ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘খাদ্য হোক নিরাপদ, সুস্থ থাকুক জনগণ’

ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন। ছবি : সৌজন্য
ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন। ছবি : সৌজন্য

খাবার নিয়ে নানা প্রশ্ন- যা খাচ্ছি তা বিষ নয় তো? ফলমূলে কেমিক্যাল, মাছে ফরমালিন, গরুর মাংসে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকস, শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ- এ ধরনের অনেক সংশয় ও আতঙ্কের মধ্যেই আমরা বেঁচে আছি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শূন্য ঝুঁকি বলতে কিছু নেই। প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই কমবেশি ঝুঁকি থাকে। তবে কোনো কিছুর ঝুঁকির চেয়ে তার উপকারের পরিমাণ যদি অনেক বেশি হয়, তাহলে আমরা সে ঝুঁকিকে মেনে নিই। আমাদের আশপাশে এমন খুব কম প্রযুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাবে, যা সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকিমুক্ত। মোবাইল, ল্যাপটপ, যানবাহন ইত্যাদি সবকিছুতেই ঝুঁকি জড়িত, কিন্তু এদের উপকারের মাত্রা এত বেশি যে, এ ঝুঁকি গ্রহণে আমরা কোনো দ্বিধা করি না।

তারপরও বিজ্ঞানীরা এসব প্রযুক্তির ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনতে প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন আর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকরা দিচ্ছেন নতুন নতুন পরামর্শ। খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বেশি বা কম দু-ধরনের খাদ্য গ্রহণই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের গ্রহণ করতে হবে পরিমিত সুষম খাবার।

আজ রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘খাদ্য হোক নিরাপদ, সুস্থ থাকুক জনগণ’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য মতে, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী বা রাসায়নিক পদার্থযুক্ত অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে ২০০-এর অধিক রোগ হয়, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন অসুস্থ হয় এবং প্রতিবছর ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।

তা ছাড়া পাঁচ বছরের নিচে কমবয়সী শিশুরা ৪০ শতাংশ খাদ্যবাহিত রোগ বহন করে। এতে প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু মারা যায়। খাদ্যবাহিত রোগগুলোর মধ্যে একমাত্র ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েই প্রতি বছর হাজারো মানুষ মারা যায়। এমতাবস্থায় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চয়তার লক্ষ্যে জাতিসংঘ একটি কর্মমুখী ক্যাম্পেইন গাইড প্রণয়ন করেছে। কর্মমুখী ক্যাম্পেইনটি বিশ্বব্যাপী নিরাপদ খাদ্যসচেতনতাকে উৎসাহিত করবে ও পাশাপাশি দেশগুলোতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ, জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাসহ সাধারণ মানুষকে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করবে। তাই সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি ও অধিকার।

খাদ্যে বিভিন্নভাবে ভেজাল বা ক্ষতিকর দ্রব্যাদি মেশানো হচ্ছে এ কথাটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদিও নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন ও ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করে। এরপর ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে জাতীয়ভাবে নিরাপদ খাদ্য দিবস ধারাবাহিকভাবে পালিত হয়ে আসছে এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে বাজারে এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও এসব উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

নিরাপদ খাদ্যের ক্ষেত্রে বর্তমানে ভয়াবহ দিক হলো- খাদ্যে অন্যান্য ভেজালের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও মাইকোটক্সিনের উপস্থিতি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন, আগামীদিনে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়গুলো অনেক বেশি ভোগাবে।

তবে ঢালাওভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে এ কথাটি এখন আর সঠিক নয়। পরীক্ষাগারের বিশ্লেষণ ছাড়া এ কথাটি অনেক ক্ষেত্রে অপপ্রচারও। বরং আমাদের দেশের কৃষকরা উন্নত দেশ যেমন- জাপান, কোরিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশের তুলনায় কম পরিমাণে কেমিক্যাল ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করে।

আমাদের দেশের কৃষকদের বড় সমস্যা হলো- তারা প্রি হারভেস্ট ইন্টারভেলকে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করে, যার কারণে আমাদের খাদ্যদ্রব্যে কীটনাশকের বা বালাইনাশকের উপস্থিতি রয়ে যায়। এ ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, উৎপাদনের পরিবেশও খাদ্যের মানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বাজারের তাজা মাছ বা সবজি কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটি কিন্তু তাদের গুণমান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

তবে সাধারণভাবে আমাদের প্র্যাকটিস হলো- আমরা বাজার থেকে কোনো সবজি কিনলে তা ভালোভাবে ধুয়ে ও রান্না করে খাই। গবেষণায় দেখা গেছে, ভালোভাবে ধুয়ে ও রান্না করলে কীটনাশকের যদি কোনো অবশিষ্টাংশ সবজিতে থাকে তার ৬০-৮০ শতাংশ চলে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। আর আরেকটু সচেতন হয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লবণপানি বা ভিনেগারে প্রক্রিয়াজাত করে খেলে আর কোনো অবশিষ্টাংশই হয়তো থাকবে না।

তাই এ বিষয়ে আরও বেশি গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল যত বেশি প্রচার হবে ততই আমাদের মঙ্গল। আশার কথা হলো- এ রকম নানা গবেষণা এখন দেশে শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও ফুড সেফটির একটি ল্যাব কিছুদিন পূর্বে স্থাপিত হয়েছে, যা নিরাপদ খাবারের প্রাপ্তি ও গবেষণাকে আরও বেশি শক্তিশালী করবে।

তাই সামগ্রিকভাবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি : ১. নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কৃষককে নিরাপদ চাষাবাদ তথা গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস সম্পর্কে সচেতন করা। ২. অনুমোদনবিহীন কোনো সার ও কীটনাশক যেন ফসলে ব্যবহার না হয় সে ব্যাপারে মনিটরিং জোরালো করা এবং প্রয়োজন মতো বা লেভেল মেইনটেইন করে যেন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয় এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৩. ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে সচেতন করা। ৪. খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিক্রয় ও ভোক্তার খাদ্যগ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৫) নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য এ ব্যাপারে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। ৬. নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে সব (সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও ব্যক্তিমালিকানাধীন) শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করা।

আয়তনে আমরা বিশ্বের ৮৮তম দেশ হলেও জনসংখ্যায় আমরা ৮ম। বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার এ দেশে নিরাপদ খাবার উৎপাদন ও সরবরাহ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। সরকারের নানা কার্যক্রমে আমাদের অগ্রগতি সাফল্যজনক। নিরাপদ খাবারের প্রচেষ্টাটি আমরা শুরু করেছি মাত্র, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে হবে।

আশার কথা হলো- গত ৬০ বছরে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে পারলে এ সূচকগুলো আরও অনেক বেশি উন্নীত হবে। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সরকার আরও বেশি উদ্যোগী হবে এ প্রত্যাশা করছি।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ই-মেইল: [email protected]

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষার্থীদের তালা

ফরিদপুরে বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ২০

লাল চুড়ি দেখিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইল ইনকিলাব মঞ্চ

মুরগির হ্যাচারিতে পরিবেশদূষণ, সরিয়ে দিতে এলাকাবাসীর মানববন্ধন

অভ্যুত্থানে আহতদের আজীবন চিকিৎসাসহ ভাতা দেওয়ার চিন্তা

মহাসড়ক অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের 

গবেষণার জন্য প্রণোদনা পাবে শিক্ষার্থীরা : যবিপ্রবি উপাচার্য

জুলাই বিপ্লবের চেতনা ভূলণ্ঠিত করা যাবে না : হাসান জাফির তুহিন 

ইজতেমা ময়দান ও আশপাশে ড্রোন উড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা

১০

বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিহত, গ্রেপ্তার ৩

১১

ফ্যাসিস্ট আমলা ও মিডিয়া আওয়ামী পুনর্বাসনে উঠেপড়ে লেগেছে : হাসনাত

১২

নির্বাচন ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই : তারেক রহমান

১৩

পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছিলেন সোহেল, অতঃপর...

১৪

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হাকিম গ্রেপ্তার

১৫

মুরাদনগরে কায়কোবাদের ‘তারুণ্যের ভাবনায়’ তরুণ-শিক্ষার্থীদের ঢল

১৬

‘শাসন ক্ষমতার রূপান্তর ছাড়া দেশ বড় সংকটে পড়বে’

১৭

‘কৃষিজমি বাঁচাতে সরকারি নির্মাণে ব্লকের ব্যবহার বাড়াচ্ছে সরকার’

১৮

প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে বেধড়ক ‘পেটালেন’ বিএনপি নেতা

১৯

এবার শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত ডাস্টবিনে ময়লা ফেললেন উপদেষ্টা আসিফ

২০
X