জলবায়ু পরিবর্তন একবিংশ শতাব্দীতে একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে, যা পরিবেশ, মানবাধিকার, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এটি এখন নৈতিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখেও আলোচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ তথা জলবায়ু ন্যায়বিচারের মতো একটি শব্দ সামনে চলে আসে। জলবায়ু ন্যায়বিচার মূলত এক ধরনের পরিবেশগত ন্যায়বিচার যা প্রান্তিক বা দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অসম প্রভাবকে তুলে ধরে।
ক্লাইমেট জাস্টিসের (Climate Justice) ধারণাটি মূলত দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। উন্নত দেশগুলো যেভাবে অতীতে ব্যাপক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করেছে, তাতে তাদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা বৃহৎ দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, যখন কোনো দেশ বা অঞ্চলের প্রতি অন্য দেশ বা অঞ্চলের কার্যকলাপ প্রভাব ফেলে, তখন আন্তর্জাতিক সমঝোতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। গত দুই শতাব্দীতে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপের ব্যাপক শিল্পায়নের প্রভাবে প্রকৃতিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে তাদের এই কর্মকাণ্ডের ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর মধ্যে অধিকাংশ হলো দ্বীপরাষ্ট্র যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম ও সবচেয়ে বড় শিকার। উদাহরণস্বরূপ মালদ্বীপ, ফিলিপাইন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো যারা আজও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব অনুভব করছে। অথচ শিল্পায়নের এই যুগে এসকল অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করেছে আর তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির যে পরিস্থিতি তাতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ন্যায়বিচারমূলক সমাধান খুঁজে বের করা বেশ কঠিন কাজ। সেই সাথে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে ‘জলবায়ু ন্যায্যতা (Climate Justice) কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?’
বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত, যা পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। এক্ষেত্রে ক্লাইমেট জাস্টিস নিয়ে বেশ কয়েকটি মূল নীতি রয়েছে এগুলো হলো :
ইন্টারজেনারেশনাল জাস্টিস (ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ন্যায়) : এই নীতির আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বর্তমান প্রজন্মকে সচেতন এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে পৃথিবীকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে তোলা যায়।
ইন্ট্রাজেনারেশনাল জাস্টিস (বর্তমান প্রজন্মের জন্য ন্যায়): এই নীতি অনুসারে বর্তমান প্রজন্মের ওপর একটি বড় দায়িত্ব বর্তায়, যেখানে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করবে। যাতে এই সকল মানুষগুলো তাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে বসবাস করতে পারে এবং নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
ইকোলজিক্যাল জাস্টিস (প্রকৃতির জন্য ন্যায়) : এই ধারণার মাধ্যমে শুধু মানুষেরই নয় বরং প্রকৃতির অধিকারের উপরও গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই নীতির মাধ্যমে মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয়। ইকোলজিক্যাল জাস্টিসের মতে, মানবজাতির কর্মকাণ্ডের কারণে যে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে তা শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয় বরং পৃথিবীর সমস্ত জীব-জন্তু, উদ্ভিদ এবং প্রাকৃতিক সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর। উল্লিখিত নীতিগুলোর মাধ্যমে এটি সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে কেউ বাদ পড়বে না এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ থাকবে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশন (UNFCCC) এর Common But Differentiated Responsibilities and Respective Capabilities (CBDR-RC) নীতি অনুযায়ী, যদিও সকল দেশই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তবে উন্নত দেশগুলোর দায়বদ্ধতা এবং তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। আমেরিকা, ইউরোপ এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলি তাদের অতীতের কার্বন নিঃসরণ এবং শিল্পায়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ, তাই তাদের ওপর বেশি দায়িত্ব রয়েছে। যার ফলে UNFCCC এর অধীনে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে গৃহীত কিয়োটো প্রোটোকল (Kyoto Protocol), ২০১৫ সালে প্যারিসে COP21 সম্মেলনে গৃহীত প্যারিস চুক্তি (Paris Agreement), ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে গৃহীত কোপেনহেগেন চুক্তি (Copenhagen Accord) সহ আরও বেশ কয়েকটি চুক্তি।
তবে UNFCCC এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কার্যকরী ফলাফল এখনও পর্যন্ত সুষ্পষ্ট নয়। যেখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো তাদের জলবায়ু সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা যথাযথভাবে প্রদান করেনি। ফলাফলস্বরূপ বর্তমান সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (Green Climate Fund) এর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এখনও পর্যন্ত কার্যকরভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি এবং বেশ কিছু দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থও হয়েছে। যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতাকে।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও দেশগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং জাতীয় স্বার্থ নিয়ে বিরোধের কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি প্রায়শই ব্যাহত হচ্ছে। যেমন ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক সহযোগিতার যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। সেই সময় চুক্তির আওতাধীন দেশগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য স্বেচ্ছায় অঙ্গীকার করেছিল এবং ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২°সেলসিয়াসের এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে, ২০১৭ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সিদ্ধান্তটি মূলত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে নেওয়া হয়েছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল যে প্যারিস চুক্তি অদূর ভবিষ্যতে দেশটির শিল্প ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
উক্ত পরিস্থিতিটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ এবং এই চুক্তিতে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এমন আরও অনেক দেশ রয়েছে যারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে পরিবেশের ক্ষতি করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যথাযথভাবে যদি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা স্থাপন ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব না হয় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুরক্ষিত এবং টেকসই পৃথিবী নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে এবং অভিযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সহায়তা পাবে না, যার ফলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যাবে। এছাড়া, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বব্যাপী কৃষি, মৎস্য সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি হবে যা ভবিষ্যতে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট তৈরি করবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
শমরিতা বড়ুয়া : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন