্ঠু না হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব আরও তীব্র আকার ধারণ করবে এবং তা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
এটি দুই দেশের চুক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন- সম্প্রতি পাশ হওয়া অ্যাকিউজিশন ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) এবং জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভাব্য রাজনৈতিক কারণে প্রভাব ফেলতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ দেখানোর ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
চীনের ভূরাজনৈতিক সম্প্রসারণ নীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করেছে। চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বছরের পর বছর ধরে এই প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে। উভয়পক্ষই বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে চীনা বিনিয়োগ চেয়েছে।
আওয়ামী সরকারের অধীনে ২০১৬ সালের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উদ্যোগে চীনের সহযোগিতার আধিক্য রয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল যে কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। বেইজিংয়ের নীতিনির্ধারকরা দিল্লি এবং ওয়াশিংটনকে হাতের কাছে রাখতে ঢাকার সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক সমঝোতা বজায় রাখতে চায়।
চীনের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সুযোগের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, বেইজিং নয়াদিল্লির মতো ঢাকার সঙ্গে ঐতিহাসিক সংযোগে আবদ্ধ নয় অথবা ওয়াশিংটন যেভাবে ডলারের শক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করেছে তাও ঢাকার নেই। ঢাকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নয়াদিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। স্বাধীনতায় ভূমিকা রাখার কারণে শুরু থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়— নীতি বাস্তবায়িত করতে চায়। বিগত বছরগুলোতে ওয়াশিংটন ও দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও বেগবান হয়েছে। চীনের প্রতি সক্রিয় নীতি গ্রহণের চেয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ভেতর এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষায় ওয়াশিংটনের মনোযোগী হওয়া উচিত।
মধ্য আগস্টে ভারত থেকে বাংলা ভাষার প্রচারিত একটি পত্রিকায় ভারতীয় আইনপ্রণেতারা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নের বিপক্ষে উদ্বিগ্ন বলে সংবাদ প্রচার হয় যেটি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে ভারতের বাহ্যিক সার্বভৌম প্রভাবহীন বহু মেরুকরণের পৃথিবী গড়ার আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক সার্বিক নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেইজিং ও ওয়াশিংটনের বিপরীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সফরে অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে রক্ষায় ভারতের ধারাবাহিক চেষ্টা দেশটিকে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখছে। উভয় দেশ কুশিয়ারা নদীর দীর্ঘদিন দিন ধরে চলে আসা জলবণ্টন বিরোধের সমাধানে পৌঁছেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে সম্প্রসারিত করেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাধিক দিনের সফরে তিনি ভারতকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দেশটির তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।
পরিশেষে, বাংলাদেশ নিজেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করে যেটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিষয়ে হস্তক্ষেপ ছাড়াই বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে। তাহলে দাঁড়ায়, যেসব রাষ্ট্রের আওয়ামী শাসনের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য বিরোধ ন্যূনতম তারা তাদের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে কাজে লাগাতে পারবে। হতে পারে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভারতের কাছে কম সম্পদ রয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে একই ভূখণ্ডের অংশ হওয়ার কারণে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
অর্থাৎ, জানুয়ারির নির্বাচন সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে প্রভাব রাখবে।
সাবা সাত্তার : ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়ন বিষয়ক বিশ্লেষক।
মন্তব্য করুন