শাহ মনসুর আলী নোমান
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

জ্ঞান-প্রজ্ঞার জ্যোতির্ময় প্রদীপ প্রফেসর শিবলী

প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী। সৌজন্য ছবি
প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী। সৌজন্য ছবি

আলোর বাতিঘর, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ। সারাজীবন তিনি শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তার অবদান কেবল প্রশংসার দাবিদার নয়, একটি অনুপ্রেরণা। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ সততা নির্বাসিত, শিষ্টাচার দুর্লভ। শিক্ষক সমাজের একটি অংশ দলীয় রাজনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। কিন্তু প্রফেসর আতফুল হাই শিবলী স্যার ছিলেন সেই দলীয় রাজনীতির অনেক ঊর্ধ্বে একজন মহান শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। আজীবন অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী মেধাবী শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ, জ্ঞানতাপস আতফুল হাই শিবলী সারাজীবন আলো বিলিয়ে দিয়েই গেছেন। তার মধ্যে পাওয়ার কোনো প্রত্যাশা ছিল না, ছিল না কোনো পদের প্রতি লোভ। সারাজীবন মানুষের কল্যাণে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। বহু মানুষের জীবন গড়ার কারিগর এবং অসংখ্য মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীবান্ধব এই মহান শিক্ষাবিদ সারাজীবন সমাজ দেশ, জাতি ও অন্যের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।

মানবতার মহান কল্যাণে যুগে যুগে পৃথিবীতে, দেশে দেশে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় যারা দেশ-কাল পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে নিজ অবস্থান স্থায়ী করে নিয়েছেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে, স্বীয় কর্মগুণে। মৃত্যুর পরও তাদের রেখে যাওয়া কর্ম, চিন্তা ও আদর্শ শুধু একটি জাতি বা দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি; বরং তা পৃথিবীর মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, উৎসাহ জুগিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল শাশ্বত আলোর মশালধারী ও জ্যোর্তিময় শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী স্যারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সালের এই দিনে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীনতম দীঘলবাক গ্রামের আলোকিত ও মেধাবী পরিবারের এক সূর্য সন্তান প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে ভারতের গৌহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ব্রিটিশ ভারতের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক প্রফেসর আব্দুল হাই ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সহিত শিক্ষকতা করেন এবং উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরবর্তীতে রাজশাহী ও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী আতফুল হাই শিবলী রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন (১৯৫৮ সালে) এবং রাজশাহী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৬০ সালে) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক সম্মান (বিএ অনার্স) এবং একই বিভাগ থেকে ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর (এমএ) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। উভয় পরীক্ষায় তিনি (স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (SOAS) থেকে ‘দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন (১৯৬৬-১৯৬৯)। তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন ১৯৮৩ সালে।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এই মহান শিক্ষাবিদ খুবই দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য হিসেবে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, উপ-উপাচার্য, ইতিহাস বিভাগ ও সামরিক বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) পরিচালক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন এবং শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশে-বিদেশে প্রচুর সুনাম ও সুখাতি অর্জন করেন।

ড. আতফুল হাই শিবলী ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার গবেষণাধর্মী জনপ্রিয় গ্রন্থ হলো ‘Abdul Matin Chaudhary of Asam (1895-1948) : Trusted lieutenant of Mohammad Ali Jinnah.’ এছাড়াও যুগ্মভাবে রচিত ‘বাংলাদেশ সাংবিধানিক ইতিহাস (১৭৭৩-১৯৭২)’ গ্রন্থটি ‘আইন ও বিচার’, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রফেসর ড. আতফুল হাই শিবলী রাজশাহীর হেরিটেজ আরকাইভসের একজন ট্রাস্টি ও ‘স্থানীয় ইতিহাস’ জার্নালের সম্পাদক ছিলেন।

তিনি বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য সভা, সেমিনার- ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। স্বল্পমেয়াদি ফেলোশিপে আমেরিকা ও ভারতে গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ইউজিসির সদস্য হিসেবে চীন, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, ব্যাংকক ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। তিনি ছিলেন মুক্তমনা এবং একজন প্রকৃত সাদা মনের মানুষ। দেশে শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈতনিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

শিক্ষাবিদ ড. আতফুল হাই শিবলী International Association of Historians of Asia-এর সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ড ম্যানেজমেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

শাহ মনসুর আলী নোমান : কলামিস্ট, গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসক

সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জবি শিক্ষার্থীদের অনশন, আট ঘণ্টা পেরোলেও খোঁজ নেয়নি প্রশাসন

স্পেন জাতীয় দল বয়কটের গুঞ্জন অস্বীকার করলেন পেদ্রি

খুলনায় ছাত্র আন্দোলনে হামলা, আওয়ামীপন্থি ৮ আইনজীবী কারাগারে

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরও বাড়ল

রমজান ও ঈদের সম্ভাব্য তারিখ জানাল আরব আমিরাত

আন্দোলনে গুলির ঘটনায় জড়িত পাবিপ্রবি কর্মকর্তার শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষের রুমে তালা

সরকারি সার-বীজ বিক্রির সময় ধরা খেলেন কৃষি কর্মকর্তা

রাষ্ট্র সংস্কারে খেলাফত আন্দোলনের ১৫ দফা প্রস্তাবনা 

১০

রামগড় স্থলবন্দর চালুর বিষয়ে কমিটি গঠন হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

১১

সিলেটের টানা ‍দ্বিতীয় জয়

১২

৪০ কোটি মানুষ আসবে এ মেলায়, প্রস্তুত ভারত

১৩

অল ব্রডকাস্টার্স কমিউনিটির ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত

১৪

ভারত থেকে এবার জাহাজে যা এলো

১৫

দেশে প্রথম এইচএমপিভি শনাক্ত

১৬

বিয়ে নিয়ে মুখ খুললেন পড়শী

১৭

ভবিষ্যতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষায় দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

১৮

পূর্বাচলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্লট বরাদ্দ / শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

১৯

ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

২০
X