জলবায়ু পরিবর্তন মানে যে শুধু উষ্ণতা বৃদ্ধি তা নয়, এটি বাস্তুচ্যুত মানুষের আর্তনাদ, হারিয়ে যাওয়া গ্রাম আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গল্প। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি জলবায়ু পরিবর্তন, যেখানে রয়েছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে অস্তিত্বের লড়াইয়ের এক কঠিন অধ্যায়। প্রতিনিয়ত গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি যে শুধু আমাদের পরিবেশকেই হুমকির মুখে ফেলছে তা নয় নাড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক কাঠামো ও অর্থনীতির ভিত্তি।
এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যাদের আমরা ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ হিসেবে চিনি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই এই সংকটের নির্মম বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছে। উপকূলীয় অঞ্চলে নদীভাঙন, লবণাক্ততার বিস্তার এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাজার হাজার মানুষকে তাদের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য করছে। তারা আশ্রয়ের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে, যা নগরায়ণের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। আর এই তাদের চেনা পরিবেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য মানুষদেরকেই মূলত "জলবায়ু উদ্বাস্তু" (Climate Refugee) বলা হয়।
এই ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেন পরিবেশ বিজ্ঞানী লেস্টার ব্রাউন (১৯৭৬), যেখানে তিনি জলবায়ুগত বিপর্যয়ের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরেন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, দাবানল কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে বাধ্য করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি জমাতে। এটি কখনো স্বল্পমেয়াদি হলেও, অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী অভিবাসনে রূপ নেয়।
আমাদের কাছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মূলত তিনটি প্রধান রূপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কেউ আকস্মিক দুর্যোগ যেমন সুনামি, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে "জরুরি পরিবেশগত উদ্বাস্তু" হয়ে যায়। কেউ দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত অবনতি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি বা কৃষিজমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় "পরিবেশগতভাবে বাধ্য উদ্বাস্তু" হয়। আবার কেউ আগেভাগেই সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে স্বেচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়, যাদের বলা হয় "পরিবেশগতভাবে উদ্বুদ্ধ উদ্বাস্তু"।
ক্রমশ বাড়তে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি উৎপাদনের পতন, নিরাপদ পানির অভাব এবং জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকট আমাদের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন "জলবায়ু নিরাপত্তা"—একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা, যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করবে। জলবায়ু নিরাপত্তা মানে কেবল দুর্যোগ মোকাবিলা নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, যেখানে প্রতিরোধ (prevention), অভিযোজন (adaptation) ও প্রশমন (mitigation)—এই তিনটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে টেকসই উন্নয়নের পথ তৈরি করা হয়।
জাতিসংঘের মতে, জলবায়ু নিরাপত্তা শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নীতি গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি খাদ্য নিরাপত্তা, পানিসম্পদের টেকসই ব্যবহার, মানবাধিকার এবং সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
এই জলবায়ু পরিবর্তন কেবল বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যানের বিষয় নয়, এটি লাখো মানুষের জীবনের গল্প—শেকড় হারানোর এক নির্মম বাস্তবতা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় প্লাবন, নদীভাঙন ও দীর্ঘস্থায়ী খরা আমাদের পরিচিত ভূগোলকে ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগুলো নিঃশব্দে ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে, লবণাক্ততা কৃষিজমিকে অনুর্বর করে তুলছে, আর উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা খরার নিষ্ঠুর চক্রে আটকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত সিডর, আইলা, আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড় জনপদ ধ্বংস করছে, নদীগুলো গ্রাস করছে হাজার হাজার বসতি। পদ্মা, যমুনা আর মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে পরিবারগুলো এক মুহূর্তেই সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে। পাহাড়ি অঞ্চলেও ভূমিধসের মাত্রা বাড়ছে, আর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
এই উদ্বাস্তুদের গন্তব্য কোথায়? তারা শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে আগে থেকেই মানবসৃষ্ট সংকট তীব্র। ঢাকার মতো শহরগুলোর বস্তিতে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলো বাসস্থানের অনিশ্চয়তা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্বাস্থ্যঝুঁকি আর দারিদ্র্যের চক্রে আটকে যাচ্ছে। জনসংখ্যার চাপ, নগর অবকাঠামোর ভঙ্গুরতা, চাকরির অভাব—সব মিলিয়ে এই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী এক নতুন সংগ্রামের মুখোমুখি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তাগুলো এখন আর ভবিষ্যৎ অনুমান নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিফলন। ১৯৮৮ সালে জডি জ্যাকসন পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের তুলনায় ছয় গুণ বেশি হতে পারে। ১৯৯৭ সালে নরম্যান মেয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ২০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) ২০০৯ সালে দেখিয়েছে, জলবায়ুগত বিপর্যয়ের কারণে ইতোমধ্যে ৩৬ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই সংকট থামাতে না পারলে হয়ত একদিন আমরাও উদ্বাস্তু হয়ে যাবো—পরিচিত ভূমি, শেকড়, সবকিছু পিছনে ফেলে নতুন এক অনিশ্চিত যাত্রায় নামতে বাধ্য হবো।
বর্তমান আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু আইন (জাতিসংঘ, ১৯৫১) রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত নিপীড়নের শিকার মানুষদের স্বীকৃতি দিলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত লাখো মানুষের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক সুরক্ষা নেই। ১৯৬৭ সালের কনভেনশন যুদ্ধ ও সহিংসতার শিকার জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতদের এখনো আইনগত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। ফলে, জলবায়ু উদ্বাস্তুরা সবচেয়ে অনিরাপদ ও অনিশ্চিত বাস্তবতার মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক আইনের অভাবে, তারা আশ্রয়শিবির থেকেও উচ্ছেদের ঝুঁকিতে থাকে, যদিও তাদের জন্মভূমি হয়তো চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। অধিকাংশই অভ্যন্তরীণ অভিবাসী, যারা গ্রাম বা উপকূল ছেড়ে শহরমুখী হলেও নতুন জীবনে সংকটের শিকার—জীবিকার অভাব, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিভেদ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সমস্যা এবং স্থানীয়দের সঙ্গে সামাজিক টানাপোড়েন। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনার এন্টোনিও গুটারেস সতর্ক করেছেন, উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে খাদ্য, পানি ও ভূমির জন্য বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা তীব্র হবে, যা সহিংসতা ডেকে আনতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র আবহাওয়ার রূপরেখা বদলাচ্ছে না, এটি আমাদের অর্থনীতি, জনসংখ্যার ভারসাম্য, মানবাধিকার এবং উন্নয়নের গতিপথকেও আমূল পরিবর্তন করছে। এই সংকটের সমাধান কেবল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের প্রয়োজন বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, যেখানে অভিযোজন, পুনর্বাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকবে একসঙ্গে। উপকূলীয় অঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে টেকসই অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেন জনবসতি বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে। কৃষিকে করতে হবে জলবায়ু-সহনশীল, আর নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। তবে, শুধুমাত্র অবকাঠামো বা প্রযুক্তি দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুষ্ঠু পুনর্বাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন জীবনে স্থিতিশীলতা পেতে তাদের সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা নতুন সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণ অপরিহার্য। এটি শুধু জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব নয়, বরং উন্নত দেশগুলোরও দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল দায় যাদের, তাদের উচিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া, বৈশ্বিক তহবিল গঠন করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো। কার্বন নিঃসরণ কমানো, ব্যাপক সবুজায়ন এবং জলবায়ু সচেতনতা বৃদ্ধি—এসবের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অবদান যেখানে সবচেয়ে বেশি, সেখানে তাদের দায়িত্বও সবচেয়ে বড়। যদি কিয়োটো প্রটোকলের মতো আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকট শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং গোটা বিশ্বকে সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।
আমাদের সামনে এখন দুটি পথ—একটি আমাদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে পারে, অন্যটি আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার হাত আরও প্রসারিত করতে হবে। অন্যথায়, অস্থিরতা ও মানবিক বিপর্যয়ে ভরা এক উদ্বাস্তু কবলিত পৃথিবীর দিকে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবো—যেখান থেকে আর ফিরে আসার সুযোগ থাকবে না।
শমরিতা বড়ুয়া: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন