চলতি বছরের জুনে রাজধানী ঢাকায় একটি সমাবেশ করেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিউজ ফুটেজে দেখা গেছে, সেই সমাবেশে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। এটি ছিল এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দলটির করা প্রথম কোনো সমাবেশ।
সমাবেশে জোরালো একটি বার্তা দিয়েছে দলটি। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে জামায়াত চাপের মধ্যে থেকেও টিকে আছে। দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত সিডনিভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক মোবাশ্বের হাসানের এক নিবন্ধে এ কথাগুলো উঠে এসেছে।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সুসংগঠিত ইসলামিক দল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করেছিল। এর বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাবেক নির্বাচনী শরীক জামায়াতে ইসলামী। দলটি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে অংশীদার ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, বিরোধী দলগুলো এবং বিশেষ করে জামায়াতকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখে সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকদের উপর চালানো ভয়াবহ সহিংসতায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নামে এই ঘরোয়া আদালত গঠন করা হয়।
এই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অপরাধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দেয়।
আইসিটি ট্রায়াল এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া জামায়াতের উপর কঠিনভাবে আঘাত হানে। এতে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে হারিয়েছে দলটি।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়া জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতার ছেলেও গুমের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গুমের শিকার হওয়া দুজন হলেন- প্রয়াত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম এবং জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযমের ছেলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আজমি।
জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযম এবং জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী দুজনই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আদালতের রায়ে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল এবং গোলাম আযম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারেই মারা যান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের বিরুদ্ধে এবং জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়া এসব রায়ের বিরুদ্ধে সহিংসভাবে প্রতিবাদ করেছিল জামায়াত। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অনেক কর্মীকে হারিয়েছে জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে তাদের প্রায় ২৪০ কর্মী নিহত হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ হাজারের বেশি মামলা এবং ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সাড়ে ৯ হাজার মামলা রয়েছে। নারীসহ দলটির ৯০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে। তবে স্বাধীনভাবে এই পরিসংখ্যান যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
জামায়াতের অনেক কর্মী স্থানীয়ভাবে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন এবং আরও অনেকে মালয়েশিয়া, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে নির্বাসনে গিয়েছিলেন।
জামায়াত সবচেয়ে বড় আঘাতটি পায় হাইকোর্ট যখন দলটির নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগের মিত্র তরিকত ফেডারেশনের দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেন হাইকোর্ট। যেখানে বলা হয়েছে, ‘জামায়াত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। সুতরাং জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণে করতে পারবে না।’
জামায়াত এবং এর কার্যক্রমের উপর দীর্ঘ ১৫ বছরের চাপের পরও দলটি টিকে গেছে বলেই মনে হয়। গত জুনে রাজধানীতে জামায়াতের সমাবেশ প্রমাণ করে- দলটি এখনও বিশাল সমাবেশ এবং বিক্ষোভ সংগঠিত করার ক্ষমতা রাখে।
পুলিশের একটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত ১৫ বছরে জামায়াতের স্থায়ী সদস্য সংখ্যা ২৩ হাজার ৮৬৩ থেকে বেড়ে ৭৩ হাজার ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দলটির স্থায়ী সদস্য সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে চাপের মধ্যেও জামায়াত উন্নতি লাভ করেছে।
মার্কিন স্কলার এবং দলটির একজন রুকন বা স্থায়ী সদস্য নকিবুর রহমান দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ‘জামায়াত একটি আদর্শভিত্তিক দল। অতএব ক্রমাগত নিপীড়নের পটভূমিতে এটি হারিয়ে যাচ্ছে না।’
নকিবুর রহমান জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে এবং তার দলের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
জামায়াতের গবেষকরা দলের টিকে থাকার কৌশলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দলটি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে এবং লোকেদেরকে রাজনৈতিক দলে যোগদানের আহ্বান জানানোর পরিবর্তে ধর্মীয় পথ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর কৌশল গ্রহণ করার চেষ্টা করছে।
একইসাথে নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকতে তারা স্থানীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দিয়েছে। পাশাপাশি গ্রেফতার এড়াতে এর কর্মীরা সদা তৎপর রয়েছে। (১ম পর্ব)
মোবাশ্বর হাসান: সিডনি-ভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন