ইয়াহিয়া জিসান
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ছাত্রশক্তির উত্থান-পতন : গণঅভ্যুত্থান সময়ের রাজনীতি

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়েছে ছাত্র-জনতার দুর্বার গণআন্দোলন। ভোটাধিকার হরণ, গুম-খুন, নিপীড়ন, গণহত্যা—এমন কোনো অন্যায় নেই, যা খুনি হাসিনার হাতে সংঘটিত হয়নি। বিরোধী দল, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ইসলামপন্থি, সাংবাদিক—বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের রক্ত লেগে ছিল এই স্বৈরাচারের হাতে। তবে ইতিহাস সাক্ষী, কোনো স্বৈরাচারই চিরস্থায়ী হতে পারে না। এই গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর দীর্ঘদিনের লড়াই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা বলতেই হবে।

গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির প্রায় সকল সমন্বয়ক ছিলেন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র সদস্য। সাদা চোখে এই আন্দোলনের শুরুটা কোটা সংস্কারের দাবিতে হলেও আদৌ আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে থাকা এই শিক্ষার্থীরা কি শুধু কোটা সংস্কার চেয়েছিলেন? নাকি আন্দোলনের সূত্রপাত কোটা সংস্কারের দাবিতে হলেও, মূল নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের মনের লক্ষ্য ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। ফলে বোঝা দরকার— কোন লক্ষ্যে গড়ে উঠছিলো গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’।

২০১৮ সালের উত্তাল সময়ের দিকে তাকাই। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। দীর্ঘ টালবাহানার পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুরোপুরি বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’, যা পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনেরই একজন নেতা নুরুল হক নুর পরবর্তীতে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন।

আমরা যারা রাজনীতি সচেতন ছিলাম কিন্তু সক্রিয়ভাবে যুক্ত হইনি, তারাও এই নবগঠিত সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করি। আমিও ব্যক্তিগতভাবে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’-এ যোগ দিই এবং বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন এই সময়ে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা। ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র একজন সংগঠক হিসেবে, আমার পক্ষে এই বিশ্লেষণ হয়ত কিছুটা সহজ হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন বিন ইয়ামিন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক হন আরিফুল ইসলাম আদিব। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর থেকেই একটি প্রো-ইসলামিক ও ভারতবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা অন্যান্য প্রচলিত ছাত্রসংগঠনগুলোর তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমী ছিল। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন থেকেও শিক্ষার্থীরা এতে যোগ দিতে শুরু করে। এমনকি ছাত্রশিবিরের সংস্কারপন্থি একটি অংশও এই সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল বলে গুঞ্জন আছে।

২০২৩ সালে সংগঠনটি ভাঙনের মুখে পড়ে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এটি কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু গণঅধিকার পরিষদের প্রথম কাউন্সিলে সংগঠনের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিব অগঠণতান্ত্রিকভাবে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

তখন আমি ছাত্র অধিকার পরিষদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-অধিকার পরিষদের সভাপতি ছিলেন আসিফ মাহমুদ, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। বিতর্কিত এই ঘটনার পর ২০২৩ সালের ৯ জুলাই, আসিফ মাহমুদ আমাকে ফোন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তিনি একটি মিটিংয়ের আয়োজন করেন, যেখানে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, আমাদের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এই ঘটনার প্রতিবাদে একযোগে প্রেস রিলিজ দেওয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস রিলিজ প্রকাশ করলেও, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। আসিফ মাহমুদ আমাকে প্রেস রিলিজ প্রস্তুতের দায়িত্ব দেন, যা লিখে আমি তাকে পাঠাই। ওই প্রেস রিলিজে গণঅধিকার পরিষদের কমিটিতে সদস্য পদ গ্রহণ করায় সংগঠনের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিবের পদত্যাগ দাবি করা হয়। গঠনতন্ত্রবিরোধী লেজুড়বৃত্তির কারণে সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং এই ঘটনার মাধ্যমে ছাত্র অধিকার পরিষদের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রেস রিলিজ প্রকাশের পর সংগঠনের ভেতরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ আমাদের এই পদক্ষেপকে সাহসী ও ন্যায়সংগত বলে প্রশংসা করেন, আবার কেউ কেউ তীব্র এবং মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেস রিলিজ পাঠানোর কারণে গণঅধিকার পরিষদের বর্তমান দপ্তর সম্পাদক শাকিলুজ্জামান আমাকে ফোন করেন। তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং জানান যে, আমাদের এই পদক্ষেপে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর গভীরভাবে কষ্ট পেয়েছেন। তখন গণঅধিকার পরিষদের প্রথম কাউন্সিলের ভোটাভুটি চলছিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের দেওয়া এই প্রেস রিলিজ দলের জন্য ছিল বড় ধরনের চপেটাঘাত।

এই পুরো ঘটনায় একজন ব্যক্তি বিশেষভাবে 'সহযোগিতাপূর্ণ' ভূমিকা পালন করেন—ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেন। তিনি একপ্রকার নেপথ্য 'ইনফ্লুয়েন্সার' হিসেবে কাজ করেন। প্রেস রিলিজ প্রকাশের আগে ও পরে তার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়। শুধু এই বিষয়ে নয়, ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতি, নতুন ছাত্রসংগঠনের সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে তিনিও আমাদের সঙ্গে আলাপ করেন।

ছাত্র অধিকার পরিষদ একসময় বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে যে আলো জ্বেলেছিল, সেটি ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছিল। লেজুড়বৃত্তির সংকট ছাড়াও সংগঠনের অভ্যন্তরে আরও অনেক সমস্যা ছিল, যা নেতাকর্মীদের হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। এবং অনেকেই ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমার সঙ্গে এসব বিষয়ে আসিফ মাহমুদ ও আখতার হোসেন ভাইয়ের আলোচনা চলতে থাকে।

২৩ জুলাই, (২০২৩) আসিফ মাহমুদ আমাকে জানান যে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ইউনিটসহ সংগঠন থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জানতে চান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটও একই সিদ্ধান্ত নেবে কি না। আমি সবার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য সময় নিই। সত্যি বলতে, তখন পদত্যাগের চিন্তার পাশাপাশি ছাত্র-অধিকার পরিষদ সংস্কার করারও একধরনের আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতরে কাজ করছিল।

পরদিন, ২৪ জুলাই (২০২৩), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের পুরো ইউনিট একযোগে পদত্যাগ করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাকর্মীরাও প্রতিক্রিয়া দেখান। শাবিপ্রবির ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা আসাদুল্লাহ গালিব পদত্যাগ করেন, আর তার দুই দিন পর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আখতার হোসেনও পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

ফেসবুকে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আখতার হোসেন সংগঠন থেকে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই স্ট্যাটাসে তিনি ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতি তার গভীর আক্ষেপ, অভ্যন্তরীণ বঞ্চনা, গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদ একটি কঠিন সংকটে উপনীত হয়, এবং নিশ্চয়ই তখন সংগঠনটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে।

পদত্যাগকারী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। নতুন একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকেও পদত্যাগের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিই। তবে নানা বাস্তব কারণে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে সে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হই। এর পরপরই জাহাঙ্গীরনগর ইউনিট প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এই সময় আমরা অন্য ধরনের ছাত্র-একটিভিজমে সক্রিয় হই। বিশেষ করে, আমি গড়ে তুলি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম—‘পুনর্পাঠ’। ছাত্র অধিকার পরিষদ, জাবি ইউনিটের নিষ্ক্রিয় কর্মীদের অনেকেই এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। আমরা নিয়মিত পাঠচক্র ও সেমিনারের আয়োজন করতে থাকি। এটি ছিল আমাদের জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লড়াইয়ে নিজেদের গড়ে তোলার একটি ধাপ।

একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করা নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন পাঠচক্র গঠনের উদ্যোগ নেয়। এসব পাঠচক্র গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন বর্তমান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। যদিও তিনি সরাসরি ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে ছাত্রশক্তি গঠনের নেপথ্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একইভাবে, নাগরিক কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারীও এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমসাময়িক সময়ে আরেকটি পাঠচক্র গ্রুপ সক্রিয় ছিল—‘স্বচিন্তন’। এটি গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান সদস্য সচিব আরিফ সোহেলের নেতৃত্বে। আরিফ সোহেল ও তার দল নিয়মিত পুনর্পাঠের পাঠচক্র ও সেমিনারে অংশ নিত, আমরাও তাদের দালিলিক আলোচনায় যুক্ত হতাম।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস, আসিফ মাহমুদ আমাকে নক দিয়ে জানান যে তারা কয়েকজন জাহাঙ্গীরনগরে আসতে চান। আমি তাদের আমন্ত্রণ জানাই, এবং পরবর্তীতে তারা জাহাঙ্গীরনগরে আসেন। এই দলে উপস্থিত ছিলেন আসিফ মাহমুদ ছাড়াও বর্তমান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সমন্বয়ক আব্দুল কাদের, আবু বকর মজুমদারসহ আরও কয়েকজন।

জাহাঙ্গীরনগরের মুরাদ চত্বরে বসে আমরা নতুন ছাত্রসংগঠন গঠনের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করি। তাঁরা আমাকে জাহাঙ্গীরনগর থেকে কয়েকজনকে নতুন সংগঠনে যুক্ত করার অনুরোধ করেন। আমি কয়েকজনকে ফোন দিই, তবে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া অধিকাংশ কর্মী নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে তখনো দ্বিধান্বিত ছিলেন। এই সময় আমি আরিফ সোহেলকে ডেকে তাকে আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁরা আরিফ সোহেলকে নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান, এবং আরিফ সোহেল এতে ইতিবাচক সাড়া দেন।

কয়েকদিন পর, নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব এলে বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দিই। যদিও আমি কোনো পদ গ্রহণে আগ্রহ দেখাইনি, তবু নতুন ছাত্র সংগঠনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিই। এসময় আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলাম জানান, নতুন ছাত্রসংগঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামটি প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি নামটি নিয়ে আরও ভেবে দেখার পরামর্শ দিই, তবে শেষ পর্যন্ত এটিই চূড়ান্ত করা হয়।

৪ অক্টোবর ২০২৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়, যেখানে আহ্বায়ক হন আখতার হোসেন এবং সদস্য সচিব হন নাহিদ ইসলাম। কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি ঘোষণা করা হলে আহ্বায়কের দায়িত্ব পান আসিফ মাহমুদ, আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পান আবু বকর মজুমদার। ঘোষণার দিনই সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এতে গুরুতর আহত হন আহ্বায়ক আখতার হোসেনসহ অনেকেই।

আত্মপ্রকাশের পর সংগঠনটি শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। চব্বিশের জানুয়ারিতে যখন শেখ হাসিনা সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এই নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতাকর্মীরা শুরু থেকেই তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি শেখ হাসিনা সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। সেই সময়, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়, ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছিল না, আর ছাত্র অধিকার পরিষদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ থমকে, তখন একমাত্র গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিই ঢাবি ক্যাম্পাসে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দৃশ্যমান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।

৬ জুন ২০২৪। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে আন্দোলনের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতারা। বিশেষত, ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব নাহিদ ইসলামকে এই বিক্ষোভের অন্যতম মূল সংগঠক হিসেবে দেখা যায়। এছাড়া সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আসিফ মাহমুদসহ কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পরবর্তী বিভিন্ন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিতে থাকেন।

আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত ও অংশগ্রহণমূলক করতে পরবর্তীতে এর ব্যানারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এই ব্যানারের অধীনে আন্দোলন ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলায়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই আন্দোলনের ছায়াতলে এসে একত্রিত হন।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবির এই আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং এটিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা, জনসমাগম ও অর্থায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়। বিশেষত, আন্দোলনের মূল দাবি নির্ধারণে বা ‘নয় দফা’ চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। নয় দফা ঘোষণার অন্যতম মুখপাত্র আব্দুল কাদের নিজেই এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।

এই অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তি ছিল ছাত্রদল, যারা আন্দোলনের মাঠপর্যায়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়। একইসঙ্গে, অন্যান্য ইসলামপন্থি ছাত্রসংগঠন এবং কিছু বামপন্থী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। অভ্যুত্থানের নেপথ্যে অন্যতম কারিগর ছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তাঁর দল গণঅধিকার পরিষদ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা সারাদেশে জেলা পর্যায়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন এবং সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। এ অভ্যুত্থানের পেছনে আরও অনেক ‘মাস্টারমাইন্ড’ কাজ করেছেন, যারা আন্দোলনকে সুসংগঠিত ও কার্যকর করার জন্য নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি খুলনা শহরে অবস্থান করে সামনের সারির একজন যোদ্ধা হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই আমার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কিংবা আসিফ-নাহিদ-আখতার ভাইদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে— কীভাবে খুলনা এবং সারাদেশে আন্দোলনকে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী করা যায়, এসব নিয়েই চলেছে আলাপ-আলোচনা।

সাদা চোখে চব্বিশের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এর মূল নেতৃত্বের অন্তরে বরাবরই লালিত ছিল বৃহত্তর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের একটি ট্রেন স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে। যাদের মধ্যে শুধু কোটা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ছিল তারাও একপর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের এই ট্রেনে চড়তে বাধ্য হয়। খুনি হাসিনার বর্বর নিপীড়ন, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস গণহত্যা তাঁদের পিঠ ঠেকিয়ে দেয় দেয়ালে।

তবে, এটি নিছক কিছু ব্যক্তির নেতৃত্বের গল্প নয়— এই গণঅভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতার সম্মিলিত রক্ত, আত্মত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এক গৌরবগাঁথা। প্রায় ২০০০ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা সংঘটিত করতে পেরেছি এই গণঅভ্যুত্থান। তবে এটিকে শুধুমাত্র গণঅভ্যুত্থান বলে সংজ্ঞায়িত করলে তা অসম্পূর্ণ হবে; আমরা আজ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। এই বিপ্লবের অংশীজন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, অভিভাবকরা, শ্রমিকরা, গার্মেন্টস কর্মীরা, এমনকি কৃষকরাও। তবে, এই বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে সামনে ছিল সেইসব বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা, যারা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির পতাকাতলে থেকে একটি গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের স্বপ্ন বুনেছিলেন। এ ছিলো ছাত্রশক্তির অগ্নিশিখা থেকেই বিস্ফোরিত সেই বারুদের আগুন, যা বাংলার গ্রাম-শহরের জনপদে জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই গণঅভ্যুত্থানকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ‘ব্রেইনচাইল্ড’ বললেও বোধ করি অত্যুক্তি হবে না।

হাসিনার পতনের পর, গত ১৪ সেপ্টেম্বর (২০২৪) আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। চব্বিশের বিপ্লবের ইতিহাস বুঝতে হলে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ভূমিকা বোঝা অপরিহার্য। কেননা, এটি কেবল একটি সংগঠনের গল্প নয়— এটি এক বিপ্লবী চেতনার স্ফুলিঙ্গ। খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসে সংগঠনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে আশা করা যায়।

ইয়াহিয়া জিসান: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; আহ্বায়ক, জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

ঢাবির সাবেক ভিসি আরেফিন সিদ্দিক আর নেই

৯ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় থানা ঘেরাও

দুই মাসে সংখ্যালঘু হামলার ঘটনা ৯২টি : ঐক্য পরিষদ

১৩ মার্চ ‘আছিয়া দিবস’ পালনের প্রস্তাব জামায়াত আমিরের

আছিয়া হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বিক্ষোভ

৬ লাখ শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াবে ডিএনসিসি

চৌদ্দগ্রামে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার দোয়া ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

ঢাকা কলেজে ছাত্রশিবিরের ইফতার উপহার বিতরণ

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির আয়োজনে গ্র্যান্ড ইফতার ও মেজবান

১০

কারখানায় ‘ভূত’ আতঙ্ক, অসুস্থ ১৫

১১

জনগণের শক্তিতেই ক্ষমতায় আসবে বিএনপি: নীরব

১২

বরখাস্তকৃত এসপির হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ

১৩

ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে একটি পরিবার হয়ে থাকতে চাই : জবি উপাচার্য 

১৪

ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেল দুই যুবকের

১৫

সিরিয়ার রাজধানীতে ইসরায়েলের বিমান হামলা

১৬

ত্রিমুখী আন্দোলনে উত্তাল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি

১৭

আধিপত্য বিস্তারে প্রবাসীকে কুপিয়ে হত্যা

১৮

হিযবুত তাহরীরের ৯ জন রিমান্ডে, কারাগারে ১৩

১৯

এনসিপিকে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের আহ্বান ফারুকের

২০
X