মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
মো. বায়েজিদ সরোয়ার
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ
মো. বায়েজিদ সরোয়ার

ইয়েমেনে জিম্মিদশা থেকে লে. কর্নেল আনামের বেঁচে ফেরার রোমহর্ষক কাহিনী

জাতিসংঘ কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম। সৌজন্য ছবি
জাতিসংঘ কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম। সৌজন্য ছবি

বন্যা, বৃষ্টি, ডেঙ্গু, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি আর নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিশ্চয়তার মধ্যে একটি সুসংবাদ এল। ইয়েমেনে উগ্রবাদী সংগঠন আল কায়েদার জিম্মিদশা থেকে জাতিসংঘ কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল একেএম সুফিউল আনামকে গত ৮ আগস্ট ২০২৩ উদ্ধার করা হয়। প্রায় দেড় বছর বন্দীদশা থেকে মুক্তির সংবাদে তাঁর পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সামরিক-কমিউনিটিসহ অনেকের মাঝে এনেছে সন্তোষ ও স্বস্তির পরশ। ডিওএইচএস মিরপুরের দৃষ্টিনন্দর ‘জ্যোসনা সরোবরে’ কিছুটা দক্ষিণে একটি সুন্দর ইমারতের নাম “আনামস”। কয়েক দিনেই দালানটির চারপাশের বৃক্ষ লতা ফুলে কি দারুন সজীবতা! প্রকৃতিও কি মানুষের আনন্দ বেদনার কথা বোঝে?

ইয়েমেন-সাবার রানি বিলকিসের সুশাসন থেকে মানব সৃষ্ট বিপর্যয়:

মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতি ও প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইয়েমেন। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও সংযোগ রয়েছে। হযরত শাহ জালালসহ অনেক পীর, দরবেশ ও বুজুর্গ ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের জন্য ইয়েমেন থেকে আমাদের এ অঞ্চলে এসেছিলেন। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে সাবার রানি বা রানি বিলকিসের সুশাসন খুবই বিখ্যাত ছিল। তবে সাবার রানি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ধরনের লেজেন্ড চালু রয়েছে। এই বিরল সুশাসনের কথা কয়েকটি ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখ আছে। অথচ ইয়েমেনে আজ চরম অরাজকতা। এরই শিকার হয়েছিলেন কর্নেল আনাম। বর্তমানে ইয়েমেন গৃহযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক জনপদ। এটি বর্তমানে আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। জাতিসংঘের মতে, ইয়েমেন আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব সৃষ্ট বিপর্যয়।

ইয়েমেনে লড়াই শুরু হয় আরব বসন্ত দিয়ে। ২০১৪ সালে শিয়া মতাবলম্বী হুথি বিদ্রোহীরা (ইরান সমর্থিত) ইয়েমেনের সে সময়কার নতুন প্রেসিডেন্ট আবদারাবুহ মানসুর হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ সাডা এবং আশে পাশের কয়েকটি এলাকা দখলে নেয়। পরবর্তীতে বিদ্রোহীরা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং প্রেসিডেন্ট হাদিকে দেশান্তরী হতে বাধ্য করে।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবসহ আটটি সুন্নি মুসলিম আরব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী জোট গঠন করে আক্রমণ করলে যুদ্ধের তীব্রতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। ইয়েমেনে বর্তমানে আল কায়েদা ও আইএস-এর মতো উগ্রপন্থি সংগঠনও বেশ শক্তিশালী। গত ৮ বছরের গৃহযুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব সৃষ্ট বিপর্যয় চলছে ইয়েমেনে। ইয়েমেনের সংকটকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই হিসেবেও দেখা হচ্ছে। গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত। দেশটিতে ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সেবা। ৭৫ শতাংশ মানুষের খাদ্যসহ জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার আলোকরশ্মি এখানে খুব কমই পড়েছে।

জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ২০১৮ সালে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। জাতিসংঘ প্রথম থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করছে। বর্তমানে সেখানে যুদ্ধ বিরতি চলছে। তবে পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক হয়নি। ২০১৯ সাল থেকে ইয়েমেনে- ‘‘ইউনাইটেড নেশনস মিশন টু সার্পোট দি হুদাইদা এগ্রিমেন্ট’’ নামে একটি পলিটিক্যাল মিশন চলছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে কাজ করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৬৩-৬৪ সালে ইয়েমেনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত হয়েছিল।

নিরাপত্তা প্রধান যখন আল কায়েদার কারাগারে:

ইয়েমেনের এই পরিস্থিতিতে লে. কর্নেল (অব.) আনাম ২০১৯ সাল থেকে ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের ফিল্ড সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেশান অফিসার (প্রধান) হিসেবে এডেনে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য, বিএ-১৬১৭ লে. কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম ১৯৭৭ সালে শর্ট সার্ভিস কমিশন-৪ (এসএসসি-৪)-এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরে কমিশন লাভ করেন। এই চৌকস কর্মকর্তা ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি জাতিসংঘের ‘‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের’’ অধীনে একজন কর্মকর্তা হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছিলেন। ইয়েমেনের আগে তিনি সুদানের দারফুর মিশনে কর্মরত ছিলেন।

২০২২ এর ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে লে. কর্নেল সুফিউল আনাম ও তার দল নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য আবিয়ান প্রদেশে যান। যাতে সেই প্রদেশের মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়। উক্ত ফিল্ড মিশন শেষে নিজ কর্মস্থলে এডেন বন্দর নগরীতে ফিরছিলেন সুফিউল আনামসহ জাতিসংঘের আরও পাঁচ কর্মী। ওই দিন বিকেলে আবিয়ান প্রদেশের মুদিয়াহ্ শহর থেকে আল কায়েদা (আল কায়দা ইন আরব পেনিনসুলা) সংগঠনের একটি দল তাদের অপহরণ করে। কর্নেল আনামের সঙ্গে অপহরণের শিকার হন আরো চারজন ইয়েমেনি জাতিসংঘ কর্মী- মাজেন বাওয়াজির, বাকিল আল মাহাদি, মোহাম্মদ এল মুলাইকি ও খালেদ মোক্তার শেখ।

উদ্ধার প্রক্রিয়া ও উদ্ধার পর্ব:

অপহরণের ঘটনার পর পরই ইয়েমেনের জাতিসংঘ কতৃপক্ষ জিম্মি উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে। গঠন করা হয় “হোস্টেজ ইনসিডেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেল”। ইয়েমেনের জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারও জিম্মি উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালায়। জাতিসংঘ সদর দপ্তর তৎপর হয়। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কর্মরত ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের কয়েকজন বাংলাদেশী কর্মকর্তার (অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা) সক্রিয়তা ছিল প্রশংসনীয়। পরবর্তীকালে সুফিউল আনামের মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ ডলার ও একই সঙ্গে সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে আটক আল কায়দা সদস্যের মুক্তি দাবি করেছিল আল কায়দা। তবে মুক্তিপণ দিয়ে জিম্মি উদ্ধার জাতিসংঘ নীতিগত অবস্থানের বাইরে। এর ফলে জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় আন্তরিকতা থাকলেও ফলাফল দৃশ্যমান হয়নি। তবে জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় ছিল। জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে আনামের পরিবারের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখা হয়েছে।

কর্নেল আনামের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অনুরোধ করা হয় বিশেষত সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে। কাজী নাসরিন আনাম জীবনের এই পর্যায়ে এসে জীবন সঙ্গীকে উদ্ধারে এক ধরনের যুদ্ধে নেমে পড়েন। লে. কর্নেল আনামকে মুক্ত করতে গত বছরের ৩ মার্চ তারিখে তাঁর সহধর্মিনী নাসরিন আনাম প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর চিঠি পাঠান।

শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার বিশেষত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছিল। বন্ধুর এই ভয়াবহ বিপদে অসাধারণ আন্তরিকতা ও উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন কর্নেল আনামের সেনাবাহিনীর কোর্সমেট (এসএসসি-৪) বা সর্তীথ অফিসাররা, যা পরবর্তীতে গতিশীল ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করে। যোগাযোগের জন্য তাঁরা ‘‘ফ্রেন্ডস ফর আনাম’’ নামে একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে। অসাধারণ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন সেনাবাহিনী প্রধান। এগিয়ে আসে রাওয়া কতৃপক্ষ ও আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন। অবসরপ্রাপ্ত সহস্র সামরিক কর্মকর্তাদের ফেসবুকে তাদের প্রিয় সহকর্মীর মুক্তির আকুতি ব্যক্ত হয়।

জিম্মি উদ্ধারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ:

ঘটনাটি ইয়েমেনে সংঘটিত হওয়ায় জিম্মি উদ্ধারের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এই কাজ পরিচালনা করেন। গত ১৭ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে কীভাবে সুফিউল আনামকে উদ্ধার করা হলো সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়।

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পরই কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে (ইয়েমেনে সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত) উদ্ধার তৎপরতা চালানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যান্য দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে এ বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হয়।’

জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক আরো জানান “পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন”। এছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন এবং সৌদি আরবের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে টেলিফোনে আলাপ করেন।

বিষয়োক্ত ষ্টিয়ারিং কমিটি জিম্মি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ‘‘অ্যাকশন প্ল্যান’’ তৈরি করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন এর ফোকাল পয়েন্ট।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বরে ওমান, সৌদি আরব, কাতার ও ইয়েমেনে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ওমান, ইয়েমেন, কাতার, কুয়েত এবং আবুধাবি সরকারের সহায়তা চেয়ে নোট ভারবাল পাঠানো হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল ওমান, কাতার এবং সৌদি আরব সফর করেন। এই প্রতিনিধি দলে সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, এনএসআই ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। এই প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন কর্ণেল কাজী মাহমুদ জাকারিয়া। মধ্যপ্রাচ্য-অভিজ্ঞ সাবেক রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী এই দলের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেন। এই প্রতিনিধি দলের কর্মকান্ড জিম্মি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অবদান রাখে।

মেজর জেনারেল মো. আশিকুজ্জামান বর্তমানে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইয়েমেনেও সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত। সার্বিক উদ্ধার প্রক্রিয়ায় এই রাষ্ট্রদূত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

এক অনবদ্য গোয়েন্দা কাহিনী:

গোয়েন্দা বাহিনীর সফলতা নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয় না। ব্যর্থতা বা ভুলত্রুটি নিয়েই কথা হয়। তবে এ এক ভিন্ন কাহিনী। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাকেও (এনএসআই) উদ্ধার অভিযান বিষয়ে নির্দেশ দেন। মেজর জেনারেল টিএম জোবায়ের এই সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ৯ আগষ্ট তারিখে কর্ণেল সুফিউল আনামের সঙ্গে ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন এনএসআই-এর পরিচালক মোহাম্মদ ইমরুল মাবুদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউল আনাম স্যারের অপহরণের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা আমাদের ওপর ছিল। এটা এক দিনেই সম্ভব হয়নি। এটি ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল ও দুরূহ কাজ। আমরা দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। এ কাজের সময় আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম বিভিন্ন দেশ, ভ্রাতৃপ্রতিম সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অনেকের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। তারা আমাদের কাছে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল। কিন্তু আমরা স্যারকে কোনো ধরনের মুক্তিপণ ছাড়াই উদ্ধার করতে পেরেছি।’’

সুফিউল আনামকে উদ্ধারের জন্য এনএসআই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএস এ বিষয়ে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। যতদুর জানা যায়, মূলত ইয়েমেনে এনআইএস এজেন্টের মধ্যস্থতায় সুফিউল আনামকে আল কায়দার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় এবং বিমানযোগে তাকে আবু ধাবিতে ৮ আগস্ট নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে এনএসআই-এর তত্ত্বাবধানে আবুধাবি থেকে আনামকে ৯ আগস্ট ঢাকায় আনা হয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে গত ১৪ আগস্ট টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে একে অপরের সঙ্গে ১৫ মিনিট কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউল আনামের পরিবারের সদস্যদের এবং তার নিজের পক্ষে ইয়েমেনে অপহরণকারীদের নিকট থেকে আনামের মুক্তি লাভের লক্ষ্যে তাদের অসাধারণ প্রচেষ্টা এবং সফল আলোচনার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল মুক্তির আলোচনার প্রশংসা করে বলেন, আল-কায়েদার বন্দিদশা থেকে আনামের মুক্তিলাভ সংযুক্ত আরব আমিরাত সফল শান্তিস্থাপন এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও ধন্যবাদ জানান।

বন্দী জীবনের সাতকাহন:

দেশে পৌঁছে কর্নেল আনাম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বন্দী জীবনের কথা বলেন... ‘’ ‘‘আমি এত দিন যে পরিবেশে ছিলাম সেটা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এগুলো সিনেমাতে ও মুভিতে দেখা যায়; কিন্তু বাস্তবের এই অভিজ্ঞতা সবচেয়ে কঠিন। আমি ছিলাম পাহাড়ের ভেতর ও মরুভূমির মধ্যে। মাসের পর মাস আমি আকাশ-বাতাস দেখতে পাইনি। পাহাড়ের ভেতর ও মরুভূমির মাঝখানে চলছিল আমার দুদর্শাময় জীবন। এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমাকে সবাই ভুলে গেছে। আমি পুরো হতাশাগ্রস্ত একজন মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।

‘‘আমার সব সময় মনে হতো যে আমি আর বাঁচব না বা ফিরতে পারব না। যেকোনো বিপদসংকুল মুহূর্তে তারা আমাদের হত্যা করে পালিয়ে যাবে।’’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি বর্ণনা করতে পারব না সে কষ্টগুলো। অত্যন্ত বিপদসংকুল অবস্থায় আমি সময় পার করেছি। প্রতিটিক্ষণ ছিল আমার সন্ত্রাসীদের ভয়, মৃত্যুর ভয় ও দুর্ঘটনার ভয়।

সুফিউল আনাম বলেন, মনে হয়েছিল, আমরা বেঁচে ফিরতে পারবো না বা বাঁচবো না। যেকোনো বিপদসংকুল মুহূর্তে তারা আমাদেরকে হত্যা করতে পারে। অথবা কোনো অপারেশন বা উদ্ধার অভিযানে যদি বাঁচানোর চেষ্ঠা করা হয় তাহলে হয়তো তারা আমাদের হত্যা করবে।

ইয়েমেনে বন্দী জীবন যে রকম:

১৮ মাসের বন্দিদশায় সুফিউল আনাম এবং চার জন সহকর্মীকে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এগুলোকে তারা শেল্টার রুম বা আশ্রয় কক্ষ বলতেন। দেড় বছরে মোট ১৮ বার তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোট ১০ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের চোখ বেঁধে রাখা হতো।

অপহরণের পর প্রথমে তাদের একটা পাহাড়ের শেল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। যে কক্ষে কেবল একটি ছোট্ট ছিদ্র ছিল। সেটা দিয়ে আলো আসত। এখানে তারা প্রায় তিন মাস ছিলেন। দিন রাত কিছুই বোঝা যেত না। এরপর তাদের মরুভূমির মধ্যে একটি তাবুর মধ্যে রাখা হয়।

দিনগুলো ছিল বিভীষিকাময়। অধিকাংশ শেল্টার কক্ষগুলো ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর। একটি শেল্টার ছিল পাথর দিয়ে ঘেরা। পাথরের ঘরটি ছিল কোবরা সাপ, বিচ্ছুসহ বিষাক্ত সব পোকামাকড়ে ভর্তি। পুরো যাত্রায় তাঁবুতে থাকা ছিল সবচেয়ে কষ্টের। বালিঝড় ছিল সেখানে থাকাকালীন সবচেয়ে কষ্ঠকর মুহূর্ত। প্রচণ্ড গরম পড়ত। কখনো তাদের উপর দিয়ে উড়তো ড্রোন। তাবুতে থাকতে তাদের পায়ের গোড়া দড়ি দিয়ে বেধেঁ রাখা হতো। সেগুলো যুক্ত ছিল বিস্ফোরকের সঙ্গে। দূর থেকে সেগুলো বিস্ফোরিত করা যায়। ১৮ মাস অপহরণকারীরা মুখোশ পরে ছিল। তারা শুধু অপহরণকারীদের চোখ দেখতে পারতো।

কর্নেল আনাম বলেন ‘‘আল কায়দার সদস্যরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। কোনো রকম নির্যাতন, দুর্ব্যবহার করেননি। তারা আমাদের বলেছিল যে, তারা আমাদের হত্যা করবে না। জানাতো যে, মুক্তির জন্য আলোচনা চলছে।’’ বন্দীদের খাবারের মান ভালো ছিল। তবে তহবিলে টান পড়লে খাবারের মান খারাপ হতো।

তবুও আধারে আলোর আশা:

এমন অবস্থায় কীভাবে বেঁচে ছিলেন সুফিউল আনাম? সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। কখনও হতাশা, উত্তেজনা, আশা নিয়ে দিন কাটছিল। মাঝে মধ্যে তাদের ভিডিও শুট করা হতো। তখন বন্দীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চয় হতো। কারণ আনাম জানেন, জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে আলোচনায় বারবার বেঁচে থাকার প্রমাণ চায় জাতিসংঘ।

বিশ্বব্যাপী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী ‘‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’’ ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখার একটা ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে। এই ভিডিও বার্তায় লে. কর্নেল আনাম জানান যে, আল–কায়েদা তাকে অপহরণ করেছে। অপহরণকারীদের হাত থেকে তাঁকে মুক্ত করতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পক্ষের কাছে তিনি অনুরোধ করেন। তিনি জানান যে তিনি খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন এবং অপহরণকারীদের দাবি মেনে না নিলে তাঁকে মেরে ফেলা হতে পারে।

সুফিউল আনাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমাদের বলা হয়েছিল রমজানের আগে মুক্তি দেয়া হবে। এরপর বলা হলো ঈদের আগে। এরপর বলা হলো ঈদ-উল আজাহার আগে।’’ কিন্তু মুক্তি আসেনি। তবে তিনি আশা ছাড়েননি। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। ইবাদত বন্দেগীতে দীর্ঘ সময় কাটতো। এই সময় ধর্মের মধ্যে আশ্চর্য শক্তি পেয়েছিলেন সুফিউল।

এর মধ্যে একসময় সুফিউল আনামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। গত এপ্রিলে প্রাণপ্রিয় পুত্র সাকিফ আনামের চিঠি পেলেন। ‘‘বাবা চিন্তা করোনা আমরা ভালো আছি। তুমি আত্মবিশ্বাসী থেক।’’ তাকে অসামান্য শক্তি যুগিয়েছিল সন্তানের এই চিঠি। মোবাইল ফোন আসায় কতদিন চিঠি লেখা হয়নি। একদিন আনাম চিঠি লিখতে বসলেন। কানাডায় থাকা তাঁর প্রিয় কন্যা জারা আনামের জন্য লেখা চিঠি শেষ করলেন। কিন্তু কিভাবে পাঠাবেন সেই চিঠি? মাঝে মাঝে ভাবতেন সবাই কি তাকে ভুলে গেল? তখন খুব হতাশ ও অভিমান হতো। তিনি জানতে পারেননি, তাকে উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের কথা।

কর্নেল আনাম ও তার সহবন্দীরা দিন গুনতেন। কখনো বাস করতেন স্বপ্নের মধ্যে। অতীতের সুন্দর স্মৃতিগুলো ছিল শ্রেষ্ঠ এক সম্পদ। কখনো মুক্তির স্বপ্ন, জীবনের সোনালি সময়ের স্মৃতিচারণ কষ্টের মধ্যে তাকে অসামান্য স্বস্তি দিত। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আনামের মন ইয়েমেনের রুক্ষ প্রকৃতি ছেড়ে পাখির পাখায় উড়াল দিতো সবুজ বাংলার দিকে। মনে পড়ত গোমতি, তিতাস বিধৌত-জনপদ, শৈশবের আনন্দময় দিন, ফেলে আসা সেনাবাহিনীর মধুর দিনগুলো। মনে পড়তো পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু ও জীবন সঙ্গীর প্রিয় মুখশ্রী। এই কষ্টকর সময়ে একদিন নোট বুকে লিখতে শুরু করলেন তাঁর বন্দী জীবনের কথা। এই নোট বুক কি তিনি দেশে নিয়ে যেতে পরবেন?

গত জুন মাসে হঠাৎ কিছু পরিবর্তন অনুভব করলেন আনাম। তাদের নিয়ে যাওয়া হল একজন ইয়েমেনি শেখের বাড়িতে। কিছুটা আরামদায়ক বন্দোবস্ত। অনুমান করলেন মুক্তির বিষয়ে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে। অবশেষে একদিন এলো প্রার্থিত সেই মুক্তির সংবাদ...।

চারিদিকে মুক্তির আনন্দ:

ইয়েমেন থেকে আবুধাবি বিমানবন্দরে একটি সি-১৩০ বিমান ল্যান্ড করল ৮ আগস্ট সকাল ১০ ঘটিকায়। প্লেনে আনামের পাশে বসেছিলেন আরব আমিরাতের গোয়েন্দা বিভাগ ‘‘এনআইএস’’ এর একজন এজেন্ট। ডিসডাশা পরা এই ব্যক্তি আনামকে জানালেন যে, প্লেন এখন আবুধাবিতে। বিমান থেকে বের হয়ে ঝলমলে বিমান বন্দরে নিজেকে এখন সত্যিই মুক্ত মনে করলেন সুফিউল আনাম। যেন অন্ধকার এক গুহা থেকে আলো ঝলমলে এক জগতে প্রবেশ করেছেন। এর পর তাকে একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেই সুফিউল আনামের দেখা হল বাংলাদেশের এনএসআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আনন্দ উচ্ছ্বাস ও আবেগে তাদের জড়িয়ে ধরলেন কর্নেল আনাম।

লেক অন্টারিওর আকাশে একঝাক বুনো হাঁস:

৮ আগস্ট ২০২৩। কানাডার টরেন্টোতে এখন ভোর। বুকে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ অভিমান আর হতাশা নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজে বসেছেন লে. কর্নেল আনামের সহধর্মিনী কাজী নাসরিন আনাম। বন্দীদশা থেকে প্রিয়তম জীবন সঙ্গীর মুক্তির জন্য পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। অঝোরে কাঁদছেন।

এরই মধ্যে হঠাৎ বেজে উঠলো তার সেলফোন। অচেনা এক নাম্বার থেকে কল। কিন্তু ওপার থেকে ভেসে এলো সেই প্রার্থিত কণ্ঠস্বর। “শোন... আমি আনাম বলছি.. আমি মুক্তি পেয়েছি।’’ আশ্চর্য এক বেহেস্তি আনন্দে মনটা ভরে গেল নাসরিন আনামের। এক লহমায় ব্যাক ইয়ার্ডের ম্যাপেল গাছের শ্যামা-সবুজ পাতাগুলো যেন হলুদ-কমলা লাল বর্ণে বর্ণিল হয়ে উঠল। এই ভোর বেলায় অপূর্ব দৃশ্যময় লেক অন্টারিওর দিকে সানন্দে উড়ে গেল এক ঝাঁক বুনো হাঁস। দি ক্রেনস আর ফ্লাইং....। ৩৬ ঘণ্টা পরে তাদের দুজনের দেখা হবে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।

সুফিউল আনামের কৃতজ্ঞতা:

৯ আগস্ট তারিখে দেশে ফিরে ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সুফিউল আনাম বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা আমার উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব তার মতো একজন নগণ্য দেশবাসীকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা। আমি এনএসআইয়ের পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমি উদ্ধার হতে পেরেছি। আমি এনএসআইয়ের এই দায়িত্বপূর্ণতা কখনো ভুলব না। আমি তাদের এই ঋণ কখনো পরিশোধ করতে পারব না।

পরবর্তীতে ১০ আগস্ট তারিখে সুফিউল আনাম গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সপরিবারে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সুফিউল আনাম জাতিসংঘ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট প্রতিমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান ও এনএসআইর ডিজিসহ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

সফল উদ্ধার বনাম বিলম্ব বিতর্ক:

কর্নেল আনাম দীর্ঘ ১৮ মাস আল কায়দার হাতে বন্দী ছিলেন। সুফিউল আনামের ঘটনাটি অনেক দিক থেকেই অনন্য। কারণ তিনি আল কায়েদার হাতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বন্দী থাকা ব্যক্তি। তাকে উদ্ধারে কেন এত সময় লাগল? ঢাকায় এমন একটি আলোচনা আছে।

বিদেশে সংঘটিত এ ধরনের জিম্মি উদ্ধারের ঘটনা ছিল সম্ভবত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে আসছিল। কিন্তু সূদূর ইয়েমেনে আল কায়েদার মতো দূধর্ষ উগ্রবাদী গোষ্ঠী থেকে জিম্মি উদ্ধার অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিদ্রোহী গ্রুপের অপহরণগুলো খুব স্পর্শকাতর হয়। কার সঙ্গে নেগোশিয়েশন করা হচ্ছে সেটাও অনেক সময় নিশ্চিত হওয়া যায় না। বেশ কয়েকটি বিষয় উদ্ধার প্রক্রিয়াকে বিলম্ব ঘটিয়েছে বলে মনে করা হয়। এর মূল কারণ ছিল, ইয়েমেনের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে ইয়েমেনের উপর মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী কয়েকটি দেশের প্রভাব। যাই হোক, এই ঘটনাটি থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবিষ্যতে এমন ইস্যুর জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে পারে। জিম্মি উদ্ধার বিষয়ক এসওপি তৈরি করা প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা মোকাবিলা করতে সহায়ক হবে।

জাতিসংঘের শান্তি মিশন ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ভূমিকা:

প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের বীর শান্তিরক্ষীগণ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু শান্তিরক্ষী মিশনগুলোতে ও জাতিসংঘের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অন্য একদল আলোকিত যোদ্ধার কথা তেমন আলোচিত হয় না। লে. কর্নেল আনামের মতো বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিমিশন ও পলিটিক্যাল মিশনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা (অধিকাংশই সেনাবাহিনীর) জাতিসংঘের কর্মকর্তা হিসেবে চমৎকার অবদান রাখছেন।

‘‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সাার্ভিস কমিশনের’’ অধীন বর্তমানে প্রায় ৫০ জনেরও বেশি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন মিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন।

এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৩০০-এর মতো অসামরিক কর্মকর্তা সগৌরবে বিভিন্ন জাতিসংঘ শান্তি মিশন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজে এই ধরনের ক্যারিয়ার/চাকরি তরুণ বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতে পারে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজী, ফরাসী ও আরবি ভাষার দক্ষতা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়।

সুফিউল আনামসহ পাঁচ জাতিসংঘ কর্মকর্তার মুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। বিবৃতিতে মহাসচিব বলেন, ‘‘আশা করছি তারা সবাই সুস্থ আছেন। স্বস্তি পেয়েছি যে, তাদের পরিবারের উদ্বেগের অবসান হলো।’’ সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করছেন জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অফ সেফটি এন্ড সিকিউরিটি (ইউএনডিএসএস) এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ম্যানুয়েল রোমাও এক্সসেলেন্টি অ্যান্তোনিও। তিনি কর্নেল আনামের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার পরিবারের খোঁজ খবর নেন। অ্যান্তোনিও কর্নেল আনামকে নতুন জীবনে স্বাগত জানান।

কর্নেলকে নতুন জীবনে স্বাগত:

কর্নেল আনামকে উদ্ধারে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছিল। এটি ছিল কূটনীতিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনএসআই, সেনাবাহিনী, জাতিসংঘ এবং আরো অনেককে মিলিয়ে একটি চমৎকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। স্ব স্ব অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন- প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ও সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। মিডিয়া তার ভূমিকা পালন করেছে। স্পর্শকাতর বলে সব বিষয় বিস্তারিতভাবে মিডিয়াতে আসেনি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও আশা জাগানিয়া দিক হলো বিপদে পড়া ব্যক্তির জন্য মানুষের দরদ ও আন্তরিকতা।

বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও আমাদের নৈতিক মান ক্রমশ নিম্নমুখী। দিন দিন আমরা ব্যক্তি কেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। সমাজ আজ বিভক্ত। এমন অদ্ভূত পরিবেশে, এই ধরনের মানবিক উদ্যোগ সমাজে আশা ও প্রেরণা জোগায়। জানান দেয় রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের ভালবাসা, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের কথা ।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে যে করেই হোক শত্রুর হাতে বন্দী নিজ বাহিনীর সদস্যদের মুক্ত করা সামরিক বাহিনীর মনোবল গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ইসরায়েলি বাহিনী বন্দী সৈনিককে মুক্তির জন্য যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এতে সৈনিকদের নৈতিক মনোবল বৃদ্ধি পায়। লে. কর্নেল আনাম অবসরপ্রাপ্ত এবং প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও সেনাবাহিনীর মনোবলের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই ঘটনায় সামরিক পরিসরের ব্যক্তিবর্গের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি সামরিক- কমিউনিটিতে ভ্রাতৃত্ববোধ ও কমরেডশীপকে উজ্জিবিত করেছে। জিম্মি উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের ভূমিকা সমাজে প্রশংসিত হয়েছে।

আমরা যেন এভাবে সব সময় একে অন্যের বিপদে পাশে দাড়াঁতে পারি। বিপন্ন মানুষের পাশে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দাঁড়াতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এই রাষ্ট্রের মালিক। বিভাজনের বাঁধ নয়, আমাদের মধ্যে গড়ে উঠুক সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সম্প্রীতির সুবর্ণ সেতু। এই ঘটনায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্নেল আনামের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এর আলোকে অভিভূত ও কৃতজ্ঞ নাগরিক সুফিউল আনাম দেশের জন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন।

সুফিউল আনামের সেনাবাহিনীর বন্ধুগণ (ফ্রেন্ডস ফর আনাম) বন্ধুত্বের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাদের এখন সেলিব্রেশনের সময়...। এই উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা সকলকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। কনগ্রাচুলেশনস। নতুন জীবনে আমাদের কর্ণেলকে স্বাগতম। স্যার ওয়েলকাম...

মো. বায়েজিদ সরোয়ার: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির আটক

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১০

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১১

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১২

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৩

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৪

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৫

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৬

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৭

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

১৮

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির আভাস

১৯

আমার কষ্ট নেই, আজ আমরা স্বৈরাচারমুক্ত : আহত তানভীরের পিতা

২০
X