কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে নির্বাচন অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বেশকিছু বিদেশি দেশ আগ্রহী ও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের আগামী নিবার্চন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কেমন হতে পারে—সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত সিডনিভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক মোবাশ্বের হাসানের এক নিবন্ধে উঠে এসেছে।
কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসলেও নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলগুলোর মাঝে মতবিরোধ এখনো চরমে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করলেও তা মেনে নিতে নারাজ আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, এমন ধারণা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে বিএনপি।
যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হওয়াই উচিত। তবে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বেশকিছু বিদেশি দেশ আগ্রহী ও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকটি দেশ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে সৃষ্ট অচলাবস্থার দিকে নজর রাখছে। তাদের কেউ কেউ আবার কোনো না কোনো পক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। আবার কেউ কেউ কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে তাদের ভিন্ন অবস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুই দেশেরই ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা বলা যায়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে জোর প্রচার চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন এ প্রচারাভিযানে ভারতের সমর্থন আদায়ে তখন বেশ কয়েকবার নয়াদিল্লি সফর করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত। যদিও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে সমর্থনে ভারতীয় অবস্থানই মেনে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র (তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন)—দুই দেশই আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে দৃশ্যত সম্মত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমন ও উন্নয়নের যে ব্যাখ্যা দেন, তা ওয়াশিংটনের সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে মিলে যায়।
তবে এবার হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলায় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। আর এটিই বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের পরপর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে বাধা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত এমন বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছে বাইডেন প্রশাসন। এটাকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পরিকল্পনার সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
তবে প্রতিবেশী ভারত আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ দমন এবং বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকেই শক্তিশালী মিত্র হিসেবে দেখে নয়াদিল্লি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে চারটি ট্রানজিট রুটের অনুমোদন দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশ সরকারের এমন পদক্ষেপে স্থলবেষ্টিত ভারতীয় এই উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই বিকশিত হয়নি, এ অঞ্চল নিয়ে ভারতের নীতিও জোরদার হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ওয়াশিংটনের অব্যাহত চাপ ভালোভাবে নেয়নি নয়াদিল্লি।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল মার্কি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ভারতের অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে। এটি সত্য নয়। ওয়াশিংটন চাইছে, একটি গণতান্ত্রিক অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ এর সম্ভাবনা অর্জন করুক। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি দ্রুত উদীয়মান অর্থনীতি হোক।
ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র আসল কী চাইছে, তা নিয়ে ভারত সন্দিহান। এ কারণে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সংকুচিত হচ্ছে। যদিও ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে সামগ্রিক সম্পর্ক আগের চেয়ে উষ্ণ।
নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যারিল্ড এঙ্গেলসেন রুড বলেন, আসলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনো শক্তিশালী ছিল না। এবারের নয়াদিল্লির জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন থেকে এটা বেশ স্পষ্ট যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি দিল্লি ঘোষণায় ভারতকে খুশি করতেই রাশিয়ার নাম উল্লেখ করা নিয়ে জোরাজুরি করেনি ওয়াশিংটন।
আগামী দিনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পথে যাবে, এবারের নয়াদিল্লির জি-২০ সম্মেলনই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে বলেও জানান তিনি।
রুডের মতে, ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের ক্ষমতায় থাকবে মোদি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নির্ভর করছে। চীনকে মোকাবিলায় মোদিকে খুশি রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের।
তাহলে কি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানই মেনে নেবে বাইডেন প্রশাসন? জি-২০ সম্মেলনে বাইডেন, মোদি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের মতো বিশ্বনেতারা শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্রেমবদ্ধ হয়েছেন।
নয়াদিল্লি সম্মেলনের পরপর বাংলাদেশের দুই প্রভাবশালী মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান ও নাসিরুদ্দিন এলানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের একটি বিক্ষোভে রাষ্ট্রচালিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদনের দায়ে তাদের এ সাজা দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকার তাদের ওই প্রতিবেদনকে ‘ভুয়া, বিকৃত ও মানহানিকর’ বলে দাবি করেছে।
৭৮তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে শেখ হাসিনা এখন নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। বাইডেনের আয়োজনে এক নৈশভোজে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে তার।
এদিকে চীনের অর্থায়নে মোংলা বন্দরের উন্নয়ন কাজে সম্মতি দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। মোংলা বন্দরটি ভারতীয় সীমান্তের কাছে। শেখ হাসিনার এমন সিদ্ধান্ত তার ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাসের ইঙ্গিত দেয়। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও চীনের দরজাও তিনি খোলা রেখেছেন। আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক দিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে ভারত। কেননা আওয়ামী লীগ চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখে চলেছে।
এ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন পথে গড়াবে, তা অনুমান করা মুশকিল। তবে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অচলাবস্থা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশে সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
মোবাশ্বের হাসান: সিডনিভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক
ভাষান্তর: এম. শাহীন
মন্তব্য করুন