মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:২০ পিএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৭:০৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. আবদুল মজিদ

আবার ফিরাও মোরে

ড. আবদুল মজিদ। ছবি : সৌজন্য
ড. আবদুল মজিদ। ছবি : সৌজন্য

নাটাই যার তার হাতেই ফিরতে হয় ঘুড়িকে। শুরু যেখানে শেষ হওয়ার রেওয়াজ বা রীতি নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। মানুষ এ দুনিয়ায় আসে যেভাবে একা আবার ফিরেও সেভাবে একা। তার সাথে সখ্যতা শক্রতায় আনন্দ সর্বনাশে সবার সাহচর্য সব সাঙ্গ হয় পরপারে তার পাড়ি জমানোর সময়। অনেক হিসাব কষে দেখা গেছে শূন্যই সবচাইতে শক্তিশালী সংখ্যার সংস্থাপয়িতা। শূন্য সংখ্যাটি গোল বা বৃত্তাকার। বিন্দু শুরু থেকে শেষে মিলিত হয়েই বৃত্ত তৈরি হয়। বিন্দুর যাত্রা সমাপ্তিতে বৃত্তের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। কোনো কিছু শুরু না হলে শেষ হয় না। আর শেষে পৌঁছানোই হচ্ছে সব সবকিছুর ধ্রুপদ গন্তব্য।

বিশাল আকাশের শূন্যতাই সব সৌন্দর্যের আধার। ‘নাই’-এর মধ্যেই অস্তিত্বের ব্যাখ্যা মেলে। আলো-আঁধার একে অপরের পরিপূরক। সুখের তৃপ্তি দুঃখ ভোগের মাত্রানুযায়ী অনুভূত হয়। আনন্দ আর সর্বনাশের মধ্যকার সম্পর্কটাও তেমন। একজন আছে বলে অন্যের অভাব বোঝা যায়। এরা দুজন এক সাথে থাকে না, তুমি থাকলে ভাই আমি নাই—এই চুক্তিতে যেন সবাই। তবে উভয়ের মধ্যে দারুণ যোগাযোগ। ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে’— ছন্দের জাদুকর সত্যেন বাবু অনেক বুঝে শুনেই বলেছিলেন কথাটি। সুখের সন্ধান পেতে হলে আগে দুঃখের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া চাই। দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় না— হতে পারে না। আবার সুখই হচ্ছে দুঃখের সাথে সমন্বয়যোগ্য অগ্রিম। সুখ অবিরাম অব্যাহত নয়, দুঃখের জন্য তাকে পথ ছেড়ে দিতেই হবে। মনীষী মহাজনরা তাই পরামর্শ দিয়েছেন দুঃখে মুষড়ে পড়তে নেই— দুঃখ এসেছে, সুতরাং সুখ আসছেই— আবার সুখের সময় দুঃখের আগমনী ভাবনার ঠাঁই চাই। সুখের সময় দুঃখের আর দুঃখের সময় সুখের কথা স্মরণেই সমন্বিত, সুরভিত ও ভারসাম্য সময়ের সন্ধান মেলে। এর জন্য বিধি প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন পড়ে না। প্রকৃতি অতিমাত্রায় নিরপেক্ষ ও প্রজাতন্ত্রী। সুখ আর দুঃখ বাই ডিফল্ট অস্থায়ী, এদের দুজনকে স্থায়ী করার জন্য কোনো কমিটি করার দরকার নেই। আসা যাওয়ার মধ্যে তারা থাকবে চিরকাল এমন কথা লেখা আছে সব কেতাবে।

কেতাবের কথা কানে সহজে ঢোকে না, ঢুকতে দেয় না স্বর্গচ্যুত সেই শয়তান যে মানুষের মনে মরীচিকার মোমবাতি জ্বালিয়ে সুখকে স্থায়ী করবার জন্য আর দুঃখে ভেঙে পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারাবার কত কনসালট্যান্সি ওরফে শলা-পরামর্শইনা দিয়ে চলেছে। সুখ সন্ধান আর তার স্থায়িত্বকরণের উগ্র আকাঙ্ক্ষায় মাত্রারিক্ত প্রয়াস প্রচেষ্টা প্রকৃতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের পরিপন্থি। ক্ষেত্র ও পাত্রভেদে অনেক কিছুতে মাত্রাতিক্রমনের ফলে বিপরীত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন অধিক মাত্রায় সাহস হঠকারিতায়, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত হতে পারে। কথায় বলে বৈধ-অবৈধতার রুলস অব বিজনেস সবার ঠিকমতো জানা না থাকায় অবৈধতার অব্যাহত অগ্রযাত্রা দেখে অনেকে নিজের ঈমান অটুট রাখার ক্ষেত্রে বেসামাল বোধ করেন। ইতিহাসের পাতার দিকে নজর দেওয়ার সময় হয় না বলেই হয়ত শনিবারকে সবাই সব কিছু ভাবার মধ্যে সীমাবদ্ধত হয়ে যায়। শনিবারের পর রোববার আছে সোমবার আসবে একথা মানলে অন্যায় অনিয়ম অবিচারের স্থায়িত্ব ধারণকল্পে কোনো আরজি পেশ করার সুযোগ থাকে না। ইউসুফ নবীর স্বপ্নের ব্যাখ্যার মতো আট বছর অতি সুখে সম্মানে সখী সাহচর্যে সাঙ্গ করার পরে সাত বছর শ্রীঘরে নিবর্তনে নির্যাতিত হওয়ার ফলাফল শেষমেশ ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়নের পর্যায়েই পড়ে। টলস্টয় না ভেবে বলেননি একজন মানুষের সাড়ে তিন হাতের বেশি জায়গার প্রয়োজন নেই। সুখ-শান্তি আর সম্মান আপেক্ষিকতায় আকীর্ণ, যা অর্জনে গর্জনের প্রয়োজন পড়ে না অনুভবের আয়নায় তা প্রতিফলিত হয়। যে কোনো পরিবেশে আমি কেমন আছি এটি যেভাবে উচ্চারিত হবে সেটাই এর অবয়ব। বৈধ ধীরস্থির, শান্ত সমাহিত যা বৈধ অর্জনে ক্লেশ আর বর্জনে আছে মাদকতা। পক্ষান্তরে অবৈধ প্রচারসর্বস্ব, চাকচিক্যে ভরা— যা অর্জনে অনুসরণে আনন্দ আর বর্জনে লাগে ব্যথা।

আমার আমিকে আমি কীভাবে দেখি বা বিবেচনা করি সেটিই মুখ্য। আমার নিজের হিসাব আমাকেই দিতে হবে। বিশ্বনবীর বিদায় হজের ভাষণে স্পষ্টকরণ হয়েছে যেটি— শেষ বিচারের দিনে পিতার দোষের জন্য দায়ী করা হবে না পুত্রকে আর পিতাকে জবাবদিহি করতে হবে না পুত্রের জন্য। একইভাবে স্বামীর জন্য স্ত্রীকে এবং স্ত্রীকে স্বামীর ব্যাপারে হিসাব দিতে হবে না। সুতরাং অন্যের সুখের লাগিয়া আমার হিসাব বহি বিকলনে ব্রতী হতে নাহি চাহি বধূ হে। আমার অস্তিত্ব আমাতেই। আমার বাইরে আমি নই। সার্তো সাহেব তার অস্তিতত্ববাদবিষয়ক বিবৃতিতে এ কথা বলতে ভোলেননি, আমি আছি বলেই আমার চারদিকে সবই আছে। আমার অবর্তমানে আমার উপলব্ধিতে কিছুই নাই। অন্যের কাছে আমার অস্তিত্ব আমার ভূমিকার, আমার অবয়বের নয়। আমি আমার ভূমিকাকে কাল থেকে কালান্তরে পরিব্যাপ্ত করতে পারি কিনা সেটি নির্ভর করবে ভূমিকার বলয় ও ব্যাপ্তির ওপর। রবীন্দ্রনাথের সমকালে যারা জীবনযাপনে ছিলেন উত্তরকালে তারা সবাই রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিনিয়ত স্মরণীয় সত্তায় পরিণত হননি। রবীন্দ্রনাথ তার সৃজনশীল ভূমিকার মাঝে অশরীরেও অস্তিত্ববান। আমি আমার মরহুম পিতার মুখ মনে করতে পারি, আমার পিতামহের নাম-ধাম জানি, প্রপিতামহের নাম শুনেছি, তার পিতার নাম পারিবারিক পাজিপুঁথিতে পাব, কিন্তু তৎপূর্ববর্তী তস্যদের কারও সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। জানার তেমন প্রয়োজনও বোধ করি না। অর্থাৎ তারা আমার বিবেচনার বাইরে। অথচ তারা প্রত্যেকে তাদের সময়ে সচল সজীব জীবনযাপন করতেন, সুখ-দুঃখের ভেলায় চেপে ভব দুনিয়ার বৈতরণী পার হয়েছিলেন। আমার স্বার্থ চিন্তায় তারা যেমন অবর্তমান আমার পরবর্তী চার থেকে পাঁচ প্রজন্মের কাছে আমিও তেমন ক্রমান্বয়ে অবর্তমান হয়ে যাব। আমার বর্তমান জীবনধারা তাদের কাছে স্মরণের অতীত হয়ে যাবে। মহাসিন্ধুর ওপর থেকে ভেসে আসা সংগীতের মূর্চ্ছনার মতো মনে হবে সবই।

আমার অস্তিত্ব, আমার উত্থান, আমার বিকাশের জন্য পরিবেশের যে ভূমিকা তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আল কোরআনের সাক্ষ্য এই, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন।’ পরিবেশ আমাকে নানাভাবে আমার মেধা ও মননকে আমার অনুভূতিকে জাগ্রত করতে সহায়তা করেছে। আমার আনন্দ-সর্বনাশ, আমার সুখ-দুঃখ সবই এই পরিবেশের প্রযন্তে প্রদত্ত। পরিবেশের সাথে লেনদেনে আমার নিজের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। মহাকবি ইকবালের ভাষায় ‘আপ দুনইয়া আপ পয়দা করো’। পরিবেশ আমার কাছে ভালো-মন্দ সবই সমুপস্থিত করেছে। আমি তার থেকে যা যেমন বেছে নেব আমার ললাটে তাই হবে লেখা। সংসারে সবাই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিধাতার বিধানই এমন। বিধাতা নিজে এসে সরাসরি কাউকে সাহায্য করেন না। তিনি কারোর না কারোর মাধ্যমে সহায়তার ব্যবস্থা করেন। বিধাতার ইচ্ছাই এই, একে অপরের কল্যাণে নিবেদিত নিয়োজিত হয়ে তার হুকুম তামিল করবে। উপকার করো এবং উপকৃত হও এই ব্রত সবার হওয়া চাই যদি আমরা বিধাতার মহান ইচ্ছা পালনে দৃঢ়চিত্ত হই। পরস্পরের সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে একাগ্রচিত্ত হওয়ার অনিবার্যতা এ জন্য, পরিবেশ উন্নত হলে সুশীল সময় সুনিশ্চিত হবে সবার।

প্রকৃতির কাছে ফিরতে হবে। প্রকৃতির প্রতি বিরূপ আচরণ করা হলেই প্রকৃতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে। বৃক্ষ মানুষকে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং মানুষ নিঃসৃত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে মানুষেরই জীবনধারণে রাখছে অনিবার্য অবদান, এখন সেই গাছের জীবন শেষ করে দেওয়া মানে মানুষেরই বেঁচে থাকার অবলম্বনকে শেষ করা এই সহজ স্বতঃসিদ্ধ শিক্ষাটি মানুষেরই উপলব্ধির উপলব্ধিতে আসা উচিত, নয় কি? করোনা মোকাবিলায় প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার চেতনা উজ্জীবিত হয়েছে। মহামারিকালে কৃত্রিম অক্সিজেন, রাসায়নিক ওষুধ, যন্ত্রচালিত চিকিৎসার প্রয়োজনই পড়ে না যদি স্বাস্থ্য সচেতনতার স্বভাব ব্যক্তি ও সমাজে অবলম্বন করা যায়। ৫ মিলিগ্রাম একটি ট্যাবলেটের মধ্যে একটা টমেটো, আপেল কিংবা লেবুর নির্যাস কতটুকুই বা ধরানো গেছে। ‘এ পেপে এ ডে কিপস দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে’ এই কথা বা ধারণাটা আপ্তবাক্য হিসেবে শুধু উচ্চারণে সীমিত হয়ে থাকবে? বাস্তবায়নে ফিরতে হবে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব ও এন বি আর এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির আটক

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১০

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১১

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১২

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৩

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৪

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৫

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৬

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৭

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

১৮

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির আভাস

১৯

আমার কষ্ট নেই, আজ আমরা স্বৈরাচারমুক্ত : আহত তানভীরের পিতা

২০
X