থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বিখ্যাত লুম্বিনী (লুম্ফিনি) পার্কে এলাম সকাল এগারটায়। সেটি ছিল ২০২৩ এর ২৯ জুন। বৃহৎ সব বৃক্ষে ছায়াময় পার্কে প্রজাপতির উড্ডীন বর্নময়তা। বর্ণাঢ্য উদ্যানে হাঁটছে সবুজ ময়ূরী, কৃত্রিম পরিখায় রঙিন মাছ। সু্ন্দর ফুল, বৃক্ষলতা, স্নিগ্ধ লেক মিলে অপরূপ এক পরিবেশে বেড়াতে থাকি। এই অদ্ভুত সময়ে পার্কে এসে অবশ্য একটা লাভ হলো-পার্কের প্রায় জনতাহীন এক ধরনের নির্জনতা। এমন পরিবেশে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সমস্যা ও আরাকান আর্মির মতো বিষণ্ন বিষয় নিয়ে ভাবা এক অর্থে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। তবুও ভাবনায় তা এলো।
এবার সপরিবারে থাইল্যান্ডে বেড়ানোর সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ও অর্ধ একাডেমিক মিশনও অবশ্য ছিল। মিয়ানমার বিষয়ক ইস্যুগুলো মোকাবেলায় থাইল্যান্ড কি কি পলিসি ও কৌশল নিয়ে থাকে এবং তা বাস্তবায়ন করে থাকে-সে বিষয়টি বোঝা ও কিছু তথ্য সংগ্রহ করা। লুম্বিনী পার্ক ও অন্যান্য স্থানে এসে ভ্রমণের সঙ্গে সেই মিশনটাও বেশ কিছু মিলে গেল। কেন যেন অপরূপ থাইল্যান্ডে আমার ভ্রমণ জুড়ে ছিল নীরব মিয়ানমার ভাবনা।
থাইল্যান্ডের বার্মা বিষয়ক পলিসি, কৌশল ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে- এই ধারণাটা আমি প্রথম পেয়েছিলাম তৎকালীন লে. কর্ণেল মো. তোফায়েল আহমেদ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) এর থেকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অসাধারণ মেধাবী ও প্রফেশনাল কর্মকর্তা ব্যাংককস্থ ‘রয়েল থাই আর্মি কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজে’ প্রথম বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন (১৯৯৯-২০০০)। সেই কোর্সে জেনারেল তোফায়েল অনন্য মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন।
ব্যাংককে বিরল এক সম্মেলন
এর প্রায় ১৭ মাস পরের ঘটনা। ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪। ততোদিনে মিয়ানমারের পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষত রাখাইনে দিক বদলকারী বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০% এলাকা দখলের দাবী করছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পুরো অঞ্চলই আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। রাখাইনে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি এখন বাংলাদেশ। অন্যদিকে, কোন কোন স্থানে কয়েকটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করছে। আবারও কি ইতিহাসের বিপক্ষে হাঁটলেন রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ?
মিয়ানমারের চরম অশান্ত পরিস্থিতি এবং সীমান্ত প্রতিবেশী দেশগুলোর করনীয় ঠিক করতে মিয়ানমারের আশেপাশের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক গত ১৯ ডিসেম্বর ব্যাংককে বসেছিল। এর উদ্যোক্তা ছিল থাই সরকার। মূলত মিয়ানমারের বর্তমান আইন শৃংখলা পরিস্থিতি, সীমান্ত পরিস্থিতি এবং দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে মিয়ানমারের প্রতিবেশী চীন, বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এবং লাওসকে নিয়ে ওই সভায় আয়োজন করে থাইল্যান্ড। ২০ ডিসেম্বর আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আবার মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। সেই অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সভায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।
ধীরে বহে নাফ
ব্যাংকক সম্মেলনের বিশেষ স্টোরিটি ‘ফ্রনটিয়ার মিয়ানমার’ অফিসে পাঠিয়ে ল্যাপটপ অফ করলেন তরুন নিউজ-ক্রেজি আমেরিকান সাংবাদিক। চাও ফ্রায়া নদীর পাশেই হোটেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন নির্ঘুম মহানগরীর মধ্য রাতের নদীর দিকে...। ব্যাংককের প্রায় ১২০০ কিলোমিটার পশ্চিমে কক্সবাজারের (টেকনাফ) অঞ্চলের নাফ নদীতে তখন অন্য পরিস্থিতি। গভীর রাতে ও পারের রাখাইনের (মংডু) অঞ্চল থেকে নৌকা যোগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে হতভাগ্য শত শত রোহিঙ্গা। নাফ নদীর এপারে রোহিঙ্গা ঢল থামাতে দিন রাত ডিউটি করছে টেকনাফস্থ সীমান্ত রক্ষী বিজিবি ব্যাটালিয়ন ও কোস্ট গার্ডের সৈনিকরা। এই সীমান্ত রক্ষীদের চ্যালেঞ্চের কথা আমি কিছুটা বুঝতে পারি। প্রায় ১৭ বছর আগে আমিও এ অঞ্চলে সীমান্ত রক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলাম।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা সংকটের এক জটিল মোড়ে দাঁড়িয়ে। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের (বর্ষা বিপ্লব) পর, আগষ্টে ক্ষমতা গ্রহণ করে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থণ নিয়ে বিশেষ প্রচেষ্টা নিয়েছে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার। রাখাইনের নতুন পরিস্থিতি উদ্ভব হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘কৌশলগত হাই গ্রাউন্ড দখলই হতে পারে বাংলাদেশের মূল চাবিকাঠি।’
গত ২ মাসে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ (৪র্থ রোহিঙ্গা ঢল) করার ঘটনাটি মারাত্মক উদ্বেগ তৈরী করেছে। দক্ষিণ পূর্ব দিকে প্রতিবেশী পাল্টে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমাদের আগাম প্রস্তূতি ও সতর্কতা জরুরী। আশ্চর্য বিষয় হলো, এত বড় একটি ঘটনা কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তেমন আলোচিত হচ্ছে না। ‘নিস্ক্রিয়তা’ ও ‘হতবিহ্বলতা’ নয়, ঢাকাকে এখন দ্রুত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ (কন্সট্রাকটিভ এনগেজমেন্ট) স্থাপন করতে হবে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অর্থনৈতিক অধিকারসহ পুনর্বাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরীতে অবদান রাখতে হবে। রাখাইনের দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য (মানবিক করিডোর) পাঠানো যেতে পারে। সংকটের সঙ্গে এখানে সম্ভাবনাও রয়েছে। তা ঢাকাকে সাহসীভাবে দ্রুত কাজে লাগাতে হবে। আমরা যেন এবার আরাকান ট্রেন মিস না করি।
উল ইয়ন-সাংবাদিকতা থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ
আবার ফিরি ব্যাংককের লুম্বিনী পার্কে...। স্নায়ু-যুদ্ধের সময়কালে বিশেষত ১৯৫০-৬০ দশকে, থাইল্যান্ড ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ। অন্যদিকে, বার্মা সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই সময়কালে, সীমান্ত এলাকার বার্মিজ জাতিগত গেরিলা সংগঠন ও রেঙ্গুন সরকার-বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করে ও তাদের ‘বাফারে’ পরিনত করে থাই সরকার। লুম্বিনী পার্ক এই ধরণের ঘটনার নীরব স্বাক্ষী। এতে বার্মার বিষয়ে ঐ সময়ের থাই-নীতি বোঝার বিষয়টি সহজ হবে।
এক পর্যায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিখ্যাত লুম্বিনী লেকের ধারে বসি। ১৯৬৮-১৯৭০ সালে এর কাছাকাছি একটি বাড়ি বার্মিজ প্রতিরোধের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। মনে হলো, পার্কের পূর্ব দিকের সেই বাড়িটি আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। এর পেছনে ছিল সিআইএ ও থাই গোয়েন্দা বাহিনী। বিখ্যাত বার্মিজ ইতিহাসবিদ ও লেখক থান্ট মিন্ট ইউ-এর লেখা ‘দি রিভার্স অব লস্ট ফুট ষ্টেপস- ‘এ পারসনাল হিস্ট্রি অব বার্মা’-বইতে এর কিছু বিবরণ রয়েছে। তরুন থান্ট মিন্ট ইউ কম্বোডিয়ার (আনটাক) শান্তি মিশনে (১৯৯২-১৯৯৩) নমপেনে আমার একধরণের দূরবর্তী-সহকর্মী ছিলেন। তিনি আনটাকের মানবাধিকার বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থে (হিডেন হিস্টি অব বার্মা) থান্ট মিন্ট ইউ ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার’ (২০১৭) কথা প্রায় নির্মোহভাবে তুলে ধরেছেন। দুঃখজনকভাবে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মতো এই বার্মিজ লেখককেও পরে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
বার্মায় সামরিক বাহিনী ক্ষমতা (১৯৬২) দখলের পর তৎকালীন বিখ্যাত বার্মিজ সাংবাদিক-সম্পাদক (দি নেশান) ‘এডওয়ার্ড উল ইয়ন’ থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেন। লুম্বিনী পার্কের পাশের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন এই ‘ম্যাগসেসে’ অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সাহসী সম্পাদক। এটি তখন জেনারেল নে উইন-সরকার বিরোধীদের অলিখিত ‘হেডকোয়ার্টারে’ পরিনত হয়। এই সময় আমাদের বিখ্যাত সাংবাদিক এস এম আলী (সৈয়দ মাহমুদ আলী) ‘ব্যাংকক পোষ্টের’ ম্যানেজিং এডিটর (১৯৬৬-১৯৭০) ছিলেন। প্রায় এই সময়ই ব্যাংককে এসেছিলেন আমাদের প্রথম নারী ভাস্কর ‘নভেরা আহমেদ’। নিজের কাল ও সময়ের চেয়ে প্রাগ্রসর এই বাঙালি নারী, তার বন্ধু (ফরাসী যুদ্ধ-ফটোগ্রাফার) পোলানস্কির সঙ্গে ভিয়েতনাম রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন। নভেরা ১৯৫৮ সালে রেঙ্গুন যান। আইনজীবি-রাজনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ তখন বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। রেঙ্গুনে সেই সময় নভেরার একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। নভেরা আহমেদ রেঙ্গুনের কূটনৈতিক সার্কেলে অনেককে ইমপ্রেস করেছিলেন।
‘মিশন ব্যাংকক’ ও অতপর...
বিখ্যাত বার্মিজ রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক ‘উ নু’ ছিলেন বার্মার প্রথম (১৯৪৮) প্রধানমন্ত্রী। উ নু’কে ক্ষমতাচ্যুত করেই বার্মায় সামরিক শাসন এসেছিল। বার্মায় পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)। এই বাঙালি রাজনীতিক পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এর পরই কামরুদ্দীন আহমদ বার্মার রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন (১৯৫৭-১৯৬১) । এই দুজন বাঙালি রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী উ নু’র প্রায় ব্যক্তিগত বন্ধুতে পরিনত হয়েছিলেন। বিদায়ী সাক্ষাৎকারে (১৯৬১) উ নু’র রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দীন আহমেদকে বলেছিলেন- ‘পাকিস্তানে কি বার্মায় সেনাবাহিনী কোনদ্নি ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না’। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী উ নু ১৯৬৯ সালে (ভারত-বৃটেন হয়ে) থাইল্যান্ড আসেন। সাংবাদিক উল ইয়ন এর বাড়িটি কেন্দ্র করে উ নু, প্রেসিডেন্ট নে উইন এর সরকার-বিরোধি কর্মকান্ড শুরু করেন। সম্পাদক উল ইয়ন হয়ে পড়েন উ নু’র প্রধান উপদেষ্টা ও উৎসাহদাতা।
১৯৬৪ সালে এস এম আলী, হংকং এ করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি। রীতিমতো ‘ষ্টার’ সাংবাদিক। সেই সময় চীনা নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য ছিল বিরল সৌভাগ্য। মার্শাল চেন ই তখন চীনের জেষ্ঠ্য নেতাদের অন্যতম। চীনের বিপ্লবে মার্শাল চেন ই এর চরম সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। একবার এস এম আলী, মার্শাল চেন ই এর সাক্ষাৎকার মর্যাদাপূর্ণ পত্রিকা ‘ফার ইষ্ট্রার্ন ইকোনোমিক রিভিউ’ এ ছাপিয়ে ব্যাপক কৌতুহল সৃষ্টি করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিক-গবেষকের চমৎকার একটি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের ৩ জন সাংবাদিক-গবেষক জুমে আরাকান আর্মির প্রধান মেজর জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়িঙ (কাচিন স্টেটে অবস্থানকারী) এর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা হলেন: শফিকুল আলম (বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব), আলতাফ পারভেজ ও আশফাক রনি। সাক্ষাৎকারটি ২ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় প্রকাশিত হয়।
উ নু-উল ইয়নদের উদ্দেশ্য ছিল থাইল্যান্ড একটি প্রতিরোধ ঘাঁটি তৈরী করা। যেখান থেকে মার্কিন ও পশ্চিমা দেশের সাহায্য নিয়ে বার্মার অভ্যন্তরে সরকার বিরোধি বিদ্রোহ সংঘটিত করা। ততোদিনে, বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বার্মিজ প্রেসিডেন্ট নে উইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। ব্যাংককে তখন একত্রিত হয়েছিলেন ১৯৫০-দশকের অনেক নেতৃস্থানীয় বার্মিজ রাজনৈতিক-সামরিক ব্যক্তিত্ব। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বার্মার প্রথম প্রেসিডেন্ট সাও শোয়ে থাইক (শান প্রধান) এর স্ত্রী বিখ্যাত ‘মহাদেবী অব ইয়ানঘি’। একসময়ের আলোচিত রাজনীতিবিদ ‘মহাদেবী’ (মহারানী) তখন ‘শান স্টেট আর্মি’র প্রধান’।
এয়ার রেইড ওভার রেঙ্গুন ও লিফলেট বিতরণ!
থাই গোয়েন্দা বাহিনী নির্বাসিত বার্মিজ গ্রুপগুলোকে সংগঠিত করেছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ধরণের সাহায্য আসেনি। উ নু সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা বিল ইয়াংকে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তখন উ নু ‘পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেটিক পার্টি’ (পিডিপি) গঠন করেন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। তবে প্রতিরোধ গোষ্ঠির মধ্যে মাত্র কয়েকশো বা সর্বোচ্চ কয়েক হাজারের বেশী সৈন্য ছিল না।
শুধুমাত্র একটি কানাডিও তেল কোম্পানী কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। একটি বিমান রেঙ্গুন পর্যন্ত (এয়ার রেইড ওভার রেঙ্গুন) উড়ে গিয়েছিল। বোমার বদলে ফেলেছিল কয়েক হাজার লিফলেট! নবগঠিত গেরিলা বাহিনী মাত্র কয়েক মাইল ভেতরে যেতে পেরেছিল। থাই সীমান্ত থেকে নে উইন সরকারকে যুদ্ধ করে উৎখাতের করার জন্য তার ঘোষণা চরম ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছিল।
এ ডটার্স মেমোয়ার অব বার্মা
এই লুম্বিনী পার্কে এক সময় হাঁটতেন বার্মার প্রতিরোধ গোষ্ঠির নেতৃবৃন্দ। তারা আজ কোথায়? সাংবাদিক উল ইয়ন এর মেয়ে ‘ওয়েনডি উল ইয়ন’ পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখক হিসেবে পরিচিত পান। ওয়েনডি উল ইয়ন এর মেয়ে ‘জোসিলিন সিগ্রেড’ একজন হলিউড-অভিনেত্রী। উল ইয়ন ১৯৮০ সালে (আমেরিকার) মেরিল্যান্ডের সিলভার স্প্রিং এ মৃত্যু বরণ করেন। ওয়েনডি উল ইয়ন তার গ্রন্থে (এ ডটার্স মেমোয়ার অব বার্মা) পিতা উল ইয়নের বার্মার গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম ও থাইল্যান্ডে বার্মার প্রতিরোধ গোষ্টির কার্যকলাপের কথা সবিস্তারে লিখেছেন। উ নু ও উল ইয়ন এর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তারাই অবশ্য প্রথম (১৯৬৯-৭০) বার্মার প্রায় সকল বিরোধি গোষ্ঠি/দলকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে এই কাজটি অবশ্য করেছিলেন অং সান সুচি।
লুম্বিনী পার্কে অন্য ধরণের কুমির!
এক সময় আমি অপরূপ লুম্বিনী লেকের পাশে এসে বসি। লুম্বিনী পার্কের অসাধারন সৌন্দর্য্যের মাঝেও একমাত্র অস্বস্তি ছিল লেকে ভেসে বেড়ানো বিশাল আকারের (ওয়াটার মনিটর লিজার্ড) ‘গিরগিটি’। প্রথমে আমি ওদের ‘কুমীর’ ভেবে ভুল করেছিলাম। হঠাৎ করে মিয়ানমারের অন্য ধরণের ‘কুমিরের’ কথা মনে এলো। কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) এ চাকুরী ও পরবর্তীতে রোহিঙ্গা-মিয়ানমার বিষয়ক গবেষণা-লেখালেখির কাজে বেশ কিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এই হতভাগ্য অত্যাচারিত একদল রোহিঙ্গা নিষ্ঠুর মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ‘কুমিরের’ সঙ্গে তুলনা করেছিল।
১৯৮০ দশকে ব্যাংককে বাংলাদেশীদের মিলন মেলা
১৯৮০ দশকে ব্যাংকক একঝাঁক মেধাবী বাংলাদেশীর মিলন মেলায় পরিনত হয়। মেধাবী কূটনীতিক শাহ্ এএমএস কিবরিয়া জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশন (এসকাপ) এর ‘নির্বাহী সচিব’ (১৯৮১-১৯৯২) হিসেবে ব্যাংককে কর্মরত ছিলেন। এটি ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পদ (জাতিসংঘের উপমহাসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন)। এসকাপ সচিবালয়ে সেই সময়ে ড. রহমতুল্লাহ, এএসএইচকে সাদেক (পরে সচিব, মন্ত্রী), এনাম আহমেদ চৌধুরীসহ (সচিব) অনেক উচ্চ পদস্থ বাংলাদেশী কর্মরত ছিলেন। হেদায়েত আহমেদ ছিলেন ইউনেস্কোর আঞ্চলিক পরিচালক। ফাও এর আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ওবায়েদুল্লাহ খান (কবি, সচিব, মন্ত্রী)।
ইউনেস্কোতে প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন মাহফুজ আনাম (সম্পাদক, ডেইলী স্টার)। এই সময় ‘পূরবী সাংস্কৃতি চক্র’ নামে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। চিত্র শিল্পী আসমা কিবরিয়া (শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সহধর্মিনী) ছিলেন ‘পূরবী সাংস্কৃতি চক্র’ এর সভাপতি ও প্রধান চালিকা শক্তি। সাংবাদিক এস এম আলী তখন কুয়ালালামপুরস্থ ইউনেস্কোর প্রধান আঞ্চলিক প্রচার কর্মকর্তা (রিজিওনাল কমিউনিকেশন এডভাইজার)।
১৯৮০-১৯৯০ দশকে থাইল্যান্ডে ৩ জন খ্যাতিমান ও পেশাদার সেনাকর্মকর্তা/জেনারেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা হলেনঃ মেজর জেনারেল কাজী গোলাম দস্তগীর (১৯৭৮-১৯৮২), মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম (১৯৮৯-১৯৯৩) ও মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ (১৯৯৩-১৯৯৫)।
ব্যাংকক এশিয়ার অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ফাও, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ ইত্যাদি সংস্থাও তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর ব্যাংককে স্থাপন করে। ব্যাংককের সকল বাঙালি পরিবার নিয়ে সেখানে তারা সক্রিয় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরী করেছিলেন।
ব্যাংককে কম্বোডিয়া শান্তি মিশনের অফিস
কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিমিশন ‘আনটাক’ (১৯৯২-১৯৯৩) চালু হলে, ব্যাংককে এর ‘চিফ লিয়াজোঁ অফিসার’ এর কার্যালয় স্থাপিত হয় ‘এসকাপ’ এর ১৫ তলা সচিবালয়ের বিল্ডিং এ (রাজডামনার্ন নক এভিনিউ, ব্যাংকক)। গুরুত্বপূর্ণ এই ‘চিফ লিয়াঁজো অফিসার’ পদে প্রথমে নিয়োজিত ছিলেন কর্ণেল ইকরামুল হক (পরে মেজর জেনারেল)। ১৯৯৩ এর মার্চে তার স্থালাভিষিক্ত হন কর্ণেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (পরে মেজর জেনারেল)। উল্লেখ্য, মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান বর্তমানে ‘বিআইপিএসএস’ নামক থিংক ট্যাংকের সভাপতি ও ‘গ্লোবাল মিলিটারি এডভাইসোরি কাউন্সিল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ এর চেয়ারম্যান। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে তিনি দেশে বিদেশে অত্যান্ত পরিচিতি ব্যক্তিত্ব।
২০২১- পরবর্তী মিয়ানমার
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী (তাতমাদো) বর্তমানে দুই ধরণের গৃহযুদ্ধে লড়ছে। একদিকে তাদের প্রতিপক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর বিভিন্ন সশস্ত্র গেরিলা দল (ইএও)। এরা মূলত স্বায়ত্তশাসন চায়। অন্যদিকে তাতমাদোর বিরুদ্ধে লড়ছে গণতন্ত্রপন্থী মানুষেরা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মূলত আং সান সূচীর ক্ষমতাচ্যুত ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসী’ (এনএলডি) পার্টির সংসদ সদস্যদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ বা ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট’ (এনইউজি) গড়ে উঠেছে। এই সরকার ২০২১ এর এপ্রিলে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) গঠন করেছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ শুরু করেছে। নব গঠিত পিডিএফকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বার্মার কয়েকটি জাতিগত গেরিলা গোষ্ঠি। আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।
এনইউজি সরকার অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা না করলেও বর্তমানে (জুন, ২০২৩) থাইল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে কাজ করছে। মূলত এনএলডি পার্টির সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হলেও এনইউজিতে জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গোষ্ঠি এবং রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র দলগুলোর প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ‘অং কাও মো’ এনইউজি সরকারের মানবাধিকার বিষয়ক ‘উপমন্ত্রী’ (ডেপুটি মিনিস্টার) হিসেবে কাজ করছেন। জাতিগত গেরিলা গোষ্ঠিগুলো (বিশেষত রাখাইন চিন, কাচিন, কারেন ও শানে) মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য, সফলতা লাভ করেছে। থাইল্যান্ডে এনইউজির খুব ভালো সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। যতদূর জানা যায়, থাইল্যান্ডে আরাকান আর্মিরও ভালো নেটওয়ার্ক রয়েছে।
অর্থনীতি যখন রাজনীতি থেকে দূরে-থাইল্যান্ডের বাস্তবমুখী বার্মা-পলিসি
বার্মার সঙ্গে থাইল্যান্ডের এক ধরণের ‘জটিল’ সম্পর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এক সময়ের ‘শত্রুদেশ’ মিয়ানমার কিন্তু এখন থাইল্যান্ডের সীমান্ত বাণিজ্য, মাইগ্রেন্ট লেবার ও প্রাকৃতিক গ্যাসের চমৎকার উৎস দেশ। দুই দেশের সামরিক বাহিনী ও ব্যবসায়ীদের (অলিগার্ক) মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেই এখন রয়েছে সামরিক সরকার বা সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার (জুন, ২০২৩)। মিয়ানমারে থাইল্যান্ডের বেশ লাভজনক বিনিয়োগ (তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগ) রয়েছে। বিশেষত জ্বালানী সেক্টরে থাই বিনিয়োগ সর্বোচ্চ। থাইল্যান্ডে এই ‘বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ অর্থাৎ মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে আঞ্চলিক সংযোগ ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় দেশটির চমৎকার কৌশল বলে বিবেচিত।
২০০১ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলে থাইল্যান্ড ‘মৃদু সমালোচনা’ করে ও সামরিক সরকারের সঙ্গে পূর্বের সম্পর্ক (বিজনেস এজ ইউজুয়্যাল) বজায় রাখে। থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তি/দল মনে করে যে, সেনাবাহিনীই মিয়ানমারে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনতে পারে। থাই সেনাবাহিনী ও ট্রাডিশনাল রাজনীতিকরা, মিয়ানমারের সরকার ছাড়া সেখানকার কোন বিদ্রোহি গোষ্ঠির সঙ্গে আলোচনায় যেতে চায়না। তবে এথনিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো রনাঙ্গণে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করলে এ ধারনা অবশ্য বদলে যেতে পারে।
তবে থাইল্যান্ড জান্তা সরকারের সঙ্গে খুব বেশি এনগেজমেন্ট বৃদ্ধি করেনি। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ব্যাংকক মূলত এক ধরণের ‘সতর্ক’ অবস্থান বজায় রেখেছে, যেন তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান থাকতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক সমালোচনাও যেন না হয়।
থাইল্যান্ডে মানবিক কূটনীতি
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও সরকারের নির্যাতনের কারণে বর্তমানে প্রায় লক্ষাধিক মিয়ানমার নাগরিক থাইল্যান্ডের ৯টি ক্যাম্পে ‘উদ্ধাস্তু’ হিসেবে দীর্ঘদিন (মূলত ১৯৮৪ সাল থেকে) ধরে বসবাস করছে। চিয়াং মাই ও তাক প্রদেশে এই ক্যাম্পগুলো অবস্থিত (থাইল্যান্ডের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে)। এই শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য থাই সরকার ‘মানবিক কূটনীতি’ অবলম্বন করেছেন। শরণার্থীদের জন্য খাদ্য বাসস্থান এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। বার্মার শান (তাই) সম্প্রদায়ের সঙ্গে থাইল্যান্ডের মূল তাই/থাই জনগোষ্ঠির সম্প্রীতিমূলক সম্পর্ক রয়েছে। ভালো কাজের সুযোগ থাকায়, বর্তমানে প্রায় ১৮ লক্ষ বার্মিজ নাগরিক (শ্রমিক) থাইল্যান্ডে কাজ করছে। বাস্তববাদী থাইল্যান্ড সরকার, অর্থনীতির বিষয়টি ‘রাজনীতি-সামরিক’ বিষয়টি থেকে আলাদা করে দেখে।
মিয়ানমার বিষয়ে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতি-ভিশনারী নেতৃত্বের প্রতিফলন
স্নায়ু-যুদ্ধের সময়কালে (বিশেষত ১৯৫০-৬০ দশক) থাই সরকার মিয়ানমারের কয়েকটি অ-কম্যুনিষ্ট গেরিলা দলকে সাহায্য করতো। এটি ছিল সেই সময়ের থাইল্যান্ডের ‘বাফার’ নীতির প্রতিফলন। মিয়ানমারের শান প্রদেশে মার্কিন মদদপুষ্ট অকম্যুনিস্ট গেরিলা দল (মূলত চীনের কুওমিনটাং বাহিনী) শান প্রদেশের কম্যুনিস্ট গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো।
১৯৭০ এর পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী প্রেম তিনসুলানন্দ ১৯৮০ এর প্রথম দিকে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতির দীর্ঘ দিনের ‘বাফার পলিসির’ পরিবর্তন করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে থাই সরকার মিয়ানমারের আভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী তাতিচাই চুনহাভেন এর সময়ে ‘টার্ন দি ব্যাটেল ফিল্ড টু মার্কেট প্লেস’ নীতি গ্রহণ করা হয়। এতে মিয়ানমারসহ ইন্দোচীনের দেশগুলোর সঙ্গে থাইল্যান্ডের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও দুই দেশের অধিকাংশ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় সম্পর্কে উষ্ণতা রয়েছে। থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ তাদের দূরদর্শিতা ও গতিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
তবে ১৮শ শতাব্দিতে, থাইল্যান্ড ও বার্মার মধ্যে কোন কোন সময় তীব্র উত্তেজনাকর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। বার্মিজ বাহিনী বেশ কয়েকবার থাইল্যান্ড আক্রমণ করেছে। ১৭৬৭ সালে বার্মিজ বাহিনী, থাইল্যান্ড আক্রমন করে রাজধানী আয়াথুয়া শহরকে বিধ্বস্ত করে। সেই সময় থেকে মিয়ানমারকে একটি ‘বৈরী’ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমানে থাই জনগণ পূর্বের শত্রুতাপূর্ণ অতীতকে তেমনভাবে আলোচনায় আনে না। বাস্তববাদী থাই জনগণ বর্তমানকে গুরুত্ব দেয়।
মিয়ানমারের সংকটে থাইল্যান্ডের অনন্য অবস্থান।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের অবস্থান একেবারেই অনন্য। ব্যাংকক মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিক ও কূটনীতিক ক্ষেত্রে সমর্থন করে থাকে। যা জান্তা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অন্যদিকে, ব্যাংককের মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনের উপরেও প্রভাব আছে। তবে এই গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে থাইল্যান্ড (চীনের মতো) গভীরভাবে জড়িত নয়।
থাইল্যান্ড হলো মিয়ানমারের বিপ্লবী গোষ্ঠির লাইফলাইন। এ ক্ষেত্রে লেখক হেট হ্লাং উইন লিখেছেন-Thailand is not aiding the Junta-it also serves as a life line of Mynmar's people and anti- junta resistant movement. ২০২১ এর পর অনেক মিয়ানমার নাগরিক থাইল্যান্ডে তাদের সম্পদ স্থানান্তর করেছেন। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান এড়াতে হাজার হাজার তরুন থাইল্যান্ডে পালিয়েছে। অনেক মিয়ানমার রাজনীতিক, এক্টটিভিস্ট, বুদ্ধিজীবি থাইল্যান্ডে অবস্থান করে কর্মকান্ড চালান। অনেক থিংক ট্যাঙ্ক, মিডিয়া আউটলেট ও এনজিও থাইল্যান্ডে অবস্থিত।
মিয়ানমারের কয়েকটি জাতিগত গেরিলা সংগঠন তাদের অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ ও লজিস্টিক বিষয়ে থাইল্যান্ডের উপর নির্ভর করে থাকে। যা বহুল আলোচিত। বিভিন্ন বিদ্রোহী সংগঠনের মধ্যে ও বিদ্রোহী সংগঠন ও মিয়ানমারের সরকারের মধ্যে আলোচনার (মিটিং) নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে থাইল্যান্ড ব্যবহৃত হয়। এসব কারণে মিয়ানমার সংকটে থাইল্যান্ডের অবস্থান অনন্য ও দেশটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় (কি প্লেয়ার)। আশ্চর্যজনকভাবে এ বিষয়টি তেমন আলোচিত হয় না, যেমনটা চীনের বিষয়ে হয়।
থাইল্যান্ড মিয়ানমারের আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক সমস্যাগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে বরং একধরণের ‘নিরপেক্ষ অবস্থান’ নিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধাণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
গোল্ডেন ট্রাঙ্গেল এর কাছে-শান্তির ফুল (পপি) নিয়ে যত অশান্তি
গোল্ডেন ট্রাঙ্গেল বা সোনালি ত্রিভূজ (বার্মা-লাওস-থাইল্যান্ড এর সীমান্তবর্তী) এলাকা হলো ড্রাগ ও অস্ত্র ব্যবসায়িদের স্বর্গ রাজ্য। এই সব অঞ্চলে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ওয়ার লর্ড, জেনারেল, ড্রাগ-লর্ডদের অনেক চাঞ্চল্যকর কাহিনী প্রচলিত আছে। মিয়ানমারের শান রাজ্য (গোল্ডেন ট্রাঙ্গেলের অংশ) হলো যুদ্ধবাজ নেতা, চোরাচালনাকারী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। শান রাজ্যের পাহাড়ী ঢালে চাষ হয় পপি, যার আঞ্চলিক নাম পিস ফ্লাওয়ার বা শান্তির ফুল। এই শান্তির ফুল নিয়েই যতো অশান্তি। এই পপি ফুল থেকেই প্রস্তূত হয় হেরোইন। এছাড়াও শান রাজ্যে গড়ে উঠেছে শত শত ইয়াবা ও আইস কারখানা। শান রাজ্যের বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনগুলো ব্যাপকভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত। বাংলাদেশে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালানও আসে এই শান রাজ্য থেকে। শান সীমান্ত সামাল দেওয়াই এখন থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যাথা।
সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা
মিয়ানমারের সঙ্গে থাইল্যান্ডের দীর্ঘ সীমান্তে (২৪ কি. মি.) শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে থাই সরকার। থাই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম- ‘বর্ডার পেট্রল পুলিশ’। সাধারণত অশান্ত সীমান্ত অঞ্চল, যেখানে ইনসারজেন্সী বা বিদ্রোহ চলে, সেখানে (বর্তমানে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে) ‘থাহান পারান (রেঞ্জার)’ নামে প্যারা মিলিটারি ফোর্স মোতায়েন করা হয়। এই বাহিনী সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করে থাকে। বর্তমানে সীমান্তে চোরাচালান ও মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করছে থাই কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ভ্রমন-লেখক মইনুস সুলতান ‘গোল্ডেন ট্রাঙ্গেল’ এলাকা ভ্রমণের কথা তার গ্রন্থ ‘সুকথাই চিয়াংমাই থাইল্যান্ড ঘুরে বেড়ানো’ গ্রন্থে চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন। থাইল্যান্ডের উত্তর সীমান্ত (বার্মা-লাওস) দেখভালের জন্য (চোরাচালান বিরোধী দায়িত্ব) দায়িত্বপ্রাপ্ত হলো, ফা মুয়াং টাস্কফোর্স। অন্যদিকে, নারসুয়ান টাস্কফোর্স এর দায়িত্ব দক্ষিণের বার্মা সীমান্ত। তবে দুটি টাস্কফোর্সই থাই সেনাবাহিনীর ‘৩য় আর্মি রিজিওনের’ অধীনে কাজ করে। সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলা হয়, সীমান্ত বিষয়ে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
আলোচিত ‘বার্মা অ্যাক্ট’ ও অতপর...
এবার থাইল্যান্ডে এসে পরিচিত ব্যক্তি-বন্ধুদের (একাডেমিয়া-মিডিয়া-উদ্যোক্তা) মিথষ্ক্রিয়ায় ‘বার্মা’ পরিস্থিতি জানার চেষ্টা ছিল। আগ্রহের একটা বিষয় ছিল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্টের’ বাস্তব প্রতিফলন জানা। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বিল পাশ হয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিষয়ে আরো সরাসরি যুক্ত হয়ে গেলো। এই বিলে আছে যে, মিয়ানমারের ভিতরে গণতন্ত্রের সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেবে। বিল পাশের পর গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো বিশেষত ‘এনইউজি’ দারুন উজ্জীবিত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের চার্চগুলো এই বিল পাশের জন্য লাগাতার তদবির করে যাচ্ছিল। এই সময়ে মিয়ানমারের ভিতর যে ৩টি অঞ্চলে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা বেশী ছিল সেগুলো হলোঃ কাচিন, চিন ও কারেন অঞ্চল। এই অঞ্চলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খৃষ্টান জনগোষ্ঠি রয়েছে। ভূ-রাজনীতির মূল আলো পড়বে হয়তো ঔই ৩ টি রাজ্যে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টা তাৎপর্যপূর্ণ। ‘বার্মা অ্যাক্টের’ পর বার্মার সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরো বাড়তি সহায়তা আশা করেছিল। তবে বার্মা অ্যাক্ট এর আওতায় এই দলগুলোকে ‘টেকনিক্যাল ও নন-লিথাল সহায়তা’ দেওয়ার কথা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ও সিভিক একটিভিজমে কিছুটা সাহায্য করছে। মানবিক সহায়তায় তারা আছে। এছাড়াও মানবাধিকার, ক্রাইম ডকুমেন্টেশন ও রাজনৈতিক-সংলাপে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশসমূহ সক্রিয় রয়েছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো যুদ্ধরত বিদ্রোহি গোষ্ঠিগুলোকে সিভিল সোসাইটি পরিচালনা, ক্রাইম ডকুমেন্টেশনে সহায়তা করছে। অন্যদিকে ভারতসহ এক নায়কতান্ত্রিক দেশগুলো (চীন, রাশিয়া) মিয়ানমার সরকারকে ‘যু্দ্ধ পরিচালনায়’ সাহায্য করছে। পশ্চিমা দেশসমূহ থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন বিশেষত অস্ত্র সরঞ্জামাদি না পাওয়ায় এনইউজিসহ মিয়ানমারের বিদ্রোহি গোষ্ঠিগুলো কিছুটা হতাশ।
বার্মায় যতো মার্কিন ও ওয়েস্টার্ন কানেকশন!
মিয়ানমারের পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষত কারেন, কাচিন, চিন ও কারেনি ও শান অঞ্চলে (মূলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে) রিলিফ সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারী-যুক্ত এনজিওগুলো তৎপর। থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে থাইল্যান্ড-বার্মা বর্ডার ‘কনসোটিয়াম’। এরা রিফিউজি ক্যাম্পে খাদ্য ও ঔষুধ সরবরাহ করে থাকে। রবার্ট ডি কাপলানের আলোচিত বই ‘মনসুন’ এ বর্ণিত হয়েছে কিভাবে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশের সাবেক কিছু সেনা সদস্য এই ধরণের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থেকে ইনটেলিজেন্সের (গোয়েন্দা) কাজও করে থাকেন। মিয়ানমারের দুর্গম যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলে মানবতা সেবায় অনেক মিশনারী (বিশেষত পশ্চিমা দেশের) নিয়োজিত রয়েছেন। মানবিক সহায়তা দানকারী এই সব এনজিও/সংস্থা নিয়ে কিছু বিতর্ক অবশ্য আছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি মিয়ানমার বিষয়ে ‘রনাঙ্গণ পর্যায়ে’ প্রকাশ্যে জড়িত হতে চায়-তাহলে তাকে থাইল্যান্ডের মাধ্যমেই করতে হবে। কিন্তু থাইল্যান্ড এভাবে নিজেকে জড়াতে চায় না। কারণ মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা সীমান্ত উপচে থাইল্যান্ডে এসে পড়বে। এছাড়াও থাইল্যান্ড মিয়ানমারের প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। তাই কোন বিদ্রোহী এথনিক গোষ্ঠিকে ব্যাপকভাবে অস্ত্র দিয়ে তারা মিয়ানমার জেনারেলদের ক্ষ্যাপাতে চায়না।
যতোদূর জানা যায়, থাইল্যান্ডের মাটি থেকে (সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করে) ন্যাশনাল ইউনিটি গভমেন্ট এবং কয়েকটি এথনিক গোষ্ঠি (সংখ্যায় অল্প) মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি হলো- থাই সরকারকে চাপ দেওয়া, যেন থাইল্যান্ড এ বিষয়টি উপক্ষা করে।
ব্যাংককে এই মর্মে, একটা আলোচনা শুনেছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের কয়েকটি গেরিলা সংগঠনকে (থাই সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ) গোপনে অস্ত্র পাঠিয়ে থাকে। তবে তা, মোটেই বড় আকারের নয়। যাইহোক, এ বিষয়টি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মিয়ানমারের ‘নিউজরুম’ যখন থাইল্যান্ডে
যুদ্ধ হচ্ছে মিয়ানমারের বিস্তৃীর্ণ রনাঙ্গণে। অথচ মিয়ানমার যুদ্ধের ‘সংবাদের ঘাঁটি’ হলো থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও চিয়াং মাই। ইরাওয়াদী (ইরাবতী), নারিনজারা, মিজ্জিমা ইত্যাদি সরকার বিরোধী পত্রিকা থাইল্যান্ড (চিয়াং মাই, ব্যাংকক) থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। চিয়াং মাই শহর থেকে একদল নির্বাসিত বার্মিজ সাংবাদিক ‘ইরাওয়ার্দী’ (ইরাবতি) পত্রিকা বের করেন। এখানেই থাকেন বিখ্যাত সুইডিস সাংবাদিক ‘বার্টিল লিন্টনার’, যিনি একজন সাংবাদিক ও কৌশলগত কনসালটেন্ট। এই দূধর্ষ ‘বার্মা বিশেষজ্ঞ’ উত্তর পূর্ব ভারত-বার্মা-থাইল্যান্ড অঞ্চলের উপর রির্পোটিং করে সাংবাদিকতা জগতে ‘লিজেন্ডে’ পরিনত হয়েছেন। তার অন্যতম বিখ্যাত বই হলো- ‘ল্যান্ড অব জেড-এ জার্নি ফ্রেম ইন্ডিয়া থ্রু নদার্ন বার্মা টু চায়না’। আশা করি, একদিন বাংলাদেশেও বার্টিল লিন্টার এর মতো সাংবাদিক আমরা দেখতে পাবো।
উল্লেখ্য, প্রায় ৪৭ বছর আগে ‘ব্যাংকক পোস্ট’ রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি স্মরণীয় নিউজ করেছিল। ১৯৭৮ সালে বার্মিজ বাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছিল। ঢাকায় প্রত্যাবাসন আলোচনার একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা বার্মার প্রতিনিধি দলকে বেশ কড়া কথা শুনিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ‘ব্যাংকক পোস্ট’ একটি নিবন্ধন ছেপেছিল। ‘বাংলাদেশ ওয়ার্নস বার্মা’ ‘বাংলাদেশ বার্মাকে সতর্ক করলো’ (১৭ মে ১৯৭৮)। উল্লেখ্য, সেই সময়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবেলায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক কৌশল ও দৃঢ়তা দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। সাপ্তাহিক ‘দি ইকোনমিস্ট’ ১২ আগষ্ট ১৯৭৮ প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করে ‘‘এক মাস আগে বার্মা ও বাংলাদেশ যে তাদের শরণার্থী সমস্যার একটি সুশৃঙ্খল ও তাৎক্ষণিক সমঝোতায় পৌঁছেছে, তা কি কোন অলৌকিক ঘটনা, নাকি মরীচিকা? ”
যখন ব্যাংককের গ্রান্ড প্যালেসে
আমরা এখন ব্যাংককের অপরূপ রাজপ্রাসাদ বা গ্রান্ড প্যালেসে। ৩০ জুনের দুপুর প্রায় বারোটার দিকে রাজকীয় চত্বরে পৌছেছি। রাজকীয় চত্বরটি যেমন বিপুল, তেমনি নানা প্রকারের ভবনসমূহের বর্নাঢ্যময় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমরা ফনা তোলা নাগের প্রতীক বিশিষ্ট ‘চৌদেওয়ার’ পার হয়ে মূল আঙ্গিনায় ঢুকি। এখানে অবশ্য রাজা থাকেন না। আমাদের চোখের সামনে চেদি ও বৌদ্ধ স্তূপসমূহের গোলাকার উর্ধ্বমুখী স্পাইরাল স্থাপত্য ও তার পাশাপাশি বহুতল ছাদ বিশিষ্ট ভবনরাজি এক ধরনের গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করে। এখানে এসে আমার নমপেনের অপরূপ রাজপ্রাসাদের কথা মনে পড়ে।
বিশাল রাজপ্রাসাদ কমপ্লেক্সে ঘুরতে ঘুরতে ‘চকরি মহাপ্রাসাৎ’ নামক বড় একটি অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়াই। প্রখর সূর্যালোকে প্রাসাদের স্বর্ণালী মন্ডপ আমাদের চোখে বর্নীল ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে। সিংহাসন রাখা দরবার হলের পাশ দিয়ে হেঁটে ছায়াচ্ছন্ন খোলা এক মন্ডপে বসে পড়ি। এখানে একটি স্টল থেকে চা কেনা হয়। এখানে দেখা হয় কয়েকজন বিদেশী পর্যটকের সঙ্গে। সবাইকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। এক পর্যায়ে, পরিচয় হয় একজন মধ্যবয়সী বার্মিজ নাগরিকের সঙ্গে, যিনি কুয়ালালামপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মনে করা যাক, অধ্যাপকের নাম-খিন মঙ।
বার্মিজরা (মঙ্গলয়েডদের মতো) সাধারনত নিজেদের দুঃখ কষ্ট বা মনের ভাব সহজে অন্যের কাছে প্রকাশ করেন না। অর্থাৎ বাঙালিদের বিপরিত! যাই হোক, কিছু পরে অবশ্য চশমা পরা এই অধ্যাপক দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কথা বলেন। তাঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাসে দৃশ্যমান হয় ছেড়ে আশা মাতৃভূমির জন্য বেদনা। খিন মঙ বলেন- ‘তার প্রিয় শহর রেঙ্গুন এর অর্থ- যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। অথচ ১৯৪৮ থেকেই সেই অঞ্চলে এক ধরণের যুদ্ধ চলছে। বার্মিজ ভাষায় নে ইউন অর্থ ‘উজ্জল আলো’। কিন্তু লোকটা মিয়ানমারকে অন্ধকারে নিয়ে গেলেন।’ মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ে বলেন- ‘‘এটা সত্যি তাতমাদোই মিয়ানমারকে ধরে রেখেছিল। আজ ওরাই দেশটাকে ধ্বংস করছে’’।
১৭৬৭ সালে, বার্মিজ বাহিনী তৎকালীন থাই রাজধানী ‘আয়ুধায়ায়’ (অযোধ্যা) আক্রমণ করেছিল। এতে নগরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। থাই-বার্মা সম্পর্ক প্রসঙ্গে, বার্মিজ বাহিনীর আক্রমণ ও ধ্বংসের কথা এই অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করি। তিনি কৌতুক করে বলেন- ‘‘ঐ আক্রমণ না হলে তো এই ব্যাংকক শহর ও এই রাজপ্রাসাদ হয়তো হতো না’’ জানতে চাইলাম, এনইউজি সরকার, পশ্চিমা সাহায্য, বার্মা অ্যাক্ট নিয়ে...। চশমা টেনে অধ্যাপক কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন- ‘‘চীনের তুলনায় এগুলো হলো- পেপার টাইগার বুঝলেন? শোনেন বার্মার মানুষকে নিয়ে কেউ ভাবেনা। সবার দৃষ্টি বার্মার সম্পদের দিকে”। একপর্যায়ে খিন মঙ বলেন- ‘‘আগামী বছর কিছু পরিবর্তন হয়তো দেখবেন’’!
জমিদার বাড়ি থেকে পলিথিনের ঝুঁপড়িতে-একজন রোহিঙ্গা সেনা কর্মকর্তার ভাগ্য
বিকেলে এসেছিলাম ব্যাংককের চাও ফ্রায়া নদীর ধারে গড়ে ওঠা অপরূপ পর্যটন এলাকা ‘এশিয়াটিক দ্যা রিভার ফ্রন্টে’। হাজার পর্যটকের ভিড়ে একসময় ব্যাংককে থাকা একজন হতভাগ্য রোহিঙ্গা সেনা কর্মকর্তা-‘জেনারেল ওমর হাকিম’ এর কথা মনে পড়লো। রাখাইনের মংডুতে জন্মগ্রহণকারী ওমর হাকিম বার্মা সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেছিলেন। পরে কর্তপক্ষের হয়ে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। তবে সেনাবাহিনীতে একপর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তিনি পালিয়ে থাইল্যান্ড চলে যান। সেখান থেকে মালয়েশিয়া। ২০০০ সালে গোপনে দেশে (মংডু) ফিরেছিলেন। ২০১৭ সালে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসেন। কুতু পালং ক্যাম্পে এখন তিনি পলিথিনের ঝুপড়িতে থাকেন। মংডুর জমিদারের ছেলে এখন বিপন্ন শরণার্থী। জীবন কি বিচিত্র! (এই তথ্যটা কক্সবাজারের সাংবাদিক-লেখক মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের বই- ‘রক্তাক্ত আরাকান বিপন্ন রোয়াইঙ্গা’ থেকে নেওয়া। সাবেক এই রোহিঙ্গা সেনা কর্মকর্তার সঠিক র্যাংক বা পদ যাচাই করা যায়নি)।
পাতায়া সমুদ্র সৈকতে চিয়াং মাই ‘লিসেনিং পোস্টের’ গল্প
২৬ জুন, ২০২৩। পাতায়া শহরে এখন সকাল। হোটেল থেকে বীচ রোড পেরিয়েই সমুদ্র। গালফ অব থাইল্যান্ড এর নীল জল। সৈকতে আমরা হাঁটতে থাকি। উঁড়ছে একদল সাদা সী গাল। কিছু দূরে সমুদ্রে একটা প্লাটফর্ম থেকে প্যারা সেলিং শুরু করেছে একদল টুরিস্ট। বীচ রোডের ধারে বসার ব্যবস্থা। ওখানে পরিচয় হয় একজন বেশ বয়ষ্ক আমেরিকান-পর্যটকের সঙ্গে। কর্ণেল জনসন (আসল নাম নয়), একজন ভিয়েতনাম-ভ্যাটরান। আমার পরিচয় পেয়ে প্রাণ খুলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, থাইল্যান্ড, বার্মা নিয়ে কথা বলেন...।
বিচে একদল বিদেশী নারী পুরুষ উৎসাহ নিয়ে আবর্জনা কুড়াচ্ছে। জনসন বলেন- ওরা ইউএস ওয়ার ভেটেরান্স (ভেটারান্স ওয়াইভস ক্লাব) এর একটি দল। ‘ট্রাশ পিক আপ ডিটেইল-চলছে।
বিশাল দেহের কর্ণেল বলেন- ‘‘শোন ১৯৬৯ সালে যখন (আরএন্ডআর এ) সায়গন থেকে পাতায়ায় প্রথম আসি... সামরিক বিমানে সায়গণ থেকে পাতায়ার নিকটবর্তী ইউ-থাপাও এয়ার বেজে। এখানে তখন ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটি কটেজ ছিল মাত্র...। বড় হোটেল একটি-নিপা লজ। আমি জংলি হাতিও দেখেছি...’’।
কর্ণেল একসময় পর্যটন ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। আমার সঙ্গে চিয়াং মাই এর গল্প বলেন। ‘‘চিয়াং মাই হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ‘লিসেনিং পোস্ট’। একসময় এখান থেকে দক্ষিণ চীন, লাওস, কম্বোডিয়া থেকে সিগনাল ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করা হতো। ওখানে আমেরিকান কনসুলেটটি এখন বড় আকারে তৈরী হচ্ছে। বার্মা ঘিরে নতুন কোল্ড ওয়্যার শুরু হচ্ছে। এবার চীন-রাশিয়া একদিকে, অন্যদিকে ইউএসএ। এর প্রভাব তোমাদের বাংলাদেশের উপরও কিন্তু পড়বে। থাই-বার্মা বিষয়াদি বুঝতে তোমাকে চিয়াং মাই অঞ্চলে কিছুদিন থাকতে হবে। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ শান প্রদেশের রাজনৈতিক-সামরিক ডেভলেপমেন্ট বুঝতে পারবে। ’’ আর অবশ্যই যেতে হবে তাক প্রদেশের মায় সট শহরে-বার্মার গেটওয়ে। সীমান্ত বাণিজ্য, চোরাচালান, এনইউজি-কারেনদের কর্মকান্ড, কল ও স্ক্যাম সেন্টার...।
কর্ণেল জনসন সম্ভবত এ অঞ্চলে ইন্টেলিজেন্সও (গোয়েন্দা বিভাগে) কাজ করেছেন। এই অঞ্চল তার নখদর্পনে। বাংলাদেশের মিয়ানমার নীতি নিয়ে একটু খোঁচা মারলেন- ‘‘তোমরা কেন যেন এসার্টিভ না...’’। বার্মা অ্যাক্ট নিয়ে কিছু কথা হয়। আমার দিকে কিছুটা হেঁসে বললেন- ‘‘শোন, আমেরিকানরা হুট হাট করে কিছু করে না...। সব কিছুর একটা সময় আছে’’। বার্মা সম্পর্কে আমেরিকার অবস্থান কিছুটা বুঝতে পারলাম। কর্ণেল জনসন তাঁর চিয়াং মাই এর রিসোর্টের ছবি দেখালেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এবার চিয়াং মাই আর যাওয়া হলো না।
চিয়াং মাই প্রসঙ্গে সুইডিশ সাংবাদিক ‘বার্টিল লিনটার’ এর প্রসঙ্গ আসে। ‘‘বার্টিল লিনটার কিন্তু আমার ভালো বন্ধু। ও ওখানে বিয়ে টিয়ে করে একেবারে এই সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে’’-বলেন কর্ণেল। এরপর আইফোনের স্ক্রিণে বার্মার উপর একটি লেখা পড়তে বলেন। ‘‘হোয়াট এ নিউ থাই গভারমেন্ট কুড মিন ফর মিয়ানমার’’-বার্টিল লিটনার (দি ইরাওয়ার্দী, ২৯ মে ২০২৩)।
মিয়ানমারের সংঘাত প্রশমন প্রচেষ্টা ও আসিয়ানের ভূমিকা
মিয়ানমার সংকটে থাইল্যান্ডের ‘সংঘাত প্রশমন প্রচেষ্টা’ ও আসিয়ানের ভূমিকা নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। কর্ণেল জনসন বলেন- ‘‘মিয়ানমারের শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য ২০২১ এর এপ্রিলে আসিয়ান দেশসমূহ ‘৫ দফা ঐক্যমত্য’ পরিকল্পনায় সম্মত হয়। বর্তমানে আসিয়ান (বিশেষত মালয়েশিয়ায়) সেই ৫-দফা শান্তি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে চায়। ওখানে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মাঝে ‘হিউমেনিটারিয়ান করিডোর’ চালু করার কথা। তবে সমস্যা কিন্তু অন্যখানে...। ‘থাইল্যান্ডের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার এটি চাইলেও হয়তো হবেনা। এর কারণ মিয়ানমার সীমান্তের স্পর্শকাতর এলাকায় থাই সেনাবাহিনীর কথাই শেষ কথা। ব্যাংককস্থ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়। তবে ভবিষ্যতে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার মিয়ানমারের বিষয়ে থাইল্যান্ডের বর্তমান পলিসি পরিবর্তন করতে চাইতে পারে। মিয়ানমারের যুদ্ধ বন্ধে সক্রিয় উদ্যোগও গ্রহণ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে থাই সেনাবাহিনীকে আস্থায় না নিলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ তৈরি হতে পারে’- বললেন কর্ণেল।
মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ‘গলফ ডিপলোমেসি’
কর্ণেল জনসন এর সাথে কথা বলে, থাই-মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেল সম্পর্কে নতুন তথ্য পেলাম। ‘‘বার্মায় জেনারেলগণ ব্যক্তিগত সম্পর্ককে (ক্যাজুয়াল এন্ড পারসনাল) খুব গুরুত্ব দেয়। বার্মার অনেক প্রভাবশালী জেনারেলের সঙ্গে থাই জেনারেল ও রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।’’ সামরিক কূটনীতির আলোকে দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের ভিজিট প্রায়ই হয়ে থাকে। এই সময়ে, চোখ ধাধানো সুন্দর গলফ ক্লাবগুলো দুই সেনাবাহিনীর প্রীতিময় সম্পর্কের প্রতীক হয়ে পড়ে। গলফের প্রাণবন্ত পার্টিগুলো দেখে তখন মনে হয়না-মিয়ানমার থাইল্যান্ডের প্রায় ২৪০০ কিঃ মিঃ ব্যাপী সীমান্তে ড্রাগ, অস্ত্র চোরাচালান, ইনসারজেন্সী, শরণার্থী সমস্যা, সীমান্ত সংঘর্ষ, অনুপ্রবেশ, ও প্রক্সি ওয়্যার আছে বা একসময় ছিল।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে গলফ খেলা বেশ জনপ্রিয়। একই ঘটনা থাইল্যান্ডেও। লেখক-বিশ্লেষক মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অবসরপ্রাপ্ত) মিয়ানমারের সিথওয়েতে কনসুলেট প্রধান হিসেবে (১৯৯৯-২০০২) চাকুরী করার বিরল অভিজ্ঞতার অধিকারী। ২০০০ সালে টেকনাফ সীমান্তের একটি ঘটনা কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে বেশ উত্তেজনা দেখা দেয়। দুই দেশের বাহিনী তখন প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে। সীমান্তে এমন বৈরীতার মধ্যেও বাংলাদেশের কনসাল (মেজর এমদাদ) ও মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনাকমান্ডার জেনারেল অং টোয়ে সিথওয়ের (আকিয়াব) গলফ ক্লাবে একসঙ্গে গলফ খেলছিলেন। সেদিন অত্যন্ত স্মার্ট ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা মেজর এমদাদ গলফের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে মিয়ানমারের জেনারেলকে সীমান্ত পরিস্থিতি সুন্দরভাবে বোঝাতে সক্ষম হন। গলফ-ডিপলোমেসি সেদিন সীমান্ত যুদ্ধকে থামিয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিল।
অদ্ভুত বিষয় হলো, শুধুমাত্র মিয়ানমার আর্মি বা সশস্ত্র বাহিনী নয়; এমন কি কোন কোন গেরিলা আর্মির অফিসারগণও গলফ খেলে থাকে। কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সদরদপ্তর ‘লাইজাতে’ তাদের নিজস্ব গলফ কোর্স রয়েছে। কেআইএর কর্ণেল মারান জ টাংয়ং বলেন- ‘‘গলফ খেললে অফিসারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে’’। উল্লেখ্য, আরাকান আর্মির জন্ম হয়েছিল কাচিনের এই লাইজাতে। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব প্রাচ্যেও গলফ জনপ্রিয়। গলফ খেলার সময়, রিলাক্সড ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে অন্যপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে।
ঈদের নামাজে একজন মজলুম রোহিঙ্গার মোনাজাত
২৯ জুন ২০২৩, ঈদ উল আজহা। ঈদের নামাজ পড়তে এসেছি ব্যাংককের সেন্ট্রাল মসজিদে। অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। এদেশে প্রায় ৫% নাগরিক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। নামাজে এসে শাহনেওয়াজ আহমদ নামে একজন রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। আবেগে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বহু বছর আগে কাঠের নৌকায় চড়ে বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর পেরিয়ে পরিবারের সঙ্গে ‘শিশু শাহনেওয়াজ’ মালয়েশিয়া এসেছিল। এখন ব্যাংককে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করছে। কক্সবাজারে দেখা হত দরিদ্র, বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বিপরীতে শিক্ষিত ও সুবেশিত এই যুবকটিকে দেখে খুব ভালো লাগলো।
শাহনেওয়াজ আহমদ থাইল্যান্ডের ‘রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন’ ও ‘আরাকান প্রজেক্ট’ নিয়ে কথা বলে। ব্যাংককে রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র একটি কমিউনিটি আছে। শাহনেওয়াজ আমাকে সেখানে দাওয়াত দিলেন। মোনাজাতের সময় লক্ষ্য করি যুবকটির চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষেরা তাদের উপর নেমে আসা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানেনা। চোখের জলই তাদের প্রতিবাদের ভাষা। মোনাজাতে আমিও অত্যাচারিত, বিপন্ন, দরিদ্র হতভাগ্য, মজলুম রোহিঙ্গাদের মঙ্গল ও মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি...। কেন তাদের প্রতি এতো অত্যাচার, অবিচার...? কেন তাদের এতো কষ্ট, এতো দুঃখ...? জনম দুখী রোহিঙ্গাদের দুঃখ কি শেষ হবে না?
অথৈ সমুদ্রে ভাসা ‘রোহিঙ্গা বোট রিফিউজিদের’ করুন কাহিনী
শাহনেওয়াজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হতভাগ্য ‘রোহিঙ্গা বোট রিফিউজিদের’ কথা ভাবছিলাম! বছরের পর বছর ধরে রাখাইন থেকে (এমনকি বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকেও) হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসনের আশায় সমুদ্র পথে কাঠের নৌকায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছে। সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে রোহিঙ্গারা সমুদ্র পথে যাওয়ার চেষ্টা করে-তখন বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর শান্ত থাকে। টেকনাফ অঞ্চলে বিডিআর এ দায়িত্ব পালনকালে এসব ঘটনা জানার সুযোগ হয়েছিল। এই হতভাগ্যদের উল্লেখযোগ্য অংশই মৃত্যুবরণ করেছে বলে মনে করা হয়।
২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর চরম নির্যাতন নেমে এলে এবং নিজ জন্মভূমিতে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার সব আশা হারিয়ে-রোহিঙ্গারা ব্যাপকহারে (২০১২-২০১৫) সাগর পথে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। এই সময় এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারীদের দল। একটি গবেষণায় প্রকাশ-২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, প্রায় এক লাখ সত্তুর হাজার মানুষ মানাবপাচারকারীদের হাতে পড়ে পাচার হয়েছে। কিছু বাংলাদেশী নাগরিক ছাড়া পাচারকৃত এসব মানুষ সবাই রোহিঙ্গা। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সংঘবদ্ধ এইসব মানবপাচারকারী মানুষ পাচারের মাধ্যমে বছরে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। যাত্রাপথে এইসব নারী, পুরুষ আর শিশুদের উপর চালানো হয় জঘন্য অত্যাচার ও নিপীড়ন। এই রোহিঙ্গাদের অনেকে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় থাকা তাদের আত্মীয়দের কাছে যাওয়ার জন্য নিজেরাই ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে বের হয়েছিল। আবার অনেকে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে সমুদ্র পথে সফর করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় আটকে রাখা পাচারকৃত রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজন থেকে অর্থ আদায় করা হতো।
রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার ‘ট্রানজিট’ যখন থাইল্যান্ড
২০১৫ সালের মে মাসে আন্দামান সমুদ্রে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীর্ণ নৌকায় চড়ে সমুদ্রে ভাসছিল। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই অসহায় মানুষদের গ্রহণ করছিল না। এই বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হলে-সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়েছিল। মানবপাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার সময় থাইল্যান্ডকে ‘ট্রানজিট’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ডের দুর্গম পাহাড়ে ৩২ টি অগভীর কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত একটি স্থান। যেখানে পাচারের পূর্বে রোহিঙ্গাদের অপেক্ষায় রাখা হতো ধারনা করা হয়। পরে মালয়েশিয়ার পুলিশ দেশটির সীমান্ত অঞ্চলে ১৩৯ টি কবরের সন্ধান পায়। উল্লেখ্য, মে মাসের প্রথম দিকে থাই কর্তৃপক্ষ মানবপাচারকারি চক্রগুলোর কর্মকান্ড কঠোরভাবে দমনের উদ্যোগ নেওয়ার পর আন্দামান সাগরে ভাসমান হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশির সংকটের চিহ্ন প্রকাশ পায়।
সমুদ্র পথে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে থাইল্যান্ড ‘পুশ ব্যাক টু সী’ (রিফাউলমেন্ট) নীতি অনুসরণ করে। উপকুল রক্ষী বাহিনী সাধারণত এইসব শরণার্থী বহনকারী নৌকাগুলো ফিরিয়ে দেয়। কখনো এইসব অভিবাসিদের নৌকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে আবার সমুদ্রে ঠেলে দেওয়া হয়।
দুর্ধষ্য মানবপাচারকারী চক্র পালিয়ে আসা অসহায় রোহিঙ্গাদের থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় স্লেভ লেবার বা ‘দাস শ্রমিক’ হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষত থাইল্যান্ডের ‘চিংড়ি মাছের শিল্পে’ এই দাস শ্রমিকদের ব্যবহার করানো হয়। মাছের মতো রোহিঙ্গাদের বিক্রি করা হয়েছে হাত বদল হয়েছে। থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ‘রোহিঙ্গা দাস শ্রমিক’ গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিনত হয়েছিল। এ নিয়ে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা থাই সরকারের সমালোচনা করেছে। থাই কর্তৃপক্ষের একাংশ কিভাবে রোহিঙ্গাদের দুর্গম অঞ্চলে ‘ক্যাম্পে’ আটকে রেখে পরে মানবপাচারকারীদের কাছে বিক্রি করতো-এই মর্মে ‘রয়টার’ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে প্রকাশ করেছিল (থাইল্যান্ড’স ক্লেনডেনস্টাইন রোহিঙ্গা পলিসি আনকাভারর্ড)
থাইল্যান্ডে মানবপাচারের এই জঘন্য কাজে পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যাপক যোগসাজস ছিল। পরবর্তীতে এ জন্য, থাই সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ও কয়েকজন পুলিশ অফিসারের কঠোর শাস্তি হয়েছিল। তবে আশ্চর্য বিষয়, এতো বড় ঘটনায় খোদ মিয়ানমার সরকারের টিকিটাও স্পর্শ করা যায়নি। এই পৃথিবীতে রোহিঙ্গাদের দেখার কি কেউ নেই? সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবনতা এখনও চলছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে থাইল্যান্ডে আলোচনা
লক্ষ্য করি, থাইল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা খুব কম। এর প্রধান কারণ হলো রাখাইনের সঙ্গে থাইল্যান্ডের কোন সীমান্ত নেই। মিয়ানমারের কায়িন (কারেন), কায়াহ (কারেন্নি), মন ও শান স্টেটের বিষয়গুলো থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। রোহিঙ্গাদের ধর্মের (ইসলাম) বিষয়টিও হয়তো এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
তবে ২০১৫ সালের মে মাসে ‘রোহিঙ্গা নৌকা শরণার্থী সমস্যা’ এবং বিশেষত দক্ষিণ থাইল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের নিয়ে থাই মানবপাচারকারীদের জঘন্য সংশ্লিষ্ঠতা বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ ফেলে। তখন থাইল্যান্ডে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। থাই সমাজে রোহিঙ্গাদের প্রতি উল্লেখ করার মতো সমবেদনা নেই। আবার তীব্র অপছন্দও নেই। বর্তমানে বিভিন্নভাবে থাইল্যান্ডে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
মিয়ানমার বাহিনী (তাতমাদো) সামলানোর মূলমন্ত্র জানে থাই আর্মি
থাইল্যান্ড সশস্ত্রবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ থাই সেনাবাহিনী (রয়াল থাই আর্মি) একটি শক্তিশালী বাহিনী। এরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাহীন থাইল্যান্ডে অনেকবার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ব্যাপক প্রভাব আছে। থাই সেনাবাহিনী (স্পেশাল ওয়ারফেয়ার কমান্ড, টাস্কফোর্স-৯০) দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পিএসএফ/এসএসএফ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। কম্বোডিয়ার শান্তি মিশনে থাই সেনাবাহিনীর একটি ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কাজ করতো। সেই অঞ্চলে দায়িত্বপালন কালে বন্ধু সূলভ থাই সেনাবাহিনী সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেনানিবাস, বাসস্থান, যানবাহন, অবকাঠামো ইত্যাদি বিবেচনায় আপত দৃষ্টিতে থাই বাহিনী হয়তো ঝঁলমলে নয়। তবে তারা পেশাদার বাহিনী, আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামে সজ্জিত (আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড) এবং আভিযানিকভাবে খুব দ্ক্ষ।
দূধর্ষ তাতমাদোকে কিভাবে মোকাবেলা করে থাকে থাই আর্মি? থাই সেনাবাহিনী মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে (তাতমাদো) সামলানোর মূল মন্ত্রটা ভালোভাবে জানে- ‘‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুধু অস্ত্র বা শক্তির ভাষাই বোঝে...। তাতমাদোর এটাই একমাত্র ওষুধ। তাই আন্তরিকতা, বন্ধুত্ব দেখালেও প্রয়োজনে থাই সেনাবাহিনী অস্ত্রের ভাষায় বা শক্তির মাধ্যমে জবাব দেয়’’। পাতায়ায় কর্ণেল জনসন এমন একটা কথা বলেছিলেন।
ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান-বোঝাপড়া, বাস্তবতা-উপলদ্বি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সংঘাত মোকাবেলা, ড্রাগ ও অস্ত্র চোরাচালান বিরোধী কর্মকান্ড, প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনা, সীমান্ত বাণিজ্য, ইত্যাদি পরিচালনা-ব্যবস্থাপনায়থাই সেনাকর্মকর্তা/জেনারেলদের গতিশীলতা, দক্ষতা, গভীর বোঝাপড়া ও দুর্দান্ত সামর্থ আছে। কর্ণেল জনসন বলেছিলেন- ‘‘দিস গাইস আর ব্লাডি কেপাবল। দে আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যা গেম’’।
থাই সেনাবাহিনীর ৫ টি সামরিক এলাকা (কমান্ড) রয়েছে। একেক সীমান্তে একেক ধরণের দায়িত্ব। চিয়াং মাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে (গোল্ডেন ট্রাঙ্গেল) ‘ফুট আর্মি’ বা ‘বাইসাইকেল আর্মি’। সেখানে যুদ্ধ মূলত ড্রাগ ব্যবসায়িদের সঙ্গে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণ অঞ্চলে বিশেষ করে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় একধরণের মৃদু (লো-ইনটেনসিটি) ইনসারজেন্সি বা বিদ্রোহ চলছে। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডের দক্ষিণে ৩ টি প্রদেশ মালয়-মুসলিম অধ্যুষিত। বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন চায়। সেখানে থাই সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত।
থাইল্যান্ডের ‘চিকেন নেক’ অঞ্চলে ভ্রমণ!
থাই সেনাবাহিনী থিউরি থেকে ভূমি পর্যায়ে ব্যবহারিক বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের আভিযানিক দক্ষতা অত্যন্ত প্রসংশনীয়। ব্যাংকক থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার রেললাইন ও সড়ক তৈরী হয়েছে অরণ্যময় টেনাসারিম পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ম্যাপের দক্ষিণ দিকে তাকালে দেখা যায় যে, একটি সংকীর্ণ অঞ্চলে দু’টি দেশের সীমানা চলে গেছে। এটি মূলত মালয় পেনিনসূলার উত্তর অংশ। পশ্চিমে আন্দামান সাগর (মিয়ানমার), পূর্ব দিকে গালফ অফ সিয়াম (থাইল্যান্ড)। থাইল্যান্ডের এই এলাকার ‘খোলং ওয়ান’ (প্রাচুক খিরি খান রাজ্য) অঞ্চলটি হলো থাইল্যান্ডের ‘সবচেয়ে সংকীর্ণ পয়েন্ট’ বা ‘ন্যারোয়েস্ট পয়েন্ট’। এখানে থাইল্যান্ডের সীমানা বা এলাকা মাত্র ১১ কিমি বা ৬ মাইল বিস্তৃত। এর কাছেই সিংখোন পাস ও মিয়ানমারের ডান সিংকন বর্ডার পোস্ট অবস্থিত। এটাকে সাধারণভাবে থাইল্যান্ডের ‘চিকেন নেক’ বলা যায়। এই অঞ্চলটি থাইল্যান্ডের জন্য রণকৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।
থাই সেনাবাহিনী আভিযানিক প্রস্তূতির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। রয়েল থাই আর্মি কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ প্রতি বছর সামরিক-ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন সামরিক এলাকা সফর করে এবং ঐ অঞ্চলের আভিযানিক পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্লান পর্যালোচনা করে। তৎকালীন মেজর তোফায়েল আহমেদ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) থাইল্যান্ডে স্টাফ কলেজ করা কালিন সময়ে, তাদের ‘ফাইনাল এক্সারসাইজ’ পরিচালিত হয়েছিল এই চিকেন নেক ‘খোলং ওয়ান’ এলাকায়। এটি ছিল বিদেশী ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত মজার একটি অভিজ্ঞতা।
১৯৯৩ সালের মার্চ। কম্বোডিয়ায় শান্তি মিশন থেকে আমি ব্যাংকক থেকে ট্রেনে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুরের দিকে যাচ্ছি...। প্রায় মধ্য রাত। ট্রেনটি থাই-বার্মা সীমান্ত এলাকা (চিকেন নেক) দিয়ে অরণ্যময় টেনাসারিম পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার কম্পার্টমেন্টে ব্রিটেনের একজন সাহসী তরুন পর্যটক। ট্রেনটি ততক্ষণে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে আরো দক্ষিণে মালয়েশিয়ার দিকে চলমান। তখন ব্রিটিশ তরুনটি আমাকে জানালো যে, ‘‘আগামী কয়েক ঘন্টা ধরে ট্রেনটি দক্ষিণ থাইল্যান্ডের একটি সংঘাতপ্রবন এলাকার মধ্য দিয়ে যাবে। স্থানীয় গেরিলারা ট্রেনে আক্রমণ করতে পারে, বোমাও ফেলতে পারে। সাবধান”। তার সতর্কতা পাত্তা না দিয়ে আমি রাত্রিকালীন দক্ষিণ থাইল্যান্ড দেখতে থাকি।
তখন আমি জানতাম না, আমি যে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম সেটি পরবর্তীতে রোহিঙ্গা পাচারকারীদের মূল রুটে পরিনত হবে। রাখাইন থেকে হাজার হাজার ‘রোহিঙ্গা নৌকা শরণার্থীদের’ নিয়ে দূধর্ষ মানবপাচারকারীরা থাইল্যান্ডের অরণ্যময় রেনং-ফাং না-বান ক্লোং টর-সাডাও-পাদাং বাসার এলাকার ক্যাম্পে আটকে রাখতো এবং পরে মালয়েশিয়া পাচার করতো। কি অদ্ভূত জীবন রোহিঙ্গাদের।
থাইল্যান্ডের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোল্ডেন ট্রাঙ্গেল, কারেন প্রদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও মায় সটের কাছে ড্রাগ পাচার, ক্যাসিনো এনক্লেভ ও কল সেন্টার, স্ক্যাম সেন্টার এ জড়িত আছে বলে জানা যায়। গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ‘দৈনিক মানবজমিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (মিয়ানমারে আটক ১৮ বাংলাদেশীর ফেরার আকুতি) জানা যায়, কারেণ অঞ্চলের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রণে থাকা স্ক্যাম সেন্টারে কিছু বাংলাদেশীও জিম্মি অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। ঐ স্ক্যাম সেন্টারগুলোর নিয়ন্ত্রক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকেন্দ্রিক একটি আন্তঃসীমান্ত অপরাধী চক্র।
থাইল্যান্ডে যত ভ্রমণ
কম্বোডিয়া শান্তিমিশনে (১৯৯২-৯৩) শান্তিরক্ষীদের কাছে থাইল্যান্ড (বিশেষত সীমান্তবর্তী এলাকা) অনেকটা ‘মিশন এরিয়ার’ মতোই ছিল। উল্লেখ্য, কম্বোডিয়ায় মিশনে যোগদানের জন্য ৩য় ইস্ট বেঙ্গল (বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন) ঢাকা থেকে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে বিমানে থাইল্যান্ডের উথাপা বিমানবন্দর হয়ে পাতায়া আসে। এর পর পাতায়া থেকে সড়ক পথে বিশাল কনভয় যোগে এই কন্টিনজেন্ট অরন প্রথেট হয়ে কম্বোডিয়ায় পৌঁছেছিল। উল্লেখ্য, কম্বোডিয়া শান্তিমিশনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্ণেল খোন্দকার কামালুজ্জামান (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)।
কম্বোডিয়ার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে (থাইল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল) দায়িত্ব পালনকালে থাইল্যান্ডের ‘অরণ প্রথেট’ অঞ্চলে যাওয়া হয়েছিল। মূলত অরণ প্রথেট এলাকায় কম্বোডিয় শরণার্থীদের ক্যাম্প ছিল। কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৭০-১৯৮০ দশকে) প্রায় ৩৭০০০০ কম্বোডিয় শরণার্থী থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৯২ এর মার্চে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শরণার্থীরা দেশে ফেরা শুরু করে। শান্তিরক্ষী হিসেবে এই প্রত্যাবাসন কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত ছিলাম।
পরে ব্যাংকক থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের শহর নংখাই হয়ে লাওস ভ্রমন করেছি। ব্যাংকক থেকে ট্রেনে মালয়েশিয়া (হাট ইয়াই-পাদাং বাশার) যাওয়ার সময় মুসলমান-প্রধান দক্ষিণ থাইল্যান্ডের কিছুটা দেখা হয়েছিল।
এবার বার্মা সীমান্তে বিশেষত থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চল (বার্মার পূর্বাঞ্চল) ভ্রমণের পরিকল্পনা ও তথ্য সংগ্রহ করি। ‘মিশন মায় সট’! মায় সট শহরটি মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের প্রধান সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র ও বার্মা যাওয়ার গেটওয়ে। এর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কাঞ্চনবুরি। এখানে গেলেই বিখ্যাত ‘ব্রীজ অন রিভার কাওয়াই’ দেখা যায়।
থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ভূমিকা
আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, মিয়ানমারের সংকট সমাধানে থাইল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘতম সীমান্ত, দুই দেশের পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ ও আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় থাইল্যান্ড মিয়ানমারের ‘শান্তি বিনির্মাণে’ (পিস বিল্ডিং) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সামর্থ্য রয়েছে থাইল্যান্ডের। মিয়ানমারের সংঘাত-উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য থাইল্যান্ড একটি শক্তিশালী স্পেশাল টাস্কফোর্সও গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্স যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলের মানুষের সাহায্যে পাঠানোর বিবেচনা করছে। অনেক বিশেষজ্ঞ আশাবাদী যে, থাই সরকার মিয়ানমারের সকল অংশিজনের মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী এর ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
থাইল্যান্ড আসিয়ান প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরিন সংকট সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জান্তা সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করছে। এছাড়াও থাইল্যান্ড আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর’ চেষ্টা করছে। যেমন- মিয়ানমারসহ আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি করেছে।
থাইল্যন্ড ভ্রমণে কি শিখলাম?
থাইল্যান্ড থেকে এবার কি কি শিখলাম? থাইল্যান্ড অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। থাইল্যান্ডের সাফল্যের অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে, সে দেশের নাগরিকরা তাদের রাজনৈতিক স্থিতিহীনতাকে সামাজিক অরাজকতায় রূপান্তরিত হতে দেয়নি (যেটা আমরা চমৎকারভাবে করেছি!)। তাদের সাফল্যের আরেকটি কারণ- শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদনের বিকাশ আর তার রফতানিতে অভূতপূর্ব সাফল্য। ব্যবসা বান্ধব থাইল্যান্ড হলো বিদেশী বিনিয়োগের সুবর্ণভূমি।
রাষ্ট্রিয় কর্মকান্ড, পররাষ্ট্র নীতি এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে থাইল্যান্ডের মানুষের বাস্তবধর্মিতা আছে। থাইল্যান্ডের শাসকগণ অত্যন্ত বিচক্ষণ। কয়েক শতাব্দী আগে বিদেশীদের আগমন হয়েছিল সেই দেশে। কিন্তু বিচক্ষণতার সঙ্গে (কিংস ডিপ্লোমেসি) থাই শাসকগণ তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করেছে। কিন্তু বিদেশীদের মানদন্ডকে রাজদন্ডে পরিনত হতে দেয়নি। সব সময় স্বাধীন থেকেছে এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ থাইল্যান্ড।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই থাইল্যান্ডের প্রতিবেশী সকল দেশ (লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া) দীর্ঘ যুদ্ধের আগুনে পুড়েছে। কিন্তু থাইল্যান্ডের নেতারা কূটনৈতিক পারদর্শিতা ও বিচক্ষনতা দিয়ে দেশকে যুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে। এম্বেসেডর শাহেদ আকতার দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে থাইল্যান্ডে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেন- ‘‘বলা হয়, থাইল্যান্ডে প্রত্যেক সমস্যার একটা স্থানীয় ‘থাই সলিউশান’ (সমাধান) আছে। থাইল্যান্ডের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী আনন্দ পানইয়াচুন বলেছিলেন- ‘‘আমাদের ম্যানেজমেন্টের ধরণ আলাদা’’। থাইল্যান্ড থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
থাইল্যান্ডের ‘মিয়ানমার পলিসি’ থেকে শিক্ষণীয়
থাইল্যান্ড ভ্রমণকালে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র-সামরিক-কৌশলগত বিষয়াদি বিশেষত ‘মিয়ানমার পলিসি বা নীতি’ থেকে টেকএওয়ে বা শিক্ষণীয় বিষয়গুলো আবার মনে পড়লো...। (ক) থাইল্যান্ডের নেতৃত্বের বিচক্ষণতা, (খ) কূটনীতিতে পারদর্শীতা ও বাস্তব সম্মত সাহসী পদক্ষেপ, (গ) সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় থাই সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, (ঘ) বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নিজস্ব ‘থাই সলুশান’, (ঙ) সীমান্ত পরিস্থিতি ও ভূকৌশলগত বিষয়ে থাই সেনাবাহিনীর মতামতে গুরুত্ব, (চ) রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড ও অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে বাস্তব ধর্মিতা, (ছ) মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যাপক সীমান্ত-বাণিজ্যের সুবিধা নেয়া (ইনফরমাল ট্রেড), (জ) মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এথনিক সশস্ত্র গোষ্ঠি সামলানোর মূল মন্ত্র-অস্ত্র/শক্তির ভাষায় কথা বলা, (ঝ) রাজনীতি-সামরিক-কৌশলগত বিষয় থেকে অর্থনীতিকে আলাদা রাখা..., (ঞ) অন্য দেশের বিষয়ে না জড়ানো।
রাখাইন ট্রেন মিস করা যাবেনা
জানুয়ারী ২০২৫। ১৮ মাস পরের কথা। বর্তমানে থাইল্যান্ডের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার (প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা, ফেউ থাই পার্টি) মিয়ানমার-বিষয়ক নীতির কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সে দেশে যুদ্ধবন্ধে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়, গত ১৯ ডিসেম্বর মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে থাইল্যান্ডের উদ্যোগে ব্যাংককে পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আসিয়ান দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক। আসিয়ান নেতারাও মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও তার বিরোধী পক্ষকে দেশটির গৃহযুদ্ধে রক্তপাত বন্ধ করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে চাপ দিয়েছে (অক্টোবর ২০২৪) । রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকাকে দ্রুত সাহসী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের কিন্তু রাখাইন ট্রেন মিস করা যাবে না।
এখন ঢাকার সক্রিয় হওয়ার সময়। আমাদের মনে রাখতে হবে, নেকড়ে অধ্যুষিত অরণ্যে পূর্বের মতো লুম্বিনী পার্ক বা শান্তি নিকেতন সূলভ ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ আধুনিক রাষ্ট্রে উপযোগী নয়।
ঈদের দিন সেন্ট্রাল মসজিদে দেখা রোহিঙ্গা যুবক শাহনেওয়াজ আহমদের কথা মনে পড়লো। বাংলাদেশের কাছে রোহিঙ্গাদের অনেক প্রত্যাশা। বলা যায়, এখন রাখাইন থেকে বাংলাদেশে ৪র্থ রোহিঙ্গা ঢল’ নামছে। এটা বন্ধ করতেই হবে। দক্ষিণ পূর্ব সীমান্ত নতুন প্রতিবেশীর (রাখাইন) জন্ম হতে চলেছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। কিন্তু অসাধারণ সুযোগও তৈরী হয়েছে।
আমি যখন থাইল্যান্ড বেড়াচ্ছিলাম, (জুন ২০২৩) তখন শান রাজ্যে তিনটি গেরিলা দল (আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি) একত্রে যুদ্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছিল। এই তিনটি গেরিলা দল পরে ‘থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স’ গড়ে তুলেছে। ‘আরাকান আর্মি’ রাখাইন অঞ্চলে নতুন ভাবে যুদ্ধ শুরু করেছে ও প্রায় ৯০ ভাগ অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। অন্য অঞ্চলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলো ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে।
অপরূপ থাইল্যান্ড ভ্রমনকালে বিভিন্ন ব্যক্তির মিথস্ক্রিয়া ও আলাপচারিতায় পাওয়া মিয়ানমার বিষয়ক ইঙ্গিত ও সম্ভাবনাগুলোকে এখন মিলিয়ে দেখছি। কিছু ইঙ্গিত অবশ্য তখন পরিস্কারভাবে বুঝতে পারিনি। তবে ধারণা হয়েছে। কর্ণেল জনসন মিয়ানমারের ‘শান’ রাজ্যের কথা অনেকবার বলেছিলেন।‘‘ সামথিং ইজ কুকিং আপ দেয়ার?’’ এই সাবেক দূঁদে-গোয়েন্দা কর্ণেল কি ‘থ্রি ব্রাদারহুড এ্যালায়েন্স’ এর কথা বলেছিলেন? অধ্যাপক খিন মঙ বলেছিলেন- ‘‘২০২৪ সালে কিছু পরিবর্তন হয়তো দেখতে পাবেন’’।
রাখাইনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা কৌশলের যে পরীক্ষা
মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বর্তমানে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতন বা পরিবর্তন খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাবুল বা দামাস্কাস স্টাইলে হয়তো হবে না। তবে পতনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত সম্পর্ক এবং উপস্থিতি গভীরভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ যে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তার কূটনৈতিক নীতি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং কীভাবে রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র কৌশলকে সামঞ্জস্য করতে পারে, তা নিয়ে একটি সুষম বিশ্লেষণ ও আলোচনা দরকার।
রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড় করিয়েছে। যা আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বড় পরীক্ষা হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের ইঙ্গিত এবং রাখাইনে আঞ্চলিক শক্তির পালাবদল, বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য সুযোগও তৈরি করেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি তার পররাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করতে পারে, তবে শুধু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই সম্ভব হবে না, বরং রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নেও বাংলাদেশে অবস্থান পরিষ্কার হবে।
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজধানীতে অনেক ব্যস্ততা। মিয়ানমারের বিশাল একটা অংশ এথনিক সশস্ত্র গোষ্ঠি ও এনইউজি এর নিয়ন্ত্রণে আসায় থাইল্যান্ডও তাদের মিয়ানমার নীতির কিছুটা পরিবর্তন করেছে। আসিয়ানও এগিয়ে আসছে। ঢাকার এখন যথাযথ কূটনীতি ও কৌশলগত পদক্ষেপ প্রয়োগের সময়।
প্রায় ৬০০ শত বছর আগে মধ্যযুগে, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা (বেঙ্গল বা বঙ্গের অধিবাসীরা) আরাকান বা রাখাইনে একধরণের ‘হিতৈষী অভিভাবক সুলভ’ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যখন রাখাইন (বৌদ্ধ)-রোহিঙ্গা ও অন্যান্য মুসলমান জাতিগোষ্ঠি একত্রে ম্রাউক-উ (পাত্থুরিকিল্লা) ভিত্তিক এক প্রাণবন্ত ‘নগর সভ্যতা’ গোড়াপত্তন (১৪২৯ সাল) করেছিল। আশাকরি, এর প্রায় ৬০০ বছর পর, নতুন পরিবেশে ‘নুতন বাংলাদেশ’ এর সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকগণ এই অসাধারণ সুযোগ সুন্দরভাবে কাজে লাগাবে। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও রক্ষিত হবে।
রাখাইনে একটি বাংলাদেশী সল্যুশনের (সমাধান) সন্ধানে
এই লেখায় থাইল্যান্ডের আলোচিত পলিসি ও কৌশলগুলো বাংলাদেশের মিয়ানমার বিষয়ক সমস্যা/চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি মডেল হতে পারে। মিয়ানমার বিষয়ে, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার পার্থক্য রয়েছে। তবুও থাইল্যান্ডের পলিসি ও কৌশলগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত নিরাপত্তা, সীমান্ত বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের অনুসৃত পদক্ষেপগুলো অনুসরণযোগ্য। রাখাইনের বর্তমান জটিল পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ‘থাই সল্যুশনের’ মতো একটি ‘বাংলাদেশী সল্যুশান বা সমাধান’। আশা করি, ‘নতুন বাংলাদেশের’ ঢাকা এ ক্ষেত্রে সফল ভূমিকা রাখবে।
মো. বায়েজিদ সরোয়ার: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন