সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩২
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পবিত্র ঈদুল ফিতরে থাকবে না আর ধনী-গরিব ভেদাভেদ

ড. মো. আনোয়ার হোসেন ও এফআইএএ’র লোগো। ছবি : সংগৃহীত
ড. মো. আনোয়ার হোসেন ও এফআইএএ’র লোগো। ছবি : সংগৃহীত

সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে এই লিখনির অবতারণা করছি। ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এর একটি ঈদুল ফিতর, আর অন্যটি ঈদুল আযহা, যাকে কোরবানির ঈদও বলা হয়। বাংলাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করেন ঈদুল ফিতরকে এবং এক কথায় সবার কাছে পরিচিত ঈদ হিসেবে। এই সময়টিতে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে অর্থাৎ সারা বছরে যত পণ্য আর সেবা কেনা-বেচা হয়, তার বড় অংশটি হয় এই সময়ে।

ঈদ ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও এই ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ঈদের প্রচলন শুরু হয়নি।ঈদুল আযহা কখন আর কোন প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। কিন্তু ঈদুল ফিতর কখন আর কীভাবে প্রচলিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে তথ্য কমই জানা যায়। ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে যে, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদ্‌যাপন করা হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরি সাল গণনা শুরু করা হয়েছিল আরও ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের সময়ে।

এরপর হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেওয়া হয় যে, রমজান মাস চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে - শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদ্‌যাপন করা হবে।

এ বিষয়ে আনাস নামে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা একটি হাদিসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, মদিনায় যাওয়ার পর নবী দেখলেন যে, সেখানকার মানুষ বছরে দুটি বড় উৎসব পালন করে। তিনি তখন জানতে চান, সেগুলো কী উৎসব? এগুলো ছিল নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দুটি উৎসব- যেগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদ্‌যাপিত হতো।

ঈদ উদ্‌যাপন মদিনায় শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয়ে যায় ঈদ পালন। কালক্রমে অঞ্চল ভেদে এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়।

ইতিহাসবিদ বলেছেন, দেড়শ বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোনো উৎসব ছিল না। তাদের মতে, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজি শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদ্‌যাপনের চল শুরু হয়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন ঈদ পালনও বাড়তে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায়। এক সময় দিল্লির মুঘলদের অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ যেমন ব্যাপক উৎসবের আকার পেয়েছে, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর - যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে। তার আগে, ঈদ উদ্‌যাপনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। আনুষ্ঠানিকতার প্রায় পুরোটাই ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক, যে কারণে ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঢাকার ঈদ সম্পর্কেই জানা যায়।

এবার আমার বাল্যকালের ঈদুল ফিতর নিয়ে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। বাল্যকালে অন্যদের মতো, আমার বন্ধু ও সমবয়সি আত্মীয়-স্বজনরাও ঈদের নতুন জামা-কাপড় নিয়ে মেতে থাকত। আমি এর ব্যতিক্রম ছিলাম। আমার যত বায়না ছিল খেলাধুলার উপকরণ নিয়ে। আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম বড় ভাই তখন ঢাকায় সরকারি চাকরি করত। বাবার অফিসের টেলিফোনে একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এই ঈদে তোমার জন্য কি নিয়ে আসব। আমি বললাম, ফুটবল। হেসে জিজ্ঞেস করল, কি বল। আমি বললাম ডিয়ার বল। ওই সময় ডিয়ার লেখা ফুটবল খুব জনপ্রিয় ছিল। ঈদের দিন সকালে আমার কাঙ্ক্ষিত ফুটবলটি প্রথম শর্ট মারতেই মান্দার গাছের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে পঙ্চার হয়ে বাতাস বের হয়ে গেল। আমাদের গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় এই কাঁটাযুক্ত গাছকে মান্দার গাছ বলা হয়। এবার আমি রেগে মেগে কেঁদে বলটি কেটে কয়েক টুকরো করে ফেললাম।

আমার কষ্ট এবং কান্না দেখে আশপাশের অনেকের ঈদ মাটি হয়ে গেল। অনেকে কান্না শুরু করল। কোনো এক অদৃশ্য কারণে হয়তো আমার পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশী আমাকে একটু বেশি আদর করত। সেজন্য সবাই আমাকে নিয়ে মেতে থাকত, একের পর এক সবাই এসে সান্ত্বনা দিতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে শীতকাল হওয়ায় কম্বল মুড়ি দিয়ে সে কি ঘুম। বাল্যকালে প্রায় প্রতি ঈদে আমার পকেট থেকে টাকা হারাত। কারণ ঈদগাহ মাঠ থেকে স্থানীয় বাজার পর্যন্ত আমি সবার সঙ্গে মোলাকাত এবং খুনসুটিতে মেতে থাকতাম। কখনোই রাস্তাঘাটে ও বাজারে দোকান থেকে খাবার দাবার খেতে পছন্দ করতাম না। বাসায় এসেই দেখতাম পকেটে টাকা নেই। প্রায় ঈদের দিন এমন হওয়ায়, একটা সময় অবশ্য মা সকালেই পকেট থেকে আমার টাকা নিজ হেফাজতে রাখতেন। বাসায় এসে পকেটের টাকা খুঁজতেই মা হাসাহাসি করত, পরে অবশ্য দিয়ে দিত। কয়েক বছর আগেও, আমার বয়সে বড় চাচাতো বোন আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। হাসার কারণ জানতে চাইলে বোন বলল, ঈদের দিন ও দুপুর বেলায় জ্যেঠা তোকে শীতকালে গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে পড়াতে বসত, বিষয়টি আমাদের খুব বিরক্ত লাগত, এজন্য তোকে দেখে হাসতেছি।

বাল্যকালে একটা বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকত, অনেক সময় ঈদের দিনও। কারণ আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আটটা বিদ্যালয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। বাবা সরকারি চাকরি করত, যেখানে ট্রান্সফার হতো, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। শিশুকালে গ্রামে কিছুদিন থাকলেও ওই সময় তিনটা বিদ্যালয় পরিবর্তন করা অলরেডি শেষ। বিদ্যালয়গুলোতে কিছুদিন অতিবাহিত করা মাত্রই আমার সঙ্গে অনেকের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যেত। আমি স্কাউট, বিএনসিসি, আন্তঃবিদ্যালয় টুর্নামেন্ট এবং ডিবেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকতাম। এ কারণে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে দিন কয়েকের মধ্যেই সুসম্পর্ক তৈরি হতো। তখন মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ না থাকায়, অধিকাংশকে পরবর্তী জীবনে আর খুঁজে পেতাম না। মনে পড়লেই ঈদের দিনও আমার কান্না আসত। অধিকাংশকে আর কখনো খুঁজে পাইনি।

কোন এক ঈদের আনন্দের মধ্যে আমার জীবনে বিষাদ নেমে আসে। আমি দিনাজপুরের হিলি বন্দরের পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জের দাউদপুর ডিগ্রি কলেজে মাদকবিরোধী কনসার্ট করেছিলাম। কনসার্টে স্থান পাওয়া একটি লোকসংগীত আমার এখনো মনে পড়ে। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। কর্মসূচি শেষ করে আমি ঢাকা হয়ে সিলেট গমন করি। সিলেট থেকে মাদক কারবারিরা আমাকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে যায়।

এবার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী ও সমর্থক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রমজানে মায়ের হাতের ইফতার তাদের ভাগ্যে জোটেনি। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনেও মায়ের হাতে সেমাই, মিষ্টি, চটপটি, ফিরনি, ফালুদা থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয়। সবাই নির্বিঘ্নে নিজ গৃহে পরিবারের সঙ্গে যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে- এ ব্যবস্থাটি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ঈদের সময় ও পক্ষ-বিপক্ষ তকমা দিয়ে কারও ওপর যেন হামলা করা না হয়। মনে রাখতে হবে- জীবন রক্ষা করা সবার অগ্রাধিকার। তারপর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমি আশাবাদী এই ঈদে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। কারণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছেন একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।

ঈদুল ফিতর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ উপলক্ষে আমার জন্য যে কর্মসূচি সাজানো হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখলাম, এবার ঈদেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে আমার ঈদ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে না। কারণ ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহলের আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে হবে। ঈদ ৩১ মার্চ হলে আমার ঈদ চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে/সংলগ্ন স্থানে উদ্‌যাপন করতে হবে। আর যদি পহেলা এপ্রিল হয়, তবে আমার ঈদুল ফিতর শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে উদ্‌যাপন করতে হবে।

আসুন এবার ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিই। পোশাক-আশাকের এই সস্তার জমানায় কেউকে যেন ঈদুল ফিতরের দিন পুরোনো জামাকাপড় পরতে না হয়। আসুন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা দেরি না করে, এখনই পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়ি, পাড়া ও মহল্লায় খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

পরিশেষে এই কামনাই রইল, তাপসী ও আছিয়াসহ সবার ঘরে পৌঁছে যাক ঈদুল ফিতরের আনন্দ। যারা তুচ্ছ কারণে জর্জরিত। কেউ বা বিনা দোষে শকুনের রোষানলে পড়ে অকালে জীবন দিতে হয়েছে। তারা যেন না ফেরার দেশে ভালো থাকে।

লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভারতে ঈদগাহে আসা মুসলিমদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল হিন্দুরা

ঈদগাহে মুসল্লিদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা

‘দ্রুত নির্বাচন না হলে আরও একটি স্বৈরাচার জন্ম নিতে পারে’

‘১৭ বছর পর স্বাধীনভাবে ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছি’

সাম্যের প্রতীকে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর

মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের স্বল্পচাপ থাকবে যেসব এলাকায়

এবারের ঈদে অনেক পার্থক্য আছে: মির্জা ফখরুল

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বিএনপির

শোলাকিয়ায় ৬ লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে ঈদ জামাত

সব ধরনের নেতিবাচক কাজ থেকে দূরে থাকার আহ্বান সারজিসের

১০

ঈদের ময়দানে ব্যতিক্রমী আপ্যায়ন

১১

সিলেট শাহী ঈদগাহে লক্ষাধিক মানুষের নামাজ আদায়

১২

বায়তুল মোকাররমে ঈদের পাঁচ জামাত অনুষ্ঠিত

১৩

ঈদ উপলক্ষে বিশেষ বার্তা দিলেন হামজা ও জামাল

১৪

শ্রীমঙ্গলে রাতভর বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, সাবেক মেয়রসহ আটক ১৪

১৫

৮ বছর পর নুজাইরা বাবার সঙ্গে ঈদ করবে

১৬

ঈদের দিন সুস্থ থাকতে কী কী খাবেন

১৭

সারা দেশে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদুল ফিতর উদযাপন

১৮

ঈদের দিন বদহজম থেকে রক্ষা পাবেন যেভাবে

১৯

ঈদের দিন ইয়েমেনে মার্কিন হামলায় মসজিদ ধ্বংস

২০
X