ভারতের রাজধানী দিল্লিতে শুরু হয়েছে জি-২০ সম্মেলন। সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও এতে যোগ দিয়েছে আমন্ত্রিত দেশও। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রুপ মূলত উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উদ্বেগ নিয়ে আলোচনার দিকে মনোনিবেশ করে। এটি আর্থিক খাত, করের ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক আর্থিক খাত সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। আর্থিক সংকটের আলোকে সংস্থাটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের উড সিস্টেম পরিবর্তন করেছে। জি-২০ গ্রুপ বছরে একবার মিলিত হয় এবং এজেন্ডাটি প্রায়ই প্রবৃদ্ধির কৌশল, আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতার ওপর নজর রাখা এবং অননুমোদিত আর্থিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করে।
এবারের জি-২০ সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে মনোনীত হওয়া বাংলাদেশের জন্য সম্মানের বিষয়। এ জোটে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়া ও তাতে যোগদান একটি মাইলফলক বৈকি। নির্বাচনের আগে এ ধরনের বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমে বাংলাদেশের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা তুলে ধরাও জরুরি। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের আস্থার জায়গা তৈরি করাও এ সম্মেলনে যোগদান করার একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জি-২০ একটি বহুপাক্ষিক জোট। এখানে আলোচনাগুলো বহুপাক্ষিকভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু সম্মেলনের বাইরেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের যে আস্থা রয়েছে সেটি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে দ্বিপাক্ষিক অনেক বিষয় যেমন- বাণিজ্য, ট্রানজিট, বর্ডার, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। অনেকেই হয়তো বলবেন ভারতের সঙ্গে আলোচনায় পানি নিয়ে কোনো কথা হয়নি কেন। আমি আগেই বলেছি জি-২০ একটি বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফরম সেখানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হলেও খুব বেশি বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে না। তারপরও কিছু বিষয় আলোচনা হয়েছে, যা স্বস্তিদায়ক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও এগিয়েছে।
জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাইডেনের বাংলাদেশের প্রতি যে আগ্রহ ও মনোযোগ আছে সেটির প্রতিফলন ঘটেছে এতে। বাইডেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল একসঙ্গে যে সেলফি তুললেন তার একটি অর্থ আছে। দুটো দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা থাকলেও তারা উভয়ই সহযোগিতার সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ইতিবাচকভাবে ইচ্ছুক তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে এতে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। তার মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সব মতবিরোধ সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাধ্যমে এক ধরনের বার্তা দেওয়া হলো যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।
সার্বিকভাবে বললে এ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের অগ্রগতি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই প্রতিভূ হবে।
ব্রিকস ও জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। বৈশ্বিক নেতৃত্বও এটি অনুধাবন করছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন দৃষ্টি আছে ঠিক তেমনি বাজার ও বাণিজ্যের দিকেও তাদের দৃষ্টি রয়েছে। সবদিক থেকেই বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে। একে বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বিদ্যমান বাস্তবতায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাবে, সে বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকা দরকার। বিশ্ব থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ে আমাদের সঠিক নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সেটিকে বলা হয় মোমেন্টাম, তা ধরে রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে বিশ্বের নজর বাংলাদেশের দিকে থাকবে না বা হারিয়ে যাবে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
সাহাব এনাম খান : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন