বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নাটকীয় মোড় নেয় ৫ ফেব্রুয়ারি, যখন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার এই সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে অভ্যুত্থানের ১৮০তম দিনে, দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় এবং সন্দেহ সৃষ্টি করে যে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
একটি সাধারণ ফেসবুক পোস্ট মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়, যা সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকার কেন্দ্রে হাজারো বিক্ষোভকারীর সমাবেশ ঘটায়। ভাষণ শুরু হতেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ভবনের সামনে বুলডোজার পৌঁছে যায়, যা দ্রুতই অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনের একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়, যেখানে একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা ও বিক্ষোভের বিস্তার
এই ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। প্রায় ৪০ সেনাসদস্য ভবন রক্ষার চেষ্টা করলেও, তারা দ্রুতই বিক্ষোভকারীদের রোষের মুখে সরে যেতে বাধ্য হন। পরদিন সকালে, ঢাকা এক পরিবর্তিত বাস্তবতায় খুলে দেখে- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যা করতে পারেনি, তা মাত্র ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে গেছে। ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ভবনটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
কিন্তু যারা এই ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন, তারা শুধু সাধারণ জনতা বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নন। শহুরে মধ্যবিত্ত ও ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশও এ ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হাসিনার শাসনে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে তারা মনে করে। অনেকের জন্য এটি ছিল তাদের প্রথম রাজনৈতিক অভিব্যক্তির সুযোগ।
ইতিহাস ও উত্তরাধিকার
ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে শেখ হাসিনা সবসময় তার বাবার উত্তরাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সাধারণ জনগণের মধ্যে মুজিব ও হাসিনার মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে তিনি দেশত্যাগ করেন এবং ভারতে আশ্রয় নেন, যেখানে আবারও কূটনৈতিক জটিলতার শিকার হন।
আওয়ামী লীগের সংকট ও ভারতের অবস্থান
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর তিন মাসের ব্যবধানে তাকেও হত্যা করা হয়। পরে তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন, কিন্তু দলটি ক্রমশ হাসিনাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।
আলোচিত ঘটনার পরও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সোহেল তাজ কোনো কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে, ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তিনি আওয়ামী লীগের পতনের জন্য ১৯৮১ সাল থেকে দল পরিচালনা করা হাসিনাকে দায়ী করেন।
ভারতের কৌশলগত ভুল
ভারত সবসময় হাসিনাকে সমর্থন করে এসেছে। কিছুদিন আগেও, একটি ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনাকে তার বিরোধীদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে শোনা যায়। তারপরও ভারত তার প্রতি অবিচল সমর্থন ধরে রেখেছে।
তবে ভারতকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ এখন নতুন বাস্তবতার দিকে যাচ্ছে। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে হাসিনার শাসনে নিজেদের মৌলিক অধিকার হারাতে দেখেছে। তাদের কাছে ভারতের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতের উচিত তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তববাদী হওয়া এবং শেখ হাসিনার পরিবর্তে নতুন অংশীদার খোঁজা।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশ একটি কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানের কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। চীন বাংলাদেশের নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও, ভারত এখনো পুরনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
ভারতের উচিত বাস্তববাদী হওয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব বোঝা। না হলে, তারা দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশকে হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে কৌশলগত দরকষাকষির অনন্য সুযোগ পেয়েছে।
মন্তব্য করুন