আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। অমর একুশে এখন শুধু বাঙালির নয়। একুশে এখন সারা বিশ্বের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার এক অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরও বেশ কজন শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তাই এ দেশের রক্তঝরা প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এ জন্য প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। একুশ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দিনটি একদিকে শোকাবহ, অন্যদিকে গৌরবোজ্জ্বল। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন শুধু এ দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন চেতনা-প্রবাহ সৃষ্টি করেছিল। এ চেতনা ছিল বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধসঞ্জাত।
একুশ আমাদের অহংকার ও প্রেরণা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল। একুশের অবিনাশী চেতনা আমাদের প্রেরণা দেয়, করে উজ্জীবিত। এই প্রেরণা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। নতুনভাবে বাংলাদেশকে গড়ার স্বপ্ন দেখায়। একুশ আমাদের চেতনা শাণিত কথার এক বড় অস্ত্র। একুশ মানে অন্যায়েরর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া। যতদিন বাঙালি আর বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন একুশ আমাদের সামনে চলার আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে অন্ধকার থেকে আলোর পথে চলতে। একুশ আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে এক অবিনাশী চেতনার নাম। একুশ আমাদের কণ্ঠে ভাষা দিয়েছে, হৃদয়ে দিয়েছে আবেগ, চেতনায় জাগিয়েছে দৃঢ়তা আর বুকে দিয়েছে সাহস। একুশ আমাদের মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছে। যেমনটি উদীপ্ত করেছে সাঈদ কিংবা মুগ্ধদের ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে। তাদের পথ অনুসরণ করে বর্তমান প্রজন্মকে যথাযথভাবে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে যাতে তারা একুশের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে সত্য-ন্যায়ের পথে এগিয়ে যেতে পারে। দেশকে, দেশের মাটিকে ভালোবাসতে পারে হৃদয় থেকে। একুশের চেতনায় বাঙালি বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছে।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি মানুষ এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছে, তা নয়। এ দিনটি বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বে মিশে আছে এবং থাকবে চিরদিন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে এভাবে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়নি।
বাংলাদেশের মানুষের এ বিরল ত্যাগ ও বিসর্জনের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার জন্যই জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
একুশের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। পাক-হানাদার বাহিনী গুলি করেও যেমন মানুষের কণ্ঠ রোধ করতে পারেনি, একই কায়দায় গত জুলাই মাসেও পুলিশ ও র্যাবকে ব্যবহার করে মানুষকে সরাসরি গুলি করেও তাদের গদি রক্ষা করতে পারেনি। আম-জনতা তাদের বুক পেতে দিয়েছেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিয়নশিল্পী, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশা মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার কোনোভাবেই ক্ষমতায় টিকতে পারেনি।
দেশের সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, বিবেক ও নীতি-নৈতিকতার আলোকে আমাদের সবাইকে উদ্ভাসিত হতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বত্র জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব নাগরিক যাতে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি স্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজিয়ে পুরো রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার করতে হবে। জানি, সবকিছু একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের ধীরগতিতে ক্রমাগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন বা বিভিন্নভাবে এ আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন, তারা আমাদের এ পথের সন্ধান দিয়েছেন। আমাদের সে পথ ধরে সামনে অগ্রসর হতে হবে। অমর একুশের ভাষাশহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি আমাদের এমন এক আবেগের কেন্দ্রে অবস্থান নেয়, যা কেবল একটি মাস মাত্র নয়, একটি চেতনা। সারা পৃথিবীতেই ফেব্রুয়ারি আসে, বাংলাদেশে যেভাবে ফেব্রুয়ারি আসে, তেমন করে আর কোথাও নেই। ফেব্রুয়ারি গোটা মাসটাই আমাদের গৌরবের আর আত্মমর্যাদাপূর্ণ ত্যাগের স্মৃতিতে ভাস্বর।
ভাষা আন্দোলন আমাদের কম দেয়নি। আমাদের স্বাধীনতার জন্ম রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকেই। অমর একুশে এখন বিশ্বব্যাপী একটি স্মরণীয় দিনও। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এ কম গৌরবের নয়। বাহান্ন থেকে ২০২৫। দীর্ঘ সময় দেখতে দেখতে ৭৩ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু এতটুকু আবেদন ফুরোয়নি একুশের। বরং যতই দিন গিয়েছে শোকের স্মৃতি ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে শক্তিতে এবং বিশ্বময় মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় তা উন্নীত। কিন্তু সেই অর্জন এবং উন্নয়নকে আমরা কতখানি ব্যবহার করতে পারছি, সেটাও ভাবতে হবে এখন।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে অনেক অগ্রসর হয়েছে, যা বিশ্ববাসীর কাছে এখনো বিস্ময়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করা মানেই টেকসই উন্নয়ন নয়। অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা না গেলে সে সমাজের উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়িত্ব পায়না এবং তা যথাযথ কল্যাণ-রাষ্ট্রের কাজেও লাগে না। সাহিত্য মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যবোধের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। জ্ঞানভিত্তিক সেই সমাজ গড়ে না ওঠায় আজকে বাংলাদেশে নির্মম আত্মকেন্দ্রিকতা আর স্বার্থান্বেষী নিষ্ঠুরতার সংস্কৃতি সর্বত্র বিরাজমান। এ থেকে পরিত্রাণের পথ একটাই তা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে একটি সরকারে পতনের মধ্য দিয়ে দেশ নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এমনই এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পালিত হতে যাচ্ছে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এবারের একুশ তাই আমাদের অধিকার ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকুক। একুশের চেতনার পতাকা হাতে নিয়ে তরুণ প্রজন্ম নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে সামনের দিকে অগ্রসর হবে। দেশবিরোধী সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে নতুন এক আধুনিক জ্ঞাননির্ভর সাম্যতার বাংলাদেশ তৈরি করবে। একুশের চেতনায় জাগ্রত বাঙালি অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে সকল ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেশের আর্থসামাজিক বিকাশ বেগবান রাখবে-এই হোক এবারের একুশের অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মন্তব্য করুন