বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দল দুটির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে মতভেদ চলছে। এই মতভেদকে সাধারণত দুইভাবে দেখা হয়। কেউ কেউ একে আদর্শগত দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেন, আবার কেউ কেউ একে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা রক্ষার বিরোধ হিসেবে দেখেন। দু’ভাবেই দেখা যেতে পারে, দুটির মধ্যেই আংশিক সত্যতা রয়েছে। কোন অংশটা প্রধান তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে এবং ঐতিহাসিক কারণে তা অস্বাভাবিক নয়। ১৯৭৫-এর আগে পরে আওয়ামী লীগের আদর্শ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মাত্রা অবশ্যই একরকম নয়। আবার জিয়া উত্তর খালেদা-তারেকের নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং অতীতের জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও একরকম নয়। সুতরাং গতির মধ্যেই দল দুটির বিচার করা উচিত। তারপরও আমরা বর্তমান মুহূর্তে এসে দেখব যে, তাদের পার্থক্যগুলো ক্রমে কমে এসেছে, কমতে কমতে তা এখন অধিকাংশের চোখে ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা দখলের পার্থক্যে পর্যবসিত হয়েছে। যদিও কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে বা বিশেষ প্রশ্নে মন্দের ভালো কে- এ নিয়ে চুলচেরা অনেক বিশ্লেষণ থাকতে পারে।
আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিএনপির ইতিহাসের চেয়ে আলাদা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘকালের পুরাতন দল। তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। যদিও তখনো আওয়ামী লীগে কনফেডারেশন ও আমেরিকাপন্থি একটি শক্তি উপস্থিত ছিল। অন্যদিকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পরে সামরিক চ্যানেলের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আদর্শ হিসেবে ধারণ করে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বলতে আসলে কোন জাতীয়তাবাদকে বোঝানো হচ্ছে তা অস্পষ্ট।
বঙ্গ নামে একটি বৃহৎ এলাকা আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ঐতিহ্যসম্পন্ন নৃগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চল ১৯৭১ সালে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এর নাগরিকরা তাদের পাসপোর্টে সবাই নিজেদের ‘বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সুতরাং ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি নাগরিকত্বের সূচক, জাতীয়তার সূচক নয়। তবে এই যুক্তি মেনে নিলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন জাতির পার্থক্যের স্বীকৃতিও দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্য কেউ ভারতের নাগরিক হয়েও বাঙালি হতে পারেন। আবার কেউ বাংলাদেশি বাঙালি বা চাকমা হয়েও অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন। নাগরিকত্ব রাষ্ট্রীয় আইনের ওপর নির্ভরশীল এবং আইনি হলে একাধিক নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ রয়েছে। এ জন্য প্রবাসী বাঙালি যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই তাদের বাঙালিই ধরা হয় ও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভোটাধিকার আছে। কিন্তু জাতীয়তা নির্ধারিত হয় ভাষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি অনেক কিছুর ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সমপাতন দ্বারা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে নাস্তিকদের মঞ্চ। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চকে তখন আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল-স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে। যদিও সেখানে তাদের কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সেই সমর্থনের কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তখন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেই করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী এখনো বহাল তবিয়তে আমাদের আশপাশে আছেন যারা আইনের দৃষ্টিতে ক্রিমিনাল নন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়তো করেননি।
সাবেক চীনপন্থি রাজনীতিবিদ ও সাবেক মুসলিম লীগপন্থি অনেকেই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন বিএনপি তৈরি হলো তখন তাদের কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। একসময় পাকিস্তানের মিত্র চীনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। চীনের সঙ্গে তখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএনপির সঙ্গে হয়তো এখন চীনের এতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। কারণ, চীন আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে পদ্মা ব্রিজসহ অনেক বড় বড় মেগা প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। তবে সাবেক চীনপন্থিরা এখন নানা দলে বিভক্ত হয়ে কেউ আওয়ামী সমর্থক, কেউবা বিএনপি সমর্থক, কেউবা পৃথক দল তৈরি করে আওয়ামী সমর্থক হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই বর্তমানে সরাসরি চীন বিরোধিতা করছে না।
অন্যদিকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের শক্তিশালী একটি অংশ আমেরিকাকে তাদের পক্ষে রাখতে চাইছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমেরিকা তাকে ক্ষমতায় রাখতে চায় না’। সুতরাং মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব এই মুহূর্তে বাড়ার দিকে অগ্রসরমাণ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের বন্ধু ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে কিনা তেমন একটি প্রশ্নও উঠে আসে। এটা ঠিক, বিএনপি যখন প্রথম ক্ষমতায় ছিল তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়েছিল। বিশেষ করে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব ছিল। ভারত একসময় মনে করত- পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ‘সাত বোন’ এলাকায় ভারতের যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকারী রয়েছে তাদের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। একই সঙ্গে আমরা দশ ট্রাক অস্ত্রের কথাও জানি। নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনা করলে ভারত হয়তো এখনো বাংলাদেশে বিএনপিকে নয় বরং আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। বিএনপি অবশ্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতকে এখন নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চায়। সব মিলে দেখা যাচ্ছে- বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থান অভ্যন্তরীণ জাতীয় প্রশ্নেও পৃথক। একইভাবে পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকেও পৃথক। এমনকি ইতিহাসের দিক থেকেও পৃথক। এসব কারণেই অনেকেই এটাকে বলেন আদর্শগত মৌলিক বিরোধ। কিন্তু আমি এটাকে মৌলিক বিরোধ হিসেবে দেখি না। কারণ যে মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে একটি সরকারের চরিত্র নির্ধারিত হয় সেটি উভয়েরই এক। তারা উভয়েই বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন এবং বর্তমানে দল দুটি যারা পরিচালনা করছেন তাদের বেশির ভাগই হচ্ছেন বড় বড় ব্যবসায়ী। ধনিক শ্রেণির সদস্য। মধ্যবিত্ত জনগণ এদের দলে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন না।
সম্প্রতি আয়োজিত ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথাই জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এটা পরিষ্কার, ব্যবসায়ীরা সব সময় চান সরকার তাদের অনুকূলে থাকুক। কারণ আমাদের এখানে মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাপিটালিজম (State sponsored Capitalism) গড়ে উঠেছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামো। ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামো হলো সুযোগসন্ধানী ‘অসৎ ব্যবসায়ী’, ‘অসৎ রাজনীতিবিদ’ ও ‘অসৎ আমলাদের’ একটি যোগ সূত্র (Nexus)। সত্যিকারার্থে তারাই দেশ চালায়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেই সরকারে থাকুক না কেন এই ক্ষমতা কাঠামো একই থাকবে। কারণ তারাই অর্থ সরবরাহ বা বিনিয়োগ করে দলগুলোকে চালায়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্বটা তাই বহুলাংশে ক্ষমতা রক্ষা করার এবং ক্ষমতা দখল করার দ্বন্দ্ব। এটা নতুন কিছু নয়। খোদ আমেরিকাতেও এজন্যই ধনপতি হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, নির্বাচনে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যেই জিতুক না কেন, আমি কখনো হারি না।
বাংলাদেশে বিদ্যমান দ্বি-দলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ১৯৯০ উত্তর দশকগুলোতে কিছুদিন আপাত গণতন্ত্র ছিল। দুই দলের মিউজিক্যাল চেয়ারের সেই গণতন্ত্র অবশ্য বেশি দিন টেকসই হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই এই দুই দলের দ্বন্দ্ব চরম বৈরিতায় পরিণত হয়েছিল এবং এক দল জিতলে অপর দলকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করার পথে অগ্রসর হন তারা। ফলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সিস্টেমটি winner take all system -এ পরিণত হয়েছে। যেটা এখন নানাবিধ জটিলতা, ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিতিশীলতা ও আপসহীনতার জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি ব্যক্তিগত ফ্যাক্টর। সেটা হলো আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন। তিনি জানেন বা বিশ্বাস করেন, তার পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছে বিএনপির সঙ্গে তাদের এখনো যোগাযোগ রয়েছে। তিনি এটাও জানেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ রয়েছে। বিএনপি সেটা গোপনও করে না! বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখন একটি কৌশল নিয়েছেন, সেটা হলো- ইসলামপন্থি দলগুলোকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা। তিনি এই কাজটি শুরু করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রশ্নে তার মধ্যে একটি দোদুল্যমানতার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য এক্ষেত্রে কমে গেছে। এখন উভয় দলের সাধারণ সমর্থকের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। দুটি দলের সাধারণ অসচেতন সমর্থকদের মধ্যে এখন পার্থক্য হলো একজন শুধু বঙ্গবন্ধুর নাম প্রচার করে আরেকজন শুধু জিয়াউর রহমানের নাম প্রচার করে। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মনে করেন, অতীতে আদর্শের ছিটেফোঁটা যাই থাকুক না কেন বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বটি দুটি ‘টোটেম’ নিয়ে দুটি ট্রাইবের ঝগড়ায় পরিণত হয়েছে। এটা এত বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে যে, রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যা এবং বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই।
এই দ্বন্দ্বটা আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখার দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে বিএনপির কাছে এই দ্বন্দ্বটা ক্ষমতায় আসার দ্বন্দ্ব। প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে দলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এবার যদি আমরা ক্ষমতায় যেতে না পারি তাহলে আমাদের চামড়া থাকবে না। অর্থাৎ এখানে তিনি নিজের এবং নিজের দলের বেঁচে থাকার প্রশ্নকে সামনে এনেছেন। বিএনপি মনে করছে, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছে তারা যদি এখন ক্ষমতায় যেতে না পারে তাহলে দলকে আর ধরে রাখাই সম্ভব হবে না।
ভবিষ্যতে আদর্শভিত্তিক দলগুলো ছোট হয়ে গেলেও টিকে থাকবে। যেমন : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে হাজার অত্যাচার বা নিপীড়ন করা হোক না কেন তারা টিকে থাকবে। তারা বিশ্বাস করে বিশ্বব্যাপী ইসলামী হুকুমত কায়েম করলেই তাদের মুক্তি। সেটার জন্য তারা মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছে। তাই জামায়াতের আদর্শে যারা বিশ্বাস করেন তারা তাদের রাজনীতি করবেন। তারা হয়তো বিভিন্ন সময় নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করতে পারে। যেমন কখনো তারা বিএনপি আবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে অ্যালায়েন্স করতে পারে। কিন্তু তাদের একটি আদর্শিক চরিত্র রয়েছে, বাইরের মুখোশ যাই হোক না কেন। উল্টো দিক থেকে আদর্শবাদী ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র বামপন্থিদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। তারা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়। সুতরাং তাদের যতই মারা হোক বা নির্যাতন করা হোক তারা ধনিক শ্রেণির সঙ্গে থাকবেন না।
এই দুই বিপরীত আদর্শগত দল বাদ দিলে অবশিষ্ট যে দলগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে নানা রকম ক্ষমতার সমীকরণ (Equation of Power) ঘটছে। এই ইকুয়েশন অব পাওয়ারের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনীতি মসৃণভাবে চলবে নাকি চলবে না। তবে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-বিএনপির ইকুয়েশনটা ঠিকমতো মিলছে না।
২০১৮ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছিল বিএনপির। কিন্তু তখন সে দাবি পূরণ না হলেও, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে প্রশাসনকে দিয়ে ভোট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন অনেকে। অনেকে বলেন, বিএনপিকে যে ৮০টি সংসদীয় আসন দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল সেটা রক্ষা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সুতরাং সেবার বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচনে গেলেও এবার তারা সেটা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এবং সেটার লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটা প্রবাদ আছে- ন্যাড়া দুবার বেলতলায় যায় না।
তবে আগামী নির্বাচন বিএনপি ঠেকিয়ে দিতে পারবে কিনা বা নির্বাচন ঠেকিয়ে দেওয়ার সেই ক্ষমতা বিএনপির আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলই যে কোনো সময় লক্ষাধিক লোক জড়ো করতে পারে। কিন্তু দুই দলের কেউই নিজের সমর্থনে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন বিএনপি তাদের সর্বশেষ বৃহৎ কর্মসূচিতে ঢাকায় মহাসমাবেশে অনেক লোক জমায়েত করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা দেখেছি, ঢাকায় পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে স্কুলের বাচ্চারা তাদের মতো আন্দোলন করছে। এখানে দেখা গেছে, বিএনপি তাদের জন্য কোনো ইস্যু নয়। অথচ গণঅভ্যুত্থান মানে, যারা কোনো দল করে না বা কোনো দলের কর্মী নয় এমন সাধারণ মানুষেরও রাস্তায় নেমে আসা। সেটি এখন পর্যন্ত হয়নি। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করার মতো কোনো দল বাংলাদেশে নেই।
আবার আওয়ামী লীগ যে অনেক উন্নয়ন করেছে এবং মানুষ তাদের দলে দলে আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে বলে দাবি করে সেটাও ঠিক না। কারণ আওয়ামী লীগের উন্নয়নের মধ্যে অনেক ধরনের নেতিবাচক বিষয় রয়েছে। আমরা খুব সংক্ষেপে যদি কয়েকটি বিষয় বলি যেমন- ব্যাপকভাবে বৈষম্য বেড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময় ধনী এবং গরিবের মধ্যে যে ব্যবধান ছিল সেটি অনেক বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা হয়তো কমেছে। এর পরেও দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ ধরলেও ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র। তিন কোটি মানুষের অসন্তুষ্টি কম বড় বিষয় নয়। এই তিন কোটি মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি থাকত না যদি তারা দেখতেন, তারা কম পাচ্ছেন কারণ তারা কম কাজ করছেন বা কম পরিশ্রম করছেন। কিন্তু বিষয়টা ঠিক তার উল্টো। তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন- যারা চুরি করছে, বাটপাড়ি করছে, যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সেটাও শোধ করছে না, যারা অবৈধভাবে টাকা বানাচ্ছে এবং তা পাচার করছে, যারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে, শাসক দলের আনুকূল্যপ্রাপ্তরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানেও সেটি প্রতিফলিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যখন আয়বৈষম্য পরিমাপ করা হয় তখনও দেখা গেছে ধনী এবং গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর কাছাকাছি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর ঘরে যাওয়া মানে সেটা বিপৎসীমা অতিক্রম করা।
কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আয়বৈষম্যের সেই এজেন্ডা দিয়ে বাংলাদেশে বৃহৎ কোনো লড়াই হচ্ছে না। শাসকদলের ধারণা, গড় প্রবৃদ্ধিই উন্নয়ন, উন্নয়নের ধরন বা বৈষম্য নিয়ে ভাবনার সময় আসেনি। কিন্তু সর্বশেষ একটি জরিপে জানা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন ‘অর্থনীতি ভুল পথে চলছে’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট)। এ কথা ঠিক, বাংলাদেশে এসব এজেন্ডায় লড়াই হলে হয়তো একটা জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা ছিল। তখন লড়াইটা জনগণের প্রিয় ইস্যু হতো। বিএনপি মুখে সেই এজেন্ডার কথা বললেও তারা শেষ বিচারে ধনিক শ্রেণির একাংশ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।
গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বর্তমান সরকারকে সরানোর আর মাত্র দুইটা পথ থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ অথবা অগণতান্ত্রিক অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান। তবে দেশে যারা যারা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতার বদল ঘটাতে ভূমিকা রাখতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে সন্তুষ্ট করে রেখেছে। এর বাইরে দেশে যে আমলাতন্ত্র রয়েছে তারাও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এমনকি আমলাতন্ত্র এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেয়েও অধিকতর মর্যাদা পাচ্ছে। সুতরাং সেদিক থেকেও কোনো ধরনের বিপদের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। আবার অনেকেই বলেন, এটা করতে গিয়ে তিনি সিভিল সোসাইটি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
সুতরাং আমরা এটুকু বলতে পারি, এমন কোনো অভ্যন্তরীণ শক্তি আজ দেখা যাচ্ছে না যেটা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু বহিঃশক্তির দিক থেকে একটি চাপ রয়েছে। আগামী নির্বাচন ভালোভাবে করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিচ্ছে। এটি একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর বটে। কারণ আমাদের উদীয়মান পোশাকশিল্প, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ এবং বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাছ থেকে ঋণপ্রাপ্তি- এসব কিছুতেই আমেরিকার লিভারেজ বা প্রভাব রয়েছে। ফলে সেটা ব্যবহার করে ‘ভালো নির্বাচনের’ জন্য তারা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচন ভালোভাবে করার অর্থ কী? বিএনপি নির্বাচন ভালোভাবে করার অর্থ করেছে বর্তমান প্রধামন্ত্রীকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। বামপন্থিরাও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না। তারাও মনে করছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সরকার তার প্রশাসন, অর্থ এবং পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দেবে না।
বর্তমানে স্থানীয় নির্বাচনসহ যত ধরনের নির্বাচন হয়েছে সেখানে ভোট দেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি সাধারণভাবে কমছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি যত কম হবে আওয়ামী লীগের জন্য ততই ভালো। আওয়ামী লীগ ততটা হস্তক্ষেপশূন্য নির্বাচন দিয়েও জিততে পারবে। আওয়ামী লীগ চাইতে পারে বিএনপি এবার ভোট বয়কট করুক কিন্তু অনেক লোক ও দল ভোটে আসুক। বিএনপি ভোট বয়কট করলেও সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করতে পারে। নিরপেক্ষ নির্বাচন এই অর্থে যে- এবার আগে থেকে ব্যালট বাক্স ভরা হবে না, কোনো বল প্রয়োগও করা হবে না, প্রতিটা আসনে যে দাঁড়াতে চায় দাঁড়াবে। এমনকি আওয়ামী লীগের নিজ দল থেকে একটি আসনে যদি তিনজনও দাঁড়ায় তাতেও আওয়ামী লীগ আপত্তি করবে না। কারণ এই তিনজনের মধ্যে যেই জিতুক সে তো আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বয়কটের নির্বাচন কি নির্বাচন বলে আদৌ গণ্য হবে?
সরকার আরেকটা জিনিস করতে পারে। সেটা হলো- তৃণমূল বিএনপি নামের দলটিকে সামনে এনে প্রতিটা আসনে তাদের একজন করে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। ধরা যাক এভাবে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। এখন প্রশ্ন হলো- আবারও একটি একপাক্ষিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তখন কোনো ধরনের গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেবে কিনা। অথবা অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক শক্তিকে নড়বড়ে করে দেবে কিনা। এই ধরনের কোনো কিছু হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কিনা। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত, আমেরিকা এবং চীন- এসব বহিঃশক্তি আমাদের ওপর অনেক ক্ষমতা রাখে। আমেরিকা স্যাংকশন আরোপ করলে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং জনগণের রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকলে বা সে রকম পরিস্থিতি ঘটলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে। তবে সে ধরনের কোনো কিছু করার আগে আমেরিকা আগে চিন্তা করবে এখানে তাদের লাভ কী। আমেরিকা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বা গণতন্ত্র চায় সেটাতে তাদের খুব বেশি আগ্রহ আছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক জায়গাতে এ রকম গণতন্ত্রহীনতা চলছে, যেটাকে আলী রীয়াজ বলেন, ‘কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্র’। তাদের সঙ্গে আমেরিকা ভালো সম্পর্কও রেখে চলেছে। আমেরিকা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে পারলে বাংলাদেশের জনগণ বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের খুব বেশি মাথাব্যথা থাকবে বলে মনে হয় না।
২০১৮ সালের নির্বাচন খারাপ হলেও চীন এবং ভারত সর্বপ্রথম সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তেমনি এবারও যদি একটি একদলীয় নির্বাচন হয়, যদি অন্য দলগুলো নির্বাচন জনবয়কট করে এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী দেখায় তবে ভারত, চীন এবং রাশিয়া সরকারকে পুনরায় স্বীকৃতি দিতে পারে বলে মনে হয়। তবে সেই ধরনের একপাক্ষিক নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণভাবে প্রহসন বলেই বিবেচিত হবে। সুতরাং ভবিষ্যতে কী হবে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
একটা নাটকীয় অভ্যুত্থান হবে বা আমেরিকা অনেক বেশি চাপ প্রয়োগ করবে এবং সরকারের পতন হবে এমন কিছু যদি সত্যই সামনে আসে সেটা ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এই দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে হয়তো সীমাবদ্ধ থাকবে না। তখন হয়তো একটি তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। সত্যিই বাংলাদেশ আজ এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মার্কটাইম পার করছে।
এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ।
মন্তব্য করুন