শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ভাইরাস রয়েছে, যা মানুষের মাঝে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাইরাস হলো হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি)। এইচএমপিভি প্রথম ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে চিহ্নিত হলেও, গবেষণায় দেখা গেছে এটি গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের মধ্যে সক্রিয়। এইচএমপিভি ইনফ্লুয়েঞ্জা বা রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাসের (আরএসভি) মতোই কাজ করে এবং মানুষের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
এই ভাইরাসটি সব বয়সের মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে, তবে পাঁচ বছরের নিচের শিশু, বয়স্ক এবং দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের ব্যক্তিদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি গুরুতর। এটি সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে নিউমোনিয়া এবং ব্রংকিওলাইটিসের মতো বিভিন্ন ধরনের শ্বাসজনিত রোগের কারণসহ মৃত্যু ঘটাতে পারে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণজনিত মৃত্যুর প্রায় এক শতাংশের জন্য এইচএমপিভিকে দায়ী করা হয়।
সম্প্রতি চীন, জাপান, মালয়েশিয়া এবং ভারতে এইচএমপিভি সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, কারণ এ অঞ্চলে বড় আকারের জনসংখ্যা এবং স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা এই ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে পারে।
এইচএমপিভি সংক্রমণ কীভাবে ছড়ায়? এই ভাইরাস প্রধানত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমিত বস্তু বা হাতের মাধ্যমে এটি সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপ : * নবজাতক ও শিশু (বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী) * বয়স্ক ব্যক্তি * দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগে (যেমন অ্যাজমা বা সিওপিডি) আক্রান্ত রোগী * দুর্বল ইমিউন সিস্টেমযুক্ত রোগী (যেমন ক্যানসার বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তি)
এইচএমপিভির লক্ষণগুলো * এইচএমপিভি সংক্রমণের লক্ষণ সাধারণ সর্দি-কাশির মতো হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি *গুরুতর শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে। মৃদু লক্ষণ : * নাক দিয়ে পানি পড়া * হালকা কাশি * হালকা জ্বর * গলাব্যথা * শিশুদের ক্ষেত্রে খাওয়ার অসুবিধা বা ঝিমিয়ে পড়া গুরুতর লক্ষণ: * শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া * নিউমোনিয়া * ব্রংকিওলাইটিস * অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া
সংক্রমণে করণীয়
মৃদু সংক্রমণে * বিশ্রাম নেওয়া * প্রচুর পানি পান করা * জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়া গুরুতর অবস্থায় : * শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা * হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হলে দেরি না করা * অক্সিজেন সাপোর্ট বা অন্যান্য সাপোর্টিভ কেয়ার গ্রহণ করা
এইচএমপিভি সংক্রমণ রোধে জনসাধারণের করণীয় এখনো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। তবে নিম্নলিখিত সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা :
* নিয়মিত হাত ধোয়া এবং হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা। * পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা : সংক্রমিত বস্তু জীবাণুমুক্ত করা। * সমাজিক দূরত্ব বজায় রাখা : বিশেষত শীতকালে এবং সংক্রমণের সময়ে। * ভিড় এড়িয়ে চলা : বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে। * লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা : জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া * স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে সচেতনতা : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশিকা অনুসরণ করা।
এইচএমপিভি সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় সরকারের করণীয় এইচএমপিভি সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় সরকারের নিম্নলিখিত ভূমিকা জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি :
* গণমাধ্যমে (টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা) এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করতে হবে। * বিশেষত শিশু এবং বয়স্কদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এই ভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালানো জরুরি। * স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে এইচএমপিভি সম্পর্কে সচেতনতার জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে। ২. হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা : * সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি রাখতে হবে। * হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। * প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কর্মশালা আয়োজন করা প্রয়োজন।
৩. দ্রুত শনাক্তকরণ ও ল্যাব সুবিধা বৃদ্ধি :
* এইচএমপিভি শনাক্তে প্রয়োজনীয় কীটের সহজ প্রাপ্যতা এবং ল্যাবরেটরির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। * প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভাইরাস শনাক্তের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। * দ্রুত শনাক্তকরণ ও রিপোর্টিং ব্যবস্থা চালু করলে সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ৪. ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপে নজরদারি :
* পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। * কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সক্রিয় করে গ্রামীণ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। * দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগীদের (যেমন ক্যান্সার বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তি) বিশেষ নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।
৫. গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ :
এইচএমপিভি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। * সংক্রমণের প্রকৃতি, বিস্তৃতি এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে
* গবেষণার জন্য বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করা জরুরি। * সংক্রমণের ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে বিশেষ দল গঠন করতে হবে।
৬. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নিয়ে চলমান গবেষণায় অংশ নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ৭. সংক্রমণ রোধে নিয়মিত আপডেট : * সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে আপডেট দেওয়া। * নিয়মিত সতর্কতামূলক নির্দেশিকা জারি করা।
এইচএমপিভি নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা বাংলাদেশে এইচএমপিভি নিয়ে সচেতনতা কম থাকায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, অজানা ভাইরাসগুলো অবহেলা করা উচিত নয়। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এইচএমপিভি নিয়ে প্রস্তুতি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি, কারণ এটি ব্যাপক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এইচএমপিভি সংক্রমণ রোধে সরকারের করণীয় বিষয়গুলো পরিকল্পিত ও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং গবেষণার মাধ্যমে এই ভাইরাসের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আতঙ্কের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে জনগণকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাসের (এইচএমপিভি) একটি গঠনমূলক চিত্র
লেখক : ডক্টর শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল শিক্ষক ও গবেষক রিসার্চ সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যান্ড লোকাল ইনফেকসাস ডিজিজ ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন, ঐতা ইউনিভার্সিটি, জাপান
মন্তব্য করুন