চন্দ্রজয়ে ভারতের যে টিমটা দীর্ঘদিন ধরে নিরলস কাজ করেছে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য নারী। এর মধ্যে অন্তত ৫৪ জন নারী এই অগ্রযাত্রায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। কেউ ছিলেন বিজ্ঞানি, কেউ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ইত্যাকার নানা পদে নারীরা জড়িত ছিলেন গোটা মিশনে। এর মধ্যে একজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার নাম ঋতু কারিধাল। ৩/৪ সদস্যের যে টিমটা গোটা মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছে, তিনি তাদের একজন। ১৯৯৭ সাল থেকে আইএসআরও’র সঙ্গে কাজ করে আসা লাখনৌ বাসিন্দা ঋতুকে ভারতের ‘রকেট উইম্যান’ নামে ডাকা হয়; যার প্রিয় বিষয় গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান। আইএসআরও’র প্রধান সোমনাথের মত তিনিও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের ছাত্রী। তারও বাকি পড়ালেখা নিজের দেশে। ‘মেইড ইন ভারত’। গতকাল সন্ধ্যায় চন্ত্রযান-৩ যখন চাঁদের মাটি স্পর্শ করছে, তখন নিশ্চয়ই আমরা দেখেছি যে, সে দেশের ছাত্রছাত্রীরা কি ভয়াবহ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে! সরকার সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত স্কুল খোলা রেখেছে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি অনুষ্ঠানটা দেখতে পারে। এই দিকটা ভীষণ ভাল লেগেছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, ইনফোসিসের চেয়ারম্যান সুধা মূর্তির কথা, যিনি আবার ইংল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের শ্বাশুড়িও। কিছুদিন আগে তার লেখা বই পড়ছিলাম, সেখানে তিনি লিখেছেন, কিভাবে গোটা সোসাইটির বিরুদ্ধে একা লড়াই করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলেন। ৭০ এর দশকে গোটা কলেজে তিনি ছিলেন একমাত্র ছাত্রী। এমনকি কোনো নারী শিক্ষক, কর্মচারীও ছিল না সেখানে। ফলে এত পুরুষের মাঝে তাকে একা ভর্তি করাতে রাজি ছিল না কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। সাদা রঙের ঢোলা একটা জামা পড়ে কলেজে যেতেন। সব সময় ওই একই ড্রেস, যাতে তার প্রতি কেউ আকৃষ্ট না হয়। ধুলোয় জমে থাকা এক মলিন ঘরকে পরিস্কার করে দেয়া হলো তার কমনরুম হিসেবে। গোটা কমনরুমে তিনি একা! তার চাকরি পাওয়ার গল্পটা আরও মজার। টাটার প্রথম নারী ইঞ্জিনিয়ার তিনি। কিন্তু অনেকবার আবেদন করলেও তাকে ইন্টারভিউর জন্যও ডাকা হলো না। রেগমেগে টাটার চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখলেন যে তাকে কেনো ডাকা হচ্ছে না? সেই চিঠি পেয়ে চেয়ারম্যান তাকে পরীক্ষার জন্য ডাকলেন, ওরকম পরিবেশে নারী কর্মী নিয়োগ না করতে পারার সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং শেষমেষ চাকুরি দিলেন। সেই দেশ, মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে লাখে লাখে ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে সারা দুনিয়াতে জোগান দিচ্ছে। সিনেমা, খেলাধুলা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা- সবক্ষেত্রে অসংখ্য আইকন ভারত সৃষ্টি করেছে, যারা লাখো কিশোরীকে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র শোনায়। অথচ এই মুহুর্তে চলা, আমাদের দেশের প্রায় সকল বড় প্রজেক্ট বিদেশীরা লিড করছে। আমাদের মেয়েরা যে এগোচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেটা খুব ধীরে। প্রবল বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। সেই এগোনোটা প্রতিবছর এসএসসির ফল প্রকাশের খবর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ! এরপর বাকি গন্তব্য বন্ধুর। কত শতাংশ মেয়ে পাশ করেছে সেটা ফলাও করে প্রচার করি আমরা, অথচ কত লাখ যে এসএসসি পর্যন্ত যেতে যেতে পথে ঝরে গেল, সেই হিসেবটা কোথাও নেই। এই করোনায়, গ্রামের হাইস্কুলের সব ক্লাস প্রায় বালিকাশূণ্য হয়ে গেছে। রিপোর্ট বলছে, অন্তত ৬৮ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে গেছে এই করোনাকালে। এখন বছর না ঘুরতে সন্তান কোলে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনের ঘানি টানতে শুরু করবে তারা। আমাদের মেয়েরা এখনো সাইকেল চালাতে পারে না। ভয়ে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে প্রায় ৯০ শতাংশ এখন বোরখা অথবা হিজাব পরে যায়, কারণ রাস্তায়, ক্যাম্পাসে, কোথাও ন্যুনতম নিরাপত্তা নেই, ফুটবল খেললে এসিড মারার হুমকি দেয়, পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দেয়, মেয়েরা যাতে খেলাধুলা না করে সেই দাবিতে মানববন্ধন হয়। টিভি সিনেমার সব নায়িকার সোস্যাল মিডিয়ার পোস্টের নিচের কমেন্ট পড়লে বোঝা যায়, বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমরা কতটা কপট! অথচ সেই একই অভিনেত্রীর কোনো গানের ইউটিউব ভিউ কয়েক কোটি! এতসব পেরিয়ে, যে সব মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নেয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করে; তাদের কত ভাগ সেবা খাতে জড়িত থাকে? বাকিরা স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, সন্তান-পরিবারের চাপে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। অথচ এসব মেয়েরা কোনোভাবেই কম মেধাবী নয়। তাদের ইচ্ছেরও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু, ‘ছেলের বউ বিয়ের পর কাজ করবে? এটা কেমন কথা’- এই যখন সারবস্তু, তখন সবাই আবার বউ হিসেবে ডাক্তার বউকেই খুঁজছে। অথচ একজন মেডিকেল ছাত্রীর পেছনে সরকারের মাসিক ভর্তুকি প্রায় ৫০ হাজার। তাই এত কিছুর পর, যেসব মেয়েরা ঘর সামলায়, এরপর ক্যারিয়ারও সামলায়, অথবা নিতান্তই ঘরের বাইরে কিছু একটা করে, তাদেরকে আমার কোনো সাধারণ মানুষ মনে হয় না। মনে হয়, ভিনগ্রহ থেকে ‘সুপার উইম্যান’। কক্সবাজারে কাজ করা বন্ধুর কথা মনে পড়ে, যে বিকেলে তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সাইক্লিং করতে গিয়ে বেশ দামী শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্র চেহারার হয়তো শিক্ষিত যুবকদের দ্বারা প্রবল ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘এই দেশটা নারীদের জন্য না...’ একটা দেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ ভাগকে পেছনে ফেলে সেই দেশের উন্নয়ন কি করে সম্ভব? আমার মাথায় আসে না।
রাজু নূরুল: উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন