বাংলাদেশ ব্যাংক যে নতুন মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্ট দিয়েছে সেটাকে স্বাগত জানাই । কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মনে হচ্ছে নীতির পরিবর্তন হচ্ছে এবং এরকম একটা পরিবর্তন আশা করি সামনের দিনগুলোতেও—তবেই ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু তারপরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে ।
প্রথমত, একটা জিনিস একদমই পরিষ্কার না, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সুদের হারের ওপর যে ক্যাপটা বজায় রাখা হলো—সেটা যে আসলে সে রকম কোনো সুফল বয়ে আনেনি সেই বিষয়টা কিন্তু স্বীকার করা দরকার ছিল । যে উদ্দেশ্যে এই কাজটা করা হয়েছিল, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে, আসলে আমরা সেরকম কোনো ফলাফল দেখিনি। সুতরাং আমাদের কাছে মনে হয়, সেরকম একটা আত্মসমালোচনার জায়গা দরকার ছিল।
দ্বিতীয়ত, যে পলিসি ইন্টারেস্ট রেট করিডরের কথা বলা হচ্ছে এটা এখনো নিশ্চিত করছে না—সুদের হার আসলেই বাজারভিত্তিক হবে কিনা। কারণ, বলা হচ্ছে রেফারেন্স ইন্টারেস্ট রেট হবে ট্রেজারি বিলের ১৮২ দিনের এক ধরনের একটা গড় এবং সেই রেফারেন্স ইন্টারেস্ট রেটের সঙ্গে ৩ শতাংশ একটা মার্জিন যোগ করে লেন্ডিং রেটটা হবে। এই মার্জিন নন ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ শতাংশ হবে এবং সিএসএমইর জন্য ১ শতাংশ অতিরিক্ত সুদ আরোপ করা যাবে। এখানে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিলের অকশনে কম ইন্টারেস্ট রেট অফার করার মাধ্যমে এই ট্রেজারি বিলের ইন্টারেস্ট রেট নিম্নমুখী রেখে দিয়েছে কিনা? এই ধরনের অকশনে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম ইন্টারেস্ট রেট অফার করে তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না l যার কারণে এই ট্রেজারি বিলের যে ইন্টারেস্ট রেট আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সেটাকে বাজারভিত্তিক বলার অবকাশ কম। এখন দেখার একটা আগ্রহ থাকবে, নতুন মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্টের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিলের অকশনের ক্ষেত্রে তার অবস্থানে কোনো পরিবর্তন করে কিনা।
তৃতীয়ত, আমরা এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে একটা ভালো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি যেখানে বলা হচ্ছে—বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেট করা হবে এবং এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ধরনের হার দেখছি, সেই হারগুলোকে ইউনিফাইড করা হবে। দেখার আগ্রহ থাকবে কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই নতুন কৌশল কার্যকর করে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে ইউনিফাইড হার কার্যকর করা কঠিন হবে ।
চতুর্থত, আমরা রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি সেটা অবশ্যই নিম্নমুখী অথবা প্রবৃদ্ধি খুবই কম । বলা হচ্ছে, সামনের অর্থবছরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়বে । কিন্তু, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ শুধু ২ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহে বড় ধরনের উন্নতি আশা করা ঠিক নয় । রেমিট্যান্স কম আসার পেছনে হুন্ডির বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে এবং হুন্ডি ব্যবসার পেছনে রয়েছে এদেশ থেকে টাকা পাচারের বড় ধরনের ঘটনা । সুতরাং টাকা পাচার, ক্যাপিটাল ফ্লাইট, মানি লন্ডারিং এগুলোকে বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা কম।
পঞ্চম, খেলাপিঋণ কমানোর ক্ষেত্রে কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো সুস্পষ্ট করা হলে ব্যাংকিং খাতের ওপরে আস্থার জায়গাটা আরও শক্ত হতো। এই মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্টে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথাগুলো বলা নেই।
ড. সেলিম রায়হান : নির্বাহী পরিচালক, সানেম
মন্তব্য করুন