বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বেশ সরব দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে। সম্প্রতি এ বিষয়ে আবারও বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই বিবৃতির প্রেক্ষাপটে যে কোনো ধরনের বহিরাগত হস্তক্ষেপ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে চীন। চীনের সাম্প্রতিক এ বক্তব্য ভারতের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আকসাই চীনকে নিজস্ব ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখিয়ে মানচিত্র প্রকাশ করেছে চীন সরকার। ভারত চীন সরকারের এই অবৈধ দাবির বিরুদ্ধে যত প্রতিক্রিয়াই জানাক না কেন চীনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কাজ বারবার ঘটছে।
ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের মতো প্রকল্প স্থাপন করে এসব দেশে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে চায় চীন সরকার। চীন চাইছে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশগুলোকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো উদ্যোগের অংশ বানাতে।
চীনের লক্ষ্য- আঞ্চলিক সংযোগের মাধ্যমে এই দেশগুলোর অর্থনীতিকে একীভূত করা।
এমন অনেক গবেষণা রয়েছে, যেখানে চীনা ঋণের গভীর এবং গুরুতর খারাপ প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর বিকল্পের অভাবে দেশগুলো এখনো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীনা ঋণের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে বাংলাদেশের যোগসূত্রকে ব্যাখ্যা করা যায়। চীন যে ঋণ ফাঁদ নীতি অনুসরণ করে চলেছে তার ফল শ্রীলঙ্কায় দেখা গেছে এবং শেষ পর্যন্ত সবার জন্য সেই একই ফল বয়ে আনবে। আর এর প্রভাব পড়বে ভারতের ওপরও।
ভারতের উচিত এখনই সম্ভাব্য সেই প্রভাবকে অনুধাবন করা এবং সেই প্রভাবকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য পথ খুঁজ রাখা।
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই। বাংলাদেশের অর্জিত সেই স্বাধীনতায় একটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছিল ভারত। আশ্চর্যজনকভাবে, জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছিল চীন। স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে জাতিসংঘে চীন তার ভেটো ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছিল।
আর আজ বাংলাদেশকে রক্ষা করার কথা বলছে চীন। চীনের সাম্প্রতিক বক্তব্য তার অতীতের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বাজার দখল করাই চীনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
বিশেষ করে, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতিমালা চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীনা ঋণ পেয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য চীনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঝুঁকির দিকে নিয়ে যায়।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য হলো- চীনের ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মুদ্রায় পরিণত করা। আর এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা হ্রাস করতে চায় চীন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে চীন যেসব দেশকে সঙ্গে পেতে চায় তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। কারণ বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের রয়েছে একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং প্রচুর শ্রমশক্তি।
উপরন্তু, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য, বিশেষ করে ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চীন সবসময় তার নীতির মাধ্যমে ঘৃণার ফাঁদ পেতেছে। তারা ঘৃণা ছড়ানোর কূটনীতিতে লিপ্ত এবং এর লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশও। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই এই লক্ষ্যের শিকারে পরিণত হয়েছে।
এশিয়া প্যাসিফিক বিষয়ে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের মতো সংস্থাগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অনুসন্ধানও এই দাবিগুলোকে সমর্থন দেয়। অনুসন্ধানগুলোতে উল্লেখ করা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বড় আকারের অনুদান বাজারের অপ্রতুলতার কারণে এই দেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিরাপদ নয়। অপর্যাপ্ত ঋণ ব্যবস্থাপনা এই দেশগুলোর জন্য সম্ভাব্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
সম্প্রতি ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত কয়েক বছরে জাতীয় নিরাপত্তার কারণে অনেক চীনা বিনিয়োগ ফিরিয়ে দিয়েছে ভারত। অতীতে, বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এশিয়া-আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর প্রতিষ্ঠা করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের চীনা হুমকি মোকাবিলার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এখনো ভারত চীনা হুমকি মোকাবিলায় এটিকে একটি বিশেষ এবং কৌশলগত পথ হিসেবে দেখছে।
ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, যে দেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে তাদের অবশ্যই কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিধানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে এসব দেশকে তাদের মানবিক চাহিদার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দিতে হবে। আর সেই মানবিক চাহিদার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো হলো- জাতি হিসেবে পরিচয়, নিরাপত্তা, স্বীকৃতি, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচার।
অভিনব মেহরোত্রা ও বিশ্বনাথ গুপ্তা : লেখকদ্বয় উভয়েই ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক। ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন