জুলাই আগস্ট বিপ্লবের আহত সৈনিক আমি । দীর্ঘ ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের সাথে লড়াই করা এই আমার সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে বসলাম। কোন ঘটনা ছেড়ে কোন ঘটনা লিখব?পুরো পত্রিকা জুড়ে লিখলেও কি আমার কথা শেষ হবে? প্রিয় পাঠক, কেউ একদিনে বিপ্লবী হয় না, বঞ্চনা থেকে বিপ্লবীর জন্ম হয়। জুলাই- আগস্ট এ হাজার হাজার মানুষ বিপ্লবী হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে স্বৈরাচার সরকারের নানাবিধ নিপীড়নের ইতিহাস। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।
স্বপ্ন দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। ভাগ্য আমার সহায় হলো না। ২০০৩ সাল থেকে ছাত্রদলের মিছিল মিটিংয়ে শামিল হওয়ার কারণে অনার্স মাস্টার্স এর রেজাল্ট এ প্রথম হওয়ার পর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি হলো না। কারণ ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি ছিল ছাত্রলীগ করা। আমার বঞ্চনা প্রবঞ্চনা ও নিপীড়িত হওয়ার ইতিহাস সময়ের সাথে সাথে আরও বড় হতে থাকলো। একটা কলেজে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করি। জুনিয়র সকলের প্রমোশন হয়ে গেলেও বিএনপির সাথে
যুক্ততার অজুহাতে আমার প্রমোশন হয় না। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন তাই মেয়ের জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি গেলাম আমার শ্বশুর বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়াতে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘরোয়া পরিবেশে আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন উদযাপন করছিলাম। হঠাৎ দেখি বাসায় পুলিশ হাজির। শুনলাম আমার নামে দুমাস আগের মামলা রয়েছে। আমি থাকি ঢাকায়, আমার নামে রাজনৈতিক নাশকতার মামলা হয়েছে সাতক্ষীরায়। যেদিনের ঘটনার মামলা হয়েছে সেদিন আমি ঢাকায় আমার কর্মস্থলে পরীক্ষার হলে ডিউটিরত ছিলাম। অথচ বিনা অপরাধে আমার এক বছর বয়সী মেয়ের প্রথম জন্মদিন আমার সাথে কাটলো থানায় তারপর সাতক্ষীরা কারাগারে। মাঝখানে শুক্রবার শনিবার থাকার কারণে তিনদিন পর আমার জামিন হয়। জীবনের এই এক নতুন অভিজ্ঞতা। যাই হোক তিনদিন পর মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরলাম। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ায় কর্মস্থলে ফিরতে আর ইচ্ছে করলো না।
তিন মাস বেকার বসে থাকার পর রাজধানীর স্বনামধন্য রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে জয়েন করি। ভাগ্যিস এই কলেজের নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাব নেই অন্যথায় হয়তো এখানে ও জয়েন করতে পারতাম না। কিন্তু এখানেও স্বৈরাচারের অন্ধ ভক্ত সহকর্মীদের রোষানলে পড়েছি বহুবার। এরমধ্যে পাঁচটা রাজনৈতিক মামলার আসামি । আসলো ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। বিএনপির মহাসমাবেশে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমার বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই এর বিএনপি নেতাকর্মী দিয়ে আমার উত্তরার বাসা একেবারে ঠাসা। আবারো পড়লাম পুলিশের নজরদারিতে। ২৯ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত আর বাসায় থাকতে পারিনা। আমার শান্তি প্রিয় আত্মীয়-স্বজনরা বলেন "তোমার দরকার কি পলিটিক্স করার?" কিন্তু আমিতো সেই ছোটবেলা থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং কবি হেলাল হাফিজের ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার সময় তার।’ এই চরণ দ্বারা উজ্জীবিত। মানুষ মারার যুদ্ধ নয়, দেশ মাটি মানুষের কল্যাণে দেশের আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বুদ্ধি বৃত্তিক যুদ্ধ করতে চাই ।
এ যুদ্ধের সফলতা অর্জন জনপ্রতিনিধি হলেই সম্ভব। আর এই জন্যই আমি রাজনীতি করি। আমরা যারা দেশকে সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য পলিসি তৈরি করার মতো জ্ঞান রাখি তাদের অবশ্যই রাজনীতিতে আসা উচিত । আমরা যারা রাজনীতি করে অর্থ ইনকামের ধান্দা করি না তাদের অবশ্যই রাজনীতিতে আসা উচিত। আমার আত্মীয়স্বজনের জন্য আমার আরও একটি চমৎকার উত্তর রয়েছে। আমার মত মানুষ জন প্রতিনিধি হলে আমার এলাকা একজন দুর্নীতিবাজ জন প্রতিনিধির হাত থেকে রক্ষা পাবে। আমার এলাকার জন্য সরকারি ভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ আমার এলাকাতেই ব্যয় হবে। আমি রাজনীতি করি বলেই বিপদে আপদে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারি।
এতো ভাবে বোঝানোর পরও আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়স্বজন আমাকে নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তাতেই থাকে। উত্তাল জুলাই দুহাজার চব্বিশে তাদের উদ্বিগ্নতা আরও বেড়ে গেল। আমাকে আমার কার্যক্রম থেকে সরাতে পারলেন না তাঁরা। ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট প্রতিদিন দুপুর একটা পর্যন্ত রাজউক কলেজে আমার প্রফেশনাল কাজ শেষ করে তারপর সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রাজপথে মিছিলে মিটিংয়ে আমার সময় কাটে। মাঝে দুই দিন ক্লাস না থাকাতে কলেজে উপস্থিতির সাইন করে বের হয়ে সোজা মিছিলে। আমার ১৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনের কেবল এই দুই দিন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে বের হয়েছিলাম। কলেজের সিনিয়র জুনিয়র কলিগরা আমাকে সতর্ক করতে লাগলেন। ‘ম্যাডাম, সরকার পতনের আন্দোলনে থাকলে আপনার কিন্তু চাকরি থাকবে না’ আমি চাকরির মায়া করলাম না।
আমার বড় সন্তান রাজউক কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র। আমার আর তার বাবার রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত হাওয়া খুব নিবিড় ভাবে দেখার কারণে সেও ধীরে ধীরে বিপ্লবী হয়ে উঠেছে। যে করেই হোক স্বৈরাচারীর পতন ঘটাতেই হবে। তাই ১৫ জুলাই থেকে ৫ ই আগস্ট পর্যন্ত আমরা পুরো পরিবার রাজপথে। আমার ১২ বছরের মেয়ে প্রতিদিন তার বাবা এবং আমার হাতে একটা করে প্লে কার্ড লিখে দিতো ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি।’ ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই এখন যাবি’ ইত্যাদি লিখে। প্রতিদিন মিছিলে যাওয়ার সময় বাসার কাজের সহকারীদের বলে যেতাম ‘আর যদি জীবিত ফিরে না আসি মাফ করে দিও।’
১৯ জুলাই ২০২৪ , শত শত নেতাকর্মী নিয়ে উত্তরা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের সামনে আমার পুরো পরিবার মিছিলে। হঠাৎ পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি। আমার পাশেই দাড়িয়ে থাকা বিএনপির কর্মী জুবায়ের ভাই এক গুলিতেই পড়ে গেলেন রাস্তায় । গুলি পিঠ ভেদ করে বুক দিয়ে বের হয়ে গেলো। সাথে সাথেই রাস্তায় পড়ে মুহূর্তের মধ্যে নিহত হলেন তিনি । ঠিক ৪০ -৫০ হাত সামনে আরো একজন নিহত হলেন । পুলিশ ভ্যানে লাশ উঠিয়ে নেওয়ার কারণে তার পরিচয় জানতে পারলাম না।
আমি সহ আরো শতশত মানুষ তখন ঐ রোড়েই আহত হলাম । কুয়েত মৈত্রী হসপিটালের সামনে আমরা অবস্থান নিলাম। কিছুক্ষণ পরপর হসপিটালে লাস আসতে থাকলো। ওহ্! কি যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য!! এক পর্যায়ে হসপিটালে জায়গা হচ্ছিল না । কুয়েত মৈত্রী হসপিটালের ঠিক অপজিটে শেল্টার গ্লোবাল স্কুল এন্ড কলেজের অবস্থান । মানবিক মানুষ প্রিন্সিপাল প্রফেসর আব্দুল্লাহ্ আল মামুন স্যার তার প্রতিষ্ঠানকে বানিয়ে দিলেন মেডিকেল ক্যাম্প। আহতের সংখ্যা এত বেশি যে এখানেও জায়গা হচ্ছিল না। পর্যাপ্ত ডাক্তারও নেই। নিজেরাই হয়ে গেলাম নিজেদের প্রাথমিক চিকিৎসক। চারদিকে কেবল রক্ত আর রক্ত। লাশ দেখার খেলায় মেতে উঠেছিল স্বৈরাচার সরকার।
আহত হয়ে তিনদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম আমি। তখনো বিছানায় শুয়ে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব আমি। ভাই বোনেরা বারবার সতর্ক করতে থাকলো ‘মোবাইলে যত ভিডিও, ছবি আছে সব ডিলিট করে দাও।’ আমি করলাম না। একটা জেদ চাপলো মনে। স্বৈরাচার পতনের যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। বারবার বিএনপির অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান জননেতা তারেক রহমানের ওই কথাটা মনে আসছিল ‘নেতৃত্ব দিন, নেতৃত্ব নিন।’ আমার স্বামী প্রফেসর আব্দুল্লাহ আল মামুন কে বললাম ‘তুমি বিএনএস সেন্টার থেকে ইংলিশে স্পিচ দাও। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক। বহির্বিশ্বের চাপে হাসিনা পদত্যাগ করবে।’ তিনি তাই করলেন। এরপর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন ইংলিশে স্পিস দিতে থাকলেন । একদিন রাত্রে আমাকে বললেন ‘আমরা যা করছি, হাসিনার পতন না হলে আমাদের জায়গা হবে আয়না ঘরে না হয় মাটির তলে।’
ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের সংগ্রাম দেখে বড় হতে থাকা আমার ছেলে বলল ‘বাবা আমরা সফল হবোই’। তার কিছুক্ষণ পর টিভিতে দেখলাম নাহিদ আসিফদের সাথে ডিবি অফিসের সমঝোতা হয়ে গেছে। মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না। নেতাকর্মী সবাইকে বললাম এক দফা সফল না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকবোই। আমরা মাঠে ছিলাম। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে ৫ আগস্ট আমরা ঘরে ফিরেছি। আলহামদুলিল্লাহ্।
তবে এখনো আমাদের আসল যুদ্ধ বাকি রয়ে গেছে। দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের যুদ্ধ। নির্বাচিত সরকার যত তাড়াতাড়ি আসবে ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের যুদ্ধে তত তাড়াতাড়িই সফল হবো ইনশাআল্লাহ্।
অধ্যাপিকা শামীমা ইয়াসমিন মিথিলা : মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক ফোরাম
মন্তব্য করুন