রাত পেরোলেই ঈদ, আর তাওহীদের যেন তর সইছে না। ঢাকায় চাকরি করার পর প্রতিবারের মতো এবারও সে ফিরছে গ্রামে, মায়ের কাছে। কিন্তু এবারের ঈদযাত্রাটা আগেরবারের চেয়ে একটু আলাদা। টিকিটের দাম বেড়েছে, বাড়তি গরমে যাত্রা আরও কষ্টদায়ক। তারপরও মায়ের মুখের হাসি দেখার আশায় সব কিছু মেনে নিতে হয়েছে।
বাসস্ট্যান্ডের ভোগান্তি
গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই দেখা মেলে প্রচণ্ড ভিড়। সবাই যেন বাড়ির পথে ছুটছে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে মানুষের হৈচৈ, অনেকেই অতিরিক্ত ভাড়া গুনছে। বুকিং কাউন্টারে গিয়ে তাওহীদ জানতে পারে, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৪০০ টাকা বেশি দিতে হবে। কি আর করা! মা তো অপেক্ষা করছে, তাই মন খারাপ হলেও টিকিট নিতে হলো।
নির্ধারিত সময় পার হয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা তবুও আসেনি বাস। ভিড়ে ঠাসাঠাসি অবস্থায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা সবার। পাশে বসা এক বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলেন, ‘বাবা, এই কষ্টের পর যখন বাড়িতে পৌঁছাবি, তখন সব ভুলে যাবি।’
পথের ক্লান্তি, ফেরার আনন্দ
বাস শহরের জট ছাড়িয়ে দূর পথের দিকে এগিয়ে চলেছে। জানালার পাশে বসে তাওহীদ হারিয়ে যায় স্মৃতির গহিনে- শৈশবের ঈদ। বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। সাদা পাঞ্জাবিতে নামাজে যেতেন, মিষ্টি হাসি ছিল মুখে। মা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত- সেমাই, পোলাও, কোরমার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত ঘরময়। আর তাওহীদ? ছোট বোনের সঙ্গে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দৌড়ঝাঁপ করত সারাদিন।
বাসের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে আসে তাওহীদ। ঈদ তো আসবেই, তবে বাবাহীন ঈদের আনন্দ আর আগের মতো হয় না…
গরম, যানজট, বাসের ঝাঁকুনির মধ্যেও সে বেশ খুশি। সামনের সিটে এক মা তার ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করছে। শিশুটির হাসি দেখে তাওহীদের মন যেন কেমন করে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হচ্ছে কতদিন হলো কথা বলা হয়নি!
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মায়ের নম্বর চাপ দিতেই ওপাশ থেকে চেনা গলা ভেসে আসে, ‘কতদূর এসেছিস, বাবা?’ তাওহীদের চোখ ভিজে ওঠে, ডুকরে বলে এই তো চলে এসেছি। • ‘মা, তুমি কী করছ?’ • ‘বাবা, তোর জন্য পায়েস রান্না করছি। আর তোর পছন্দের গরুর মাংসও।’ • ‘আমি আসছি মা, একটু দেরি হবে। তুমি অপেক্ষা করো।’
ওপাশ থেকে মায়ের শান্ত কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘তাড়াহুড়ো করিস না বাবা, আসলেই হলো। তোর জন্য অনেক কিছু রেখেছি।’
দীর্ঘ ভ্রমণের পর বাস থামে চেনা স্ট্যান্ডে। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, বাতাসে ঈদের আনন্দ। তাওহীদ ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়, গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। চারপাশে কুয়াশা ঘেরা শৈশবের স্মৃতি জেগে ওঠে।
বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে দেখে দরজায় মা দাঁড়িয়ে। চোখ ভেজা, মুখে হাসি। তাওহীদ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মা কেঁপে ওঠা গলায় বলে, ‘এসেছিস বাবা? ঈদ মোবারক!’
পায়ে সালাম করতেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেন মা। তাওহীদের চোখ বন্ধ হয়ে আসে শান্তিতে। পথের ক্লান্তি, যানজট, শহরের কোলাহল- সব ভুলে যায় নিমিষেই। মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘ঈদ মোবারক, মা!’ মা হাসেন, চোখে জল চিকচিক করে। তাওহীদ বুঝে যায়- এটাই তার প্রকৃত ঈদ আনন্দ।
মন্তব্য করুন