বিমান দুর্ঘটনায় ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর ঘটনায় ওয়াগনার গ্রুপের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রিগোজিন নিহতের পর জেনারেল আন্দ্রে আভ্রিয়ানভ ওয়াগনার বাহিনীর আফ্রিকা অংশের নেতৃত্বে আসছেন বলে খবর প্রকাশ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ কয়েকটি গণমাধ্যম। যদিও ওয়াগনারের নতুন এই নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগগুলো পুরোনোই। মানুষ হত্যা, গুম, খুন ও লুটতরাজের।
প্রতিশোধপরায়ণ পুতিন
প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর ওয়াগনার গ্রুপের অস্তিত্ব বিলীনের ইঙ্গিত দিয়েছিল ক্রেমলিন। তারা দাবি করেছিল, রাশিয়ার আইন অনুযায়ী ওয়াগনার গ্রুপের মতো ভাড়াটে সামরিক যোদ্ধার দল অবৈধ। তবে বিশ্ব মানচিত্রে চোখ বুলালে, এসব কথার খুব একটা বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। কেননা এরপরেও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ওয়াগনার বাহিনী ঠিকই কাজ করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর পরিচালক বিল বার্নস প্রিগোজিনের মৃত্যুতে এক বক্তব্যে জানিয়েছেন, পুতিন একজন প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তি। যদি প্রিগোজিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হতেন তাহলে আমি অবাক হতাম।
এর আগে পুতিন কমরস্যান্ট পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার আইন অনুযায়ী এমন কোনো সামরিক প্রতিষ্ঠান থাকার বিধান নেই বলে জানিয়েছিলেন। যদিও ওয়াগনারের নতুন নেতৃত্বের ইঙ্গিতও দেন তিনি।
এদিকে পুতিনও সম্প্রতি ওয়াগনার যোদ্ধাদের প্রতি কঠোর ডিক্রি জারি করেছেন। ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে এ ডিক্রি প্রকাশ করা হয়। এখানে বলা হয়- ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে যারা প্যারামিলিটারির হয়ে কাজ করছেন অথবা সহায়তা করছেন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে রাশিয়ার প্রতি আনুগত্যের হলফনামায় স্বাক্ষর করতে হবে। এসব যোদ্ধাকে অবশ্যই রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য দেখাতে হবে। এ ছাড়া তাদের কমান্ডার ও ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনা কঠোরভাবে মানতে বলা হয়েছে। রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে ওয়াগনারের ভাড়াটে সেনাদের হলফনামায় স্বাক্ষরের নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন।
ট্রোশেভের ওয়াগনার প্রধান হওয়ার সম্ভাবনা
প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর ওয়াগনার বাহিনীর নতুন নেতৃত্বে ৬১ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আন্দ্রেই ট্রোশেভের নাম শোনা যায়। যিনি রাশিয়ার বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি আফগান ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যখন সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযান শুরু হলো ততদিনে তিনি অবসরে গিয়েছেন এবং ওয়াগনার গ্রুপের রসদ ও নিরাপত্তার দেখভাল করতেন।
ট্রোশেভকে সেদই (ধূসর চুলো) নামেও ডাকা হয়। তিনি ওয়াগনার গ্রুপে প্রিগোজিনের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। তিনিই প্রথম কমান্ডার যিনি বিদ্রোহে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনিই রুশ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসকে বিদ্রোহের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। এ ছাড়া তাকে ওয়াগনারপ্রধান হিসেবে পুতিনের পছন্দের তালিকায় রাখার আরেকটি কারণ ছিল- প্রিগোজিনের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে বেলারুশেও যাননি।
নানামুখী অনিশ্চয়তা থাকলেও, প্রিগোজিনের জায়গায় নতুন নেতৃত্ব নিয়ে ভবিষ্যতে ওয়াগনার গ্রুপ কাজ পরিচালনা করা হবে, এমনটাই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই আফ্রিকা অংশে জেনারেল আন্দ্রে আভ্রিয়ানভকে নতুন ওয়াগনার নেতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্রোহের পর রাশিয়া থেকে বেলারুশে ওয়াগনারের ঘাঁটি স্থাপনের পর শত শত সেনা দেশ ত্যাগ করতে চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে বেতন বৈষম্যসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাদের সেনাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। পুতিনের সঙ্গে বিরোধের ফলে তারা নতুন ছত্রছায়া খুঁজছিল।
তবে শীর্ষ নেতাদের অন্তর্ধানের পর তারা সক্রিয় থাকতে পারবে কি পারবে না কিংবা নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে সক্ষম কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আফ্রিকায় ওয়াগনার মিশন
প্রিগোজিনের মৃত্যুতে ইউক্রেন ও আফ্রিকায় তার গ্রুপের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আটল্যান্টিক কাউন্সিলের আফ্রিকা সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পরিচালক রামা ইয়াদে বলেন, বিদ্রোহের পর আফ্রিকায় ওয়াগনারের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, ওয়াগনার গ্রুপকে অবলুপ্ত ঘোষণা করা, দ্বিতীয়ত, একে রুশ রাষ্ট্রের মাধ্যমে জাতীয়করণ করা এবং তৃতীয়ত, নতুন আরেকজন নেতা নির্ধারণ করা। শেষ দুটি সমাধানে প্রিগোজিন না থাকলেও আফ্রিকায় ভাড়াটে এ সেনাদলের গ্রহণযোগ্যতার কথা বারংবার স্মরণ করেছে মস্কো। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রিগোজিনের মৃত্যুতে আফ্রিকায় রাশিয়ার বাণিজ্য ও নিরাপত্তা স্বার্থে ভাটা পড়বে না। কর্তৃত্ববাদী বিভিন্ন দেশে ভাড়াটে বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের জন্য ওয়াগনার বাহিনীর মতো ভাড়াটে যোদ্ধাদের যেন জুড়ি নেই। সম্প্রতি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যাওয়া নাইজারের কথাই ধরা যাক। দেশটিতে ওয়াগনার বাহিনী ইচ্ছেমতো প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে প্রেসিডেন্টকে সামরিক ক্যু থেকে রক্ষা করেছে।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। জুন মাসে ওয়াগনার বিদ্রোহের পর নানা কানাঘুষা শোনা গেলেও আফ্রিকার বিভিন্ন দুর্বল বা কর্তৃত্ববাদী সরকার নিয়ন্ত্রিত দেশে ঠিকই আগের মতোই রুশদের গতিবিধি দেখা গেছে। এমনকি বিদ্রোহের পরপরই অনুষ্ঠিত আফ্রিকা সামিটে প্রিগোজিন ও পুতিন দুজনকেই দেখেছিল বিশ্ববাসী।
নাইজারে যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি সামরিক ঘাঁটি থাকলেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটে তারা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। কেননা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নেতা বাজৌমকে ক্ষমতায় বসাতে না পারলে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি এবং নাইজারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ বাতিল করতে হবে।
এ ছাড়া আরেকটি আশঙ্কা হলো- সাহেল অঞ্চলে দানা বাঁধা জঙ্গি সংগঠনগুলো পুনরায় শক্তিশালী হবে; যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি।
উল্লেখ্য, নাইজার ছাড়াও এখনো মালি, লিবিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বা সুদানে ওয়াগনার বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। এসব দেশে ২০১৭ সাল থেকেই সৈন্য পাঠিয়ে আসছে ওয়াগনার বাহিনী। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়ে ওয়াগনার বাহিনীর নিরাপত্তা সেবা বিক্রি করে ফান্ড অর্জনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করার চিরায়ত চাহিদা রয়েছে রাশিয়ার। কিছুদিন আগে ইউক্রেনের সঙ্গে শস্য চুক্তি বাতিলের পর পুতিন বুরকিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, মালি, সোমালিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ২৫-৫০হাজার টন শস্য বিনামূল্যে দেওয়ার কথা বলেন। দেশগুলোর শাসনতান্ত্রিক জটিলতা বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া তাদের নতুন খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
ওয়াগনারপ্রধান প্রিগোজিন ও আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা উটকিনের প্রতি সম্মান জানাতে এসে নিউইয়র্ক টাইমসকে ৩৬ বছর বয়সী এক যোদ্ধা বলেছেন, আপনি যদি ওয়াগনারের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতেন তাহলে বুঝতে পারতেন এক দুজনের মৃত্যুতে এর সামগ্রিকতায় কোনো পরিবর্তনই আসবে না।
এদিকে পুতিনও চাইবেন প্রিগোজিনের রোপিত কোনো বিদ্রোহের বীজ যেন রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে মাথাচাড়া দিতে না পারে।
ওয়াগনার সৈন্যরা কী ভাবছেন?
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরই ওয়াগনার গ্রুপের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার গ্রামগুলো থেকে শুরু করে জেলখানা পর্যন্ত প্রায় সবখানেই তাদের সদস্য সংগ্রহে নামে। রুশ রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে ওয়াগনারের বীরত্বগাথা প্রকাশ করা হয়। এখন হঠাৎ করে এর নেতা নিহত হওয়ায় ক্রেমলিনকে এসবকিছুর বিপরীত স্রোতে কিছুটা হলেও গা ভাসাতে হবে।
মস্কোতে বিমান দুর্ঘটনায় ওয়াগনার গ্রুপের নিহত সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সাময়িকভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তিন সৈন্য। তারা পরিপূর্ণরূপে সামরিক পোশাকেই এসেছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে তারা ইঙ্গিত দেন, ওয়াগনার গ্রুপ এখুনি ভেঙে যাচ্ছে না। তারা বলেন, আমরা এখনো প্রস্তুত রয়েছি। আমরা কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, আমরা কাউকে ছেড়ে যাইনি এবং আমরা শেষ পর্যন্ত থাকব।
চলমান পরিস্থিতিতে ওয়াগনারের চুক্তিগুলো কি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা হবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমাদের শুধু একটি চুক্তি আছে। সে চুক্তিটা আমাদের মাতৃভূমির সঙ্গে।
মন্তব্য করুন