বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই নির্বাচনমুখী। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চ সামনে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে জোট গঠিত হয়, নতুন নতুন দলের আবির্ভাব ঘটে। বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবনার কোনো বিষয় আছে বলে মনে হয় না। এমন প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ নতুন কোনো বিষয় নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন সভা-সমাবেশ সামনে আরও বেড়ে উঠবে। তবে এবার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে; সেটি হলো জোটের রাজনীতির বাইরের রাজনীতি।
নব্বইয়ের দশক থেকে আমাদের এখানে কোয়ালিশনের রাজনীতি গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন একটি জোট এবং অপরটি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। দুটি জোট বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা লম্বা সময় ধরে ছিল। এখন সেখানে একটি ছোট পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি। দলগুলো কোয়ালিশনে থেকে আন্দোলন করছে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলো খুব খুশি বিষয়টি এমন বলা যাবে না। জোটবদ্ধ রাজনীতি থেকে দলগুলোর আলগা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এরই মধ্যে প্রতীয়মান হয়। সেটির একটি বড় প্রমাণ আমরা পেলাম প্রায় ১০ বছর পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ। সরকারের কাছ থেকে তারা অনুমতি নিয়ে সমাবেশটি করেছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় কোনো ঘটনা নয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক চর্চার স্পেস বাড়ানোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। সেটি বর্তমান সরকারও বারবার বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য কাজ করছি।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে সরকার প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের (বিএনপি তালিকা দেয়নি) কাছ থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে কমিশন গঠন করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। ফলে আওয়ামী লীগ ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। সেটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি ছিল। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য তারা সরকার গঠন করে দেশ চালিয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনও ত্রুটিমুক্ত ছিল না। সরকারের বিভিন্ন নেতারাও এটি বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন। সরকারি দল চায় গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বজায় রাখা। এগুলো অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি তারা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চাও বজায় রাখতে চায়। এ বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের যারা বন্ধু রাষ্ট্র আছে, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র একই জিনিস চায়। যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মিল ঘটে যায় সেখানে মাঠের ইস্যুগুলো এত বড় করে দেখার সুযোগ নেই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড গঠন করা দরকার। এদিকে সরকারের যেমন আগ্রহ আছে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের যারা বন্ধু বিশেষ করে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক বা দূরের দেশগুলোও আগ্রহী।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বর্তমানে বড় একটি আলোচনার বিষয় হলো অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটি এরই মধ্যে মীমাংসিত। এটি ফেরত নিয়ে আসার কোনো সুযোগ আর নেই। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কি ঘটনা ঘটেছিল তা আমাদের সবার জানা। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়েও সমালোচনা আছে। তা ছাড়া উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের আদেশ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার। তবে সরকার চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে পারে, এটি ছিল আদালতের পরামর্শ। এখানে পরামর্শ ও আদেশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আদালত আদেশ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের। সাথে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা বাধ্যতামূলক ছিল না। সরকার ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ পদ্ধতি বাতিল করেছে।
সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কম-বেশি আস্থার জায়গা তৈরি হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যাটাই হলো আস্থার সংকট ও সাংঘর্ষিক অবস্থা। সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। একটি রাজনৈতিক দল আরেক দলকে বিশ্বাস করে না। জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানোর যে বিষয়টি সেটি আমরা তৈরি করতে পারিনি। নির্বাচনই শুধু গণতন্ত্র চর্চা নয়। নির্বাচন ছাড়াও আরও অনেক বিষয় রয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখানে গড়ে ওঠেনি। আমরা কদাচিৎ দেখি, আমাদের সরকারি দলের নেতা ও বিরোধী দলের নেতা একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন এবং চা পান করছেন। এসব বিষয় যত বেশি করা যাবে ততবেশি রাজনৈতিক আস্থা তৈরি হবে।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনো কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে এবং তাদেরই একটি সমঝোতায় উপনীত হতে হবে কীভাবে তারা সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর কিছু মানুষকে ধরে এনে নির্বাচন পরিচালনা করা কোনো টিকসই সমাধান নয়। এ কথা ইতোমধ্যে প্রমাণিত।
(লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞন বিভাগের অধ্যাপক)
মন্তব্য করুন