বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর যে কয়েকটি বিষয় অলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে তার ভেতর ‘সংস্কার’ খুব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারের উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে, যার অন্যতম একটি হলো ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’। গঠনের পর থেকেই এই কমিশনটি ছিল অন্যান্য কমিশনের তুলনায় বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করবে এমনটাই আশা করা যাচ্ছে।
এই কমিশন গঠনের পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার তথা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই আলোচনা আরও সরব হয় যখন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুপারিশের নামে উপসচিব নিয়োগের পূর্ব থেকে বিদ্যমান বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার এবং অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের নির্ধারিত অনুপাত ৭৫:২৫ এর পরিবর্তে ৫০:৫০ করার আলোচনা হয় এবং কমিশন কর্তৃক সুপারিশ করা হচ্ছে মর্মে প্রচারণা পায়। পুরো দেশের সবচেয়ে সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত বিসিএস ক্যাডার অফিসারগণ যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করেছে। যদিও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনার দ্বারা উপসচিব নিয়োগের বিষয়টি বহু আগেই নিষ্পত্তিকৃত ছিল।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে যেসব বিষয় দেখা যার, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘অভিন্ন ও সম্মিলিত মেধাতালিকা’। আর অভিন্ন সম্মিলিত মেধাতালিকার পূর্বশর্ত হলো ‘অভিন্ন পরীক্ষা’। অর্থাৎ সকল বিষয়ে অভিন্ন পরীক্ষা দিতে হবে এবং সকল পরীক্ষার পর একটি অভিন্ন রেজাল্ট হবে, যে রেজাল্টই সম্মিলিত মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ সকলের মেধাস্থান নির্ধারণ করে দেবে। যে কয়েকজন অফিসারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ থেকে এই নির্দেশনাটি এসেছিল তারা সবাই প্রকৃতপক্ষেই অভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে একটি মেধাতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ তারা এই শর্তপূরণ করে আদালতের নিকট খুব সহজে নিজের অবস্থান উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন।
এখন আসি মূল আলোচনায়, বিসিএস বিভিন্ন সার্কুলার পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুই রকম বিসিএস সার্কুলার হয়,
১. বিসিএস
২. বিশেষ বিসিএস
১. বিসিএস: (যেখানে জেনারেল ক্যাডার এবং টেকনিক্যাল ক্যাডার এর শূন্যপদের সংখ্যা উল্লেখ থাকে) জেনারেল ক্যাডারের শূন্যপদ থাকায় নির্দিষ্ট বয়সসীমা ও অন্যান্য যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে সকল ডিসিপ্লিনের গ্রাজুয়েটগণ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ এই ক্যাডারগুলোর পদসমূহ সবার জন্য উন্মুক্ত।
২. বিশেষ বিসিএস: (যেখানে মূলত বিশেষ সেক্টরে যখন উক্ত সেক্টর সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করা এবং দক্ষ কিছু সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট জরুরি ভিত্তিতে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট নিয়োগের উদ্দেশ্যে এ ধরনের বিসিএস এর আয়োজন করা হয়ে থাকে)। এ ধরনের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় শুধু উক্ত বিষয়ে সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষ বিষয়ে পড়াশোনা করা গ্র্যাজুয়েটদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। সকল বিষয়ের গ্র্যাজুয়েটরা এ ধরনের বিশেষ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান না। আর যেহেতু তারা যে বিশেষ কাজটির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন সে বিষয় নিয়ে ৪-৫ বছর পড়াশোনা করে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাই তাদের আর এ সংক্রান্ত লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় না। শুধু ১০০/২০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়ে ভাইভা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের একটি বিশেষ সুবিধা হয়, আর সেটা হলো দেশের সকল সাবজেক্টের গ্রাজুয়েটগণের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় না, শুধু নিজের সাবজেক্টের কিছুসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ফলাফল এখানে কম প্রতিযোগিতা করে সহজে ‘সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। একই সঙ্গে তাদের বিশেষ বিষয়ে দক্ষতাকে মূল্যায়ন করে একটি অথবা দুটি ইনক্রিমেন্টসহ বেতন স্কেল শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ ১২তম বিশেষ বিসিএস, ১৪তম বিশেষ বিসিএস, ১৬তম বিশেষ বিসিএস, ১৯তম বিশেষ বিসিএস, ২৬তম বিশেষ বিসিএস, ৩২তম বিশেষ বিসিএস, ৩৯তম বিশেষ বিসিএস এবং ৪২তম বিশেষ বিসিএস।
আমি আবারও বলছি, এই পরীক্ষাগুলো মূল বিসিএস নয়; এগুলো ‘বিশেষ বিসিএস’। ‘বিসিএস’ আর ‘বিশেষ বিসিএস’ কখনও এক নয়। তাই রেগুলার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেকোন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তগণই শুধু লিখতে পারেন ‘বিসিএস (.....) ক্যাডার’ সেটা জেনারেল বা টেকনিক্যাল যে ক্যাডারই হোক না কেন। আর ‘বিশেষ বিসিএস’ এর সহজতর পরীক্ষার মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্তগণ লেখার কথা বিশেষ বিসিএস (.....) ক্যাডার। যদিও এসব সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্টের ‘বিশেষ’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘বিসিএস’ কথাটা বলতে বা লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এখন আসি মূল বিসিএস এর আলোচনায়; মূল বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে দুই ধরনের ক্যাডার অফিসার নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
(১) জেনারেল ক্যাডার (যেখানে সকল বিষয়ের গ্র্যাজুয়েটগণ অংশগ্রহণের সুযোগ পান) এবং
(২) টেকনিক্যাল ক্যাডার (বিশেষ সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েটগণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান)
সকলের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা একই প্রশ্নে নেওয়া হয়। এই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর শুধু মূল পরীক্ষা তথা লিখিত পরীক্ষার্থী নির্বাচনের কাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু চূড়ান্ত সুপারিশের ক্ষেত্রে এই নম্বর যোগ করা হয় না।
যেসব প্রার্থী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন শুধু তারাই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এখানে উল্লেখ্য,আবেদন দাখিলের সময় আবেদনকারী শুধু জেনারেল ক্যাডার বা শুধু টেকনিক্যাল ক্যাডার (সংশ্লিষ্ট বিসিএস সার্কুলার অনুযায়ী যাদের সাবজেক্ট টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য বিবেচ্য) বা উভয় ক্যাডারের জন্য (যাদের সুযোগ থাকে) পছন্দক্রম দেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। বিসিএসের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেধাক্রমের সঙ্গে এই পছন্দক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেউ উভয় ক্যাডারে আবেদন করার পর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তিনি জেনারেল ক্যাডার এবং টেকনিক্যাল ক্যাডার অর্থাৎ উভয় ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯টি বিষয়ে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষার পাশাপাশি নিজের সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। ফলে তার টেকনিক্যাল সাবজেক্টে পড়াশোনা করার কারণে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কোনো কারণে উনি জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও নিজের সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান। কেউ কেউ জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯টি বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজ সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উভয় ক্যাডারে ভাইভা দেওয়ার সুযোগ পান।
এরপর ভাইভা শেষ হলে চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। দুটি মেধাতালিকা হয় :
১. যেসব প্রার্থী শুধু জেনারেল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে এবং যারা উভয় ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯০০ নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৫০% অর্থাৎ ৪৫০ নম্বর এবং ভাইভাতে ৪০% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয় তাদের সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রস্তুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ২০০ নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় আসে না।
২.যারা উভয় ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জেনারেল ক্যাডারের নির্ধারিত ২০০ নম্বর বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে টেকনিক্যাল বিষয়ে অর্থাৎ নিজ সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের ভেতর প্রাপ্ত নম্বরসহ উত্তীর্ণ এবং যারা শুধু টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তাদের সাবজেক্টিভ মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন সাবজেক্টভিত্তিক হওয়ায় তাদের সম্মিলিত মেধাতালিকা করার সুযোগ থাকে না।
এই দুটি মেধাতালিকার প্রথমটি থেকে সম্মিলিত মেধাস্থান এবং প্রার্থীর ক্যাডার পছন্দক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত হয় তিনি কোন জেনারেল ক্যাডারে (পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, অডিট, ট্যাক্স, খাদ্য, ডাক, তথ্য, সমবায় ইত্যাদি) সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন, নাকি কোন ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন না।
আর দ্বিতীয় মেধা তালিকা অর্থাৎ সাবজেক্টিভ মেধাতালিকা থেকে নির্ধারিত হয় তিনি আসলে তার সাবজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে সুনির্দিষ্ট পদ বা পদসমূহের কোনটিতে সুপারিশ প্রাপ্ত হবেন, নাকি হবেন না। পদসমূহ বললাম এ জন্য যে, অনেক সময় দেখা যায় সাবজেক্ট একটি কিন্তু একাধিক টেকনিক্যাল ক্যাডারের শর্ত পূরণ করে। যেমন কেউ যদি কৃষি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন তাহলে তিনি বিসিএস (কৃষি) অর্থাৎ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জন্য যেমন বিবেচনায় আসতে পারেন, আবার বিসিএস (কৃষি) মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জন্যও বিবেচনায় আসতে পারেন, বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারের পাশাপাশি তিনি বিসিএস (শিক্ষা) কৃষি শিক্ষা এর জন্যও বিবেচনায় আসতে পারেন।
কেউ কেউ আছেন উভয় মেধাতালিকায় থেকে উভয় জায়গায় ক্যাডার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। তাদের ক্ষেত্রে উক্ত প্রার্থীর বিসিএস পরীক্ষার আবেদনের সময় দাখিলকৃত ক্যাডার পছন্দক্রম বিবেচনায় আসবে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেই, ধরুন জনাব মুমিনুল ইসলাম জেনারেল ক্যাডারের জন্য সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৬৪৩৫ জনের মধ্যে ৭৯২তম হয়েছেন এবং নিজ সাবজেক্ট কৃষি বিষয়ে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন সে সাবজেক্টিভ মেধাতালিকায় ৩৪২ জনের মধ্যে ১৭তম হয়েছেন। এরপর দেখা হবে উনি আসলে মেধাক্রম অনুযায়ী উনার চয়েস লিস্টের সর্বোচ্চ উপরের কোন ক্যাডারটির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেন। দেখা গেল জনাব মুমিনুল ইসলাম সম্মিলিত মেধায় কোনো জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হতে পারছেন না। কিন্তু চয়েস লিস্টে ১৩নম্বরে থাকা বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হতে পারেন। এখন এই কৃষি ক্যাডারে তার মেধাক্রম নির্ধারিত হবে সাবজেক্টিভ মেধায় ১-১৬ পর্যন্ত যারা আছেন অর্থাৎ উনার থেকে যে ১৬ জন অধিক নম্বর পেয়েছেন তাদের প্রকৃতপক্ষে কতোজন প্রকৃতপক্ষে বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হচ্ছেন তার উপর। ধরুন, এই ১৬ জন প্রার্থীর ৫ জনই জেনারেল কোনো না কোনো ক্যাডারে সম্মিলিত মেধাতালিকায় থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এমতাবস্থায়, জনাব মমিনুল ইসলামের সাবজেক্টিভ টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেধাস্থান আসবে ১২তম। আবার এমনও হতে পারতো জনাব মোমিন সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৬৪৩৫ জনের মধ্যে ১৫তম হয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডার পাওয়ার যোগ্যও হয়েছিলেন কিন্তু চয়েস লিস্টে প্রথম পছন্দ বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার থাকার কারণে উনি কৃষি ক্যাডারেই বিবেচিত হবেন তবে এমন ঘটনা খুব কদাচিৎ ঘটে।
এই আলোচনা থেকে একটি বিষয় আমরা স্পষ্ট হলাম, দুই ধরনের ক্যাডারের পরীক্ষা এক নয় এবং অভিন্ন মেধাতালিকাও প্রস্তুত করার সুযোগ নেই। এর কারণ লিখিত পরীক্ষার কিছু কিছু বিষয় আলাদা। অভিন্ন মেধাতালিকা শুধু যারা জেনারেল ক্যাডারের সকল বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে সকল স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয় এবং শুধু তাদের ক্ষেত্রেই সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রস্তুত করা হয়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালত এর নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রথমত, যারা বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে বিশেষ কাজের জন্য নিয়োজিত হয়েছেন, তারা কোনো অবস্থাতেই ডিএস পুলে আসার বিন্দুমাত্র আইনগত সুযোগ রাখেন না। কারণ, উনারা ‘বিসিএস’ পরীক্ষা দেননি। যেটা দিয়েছেন সেটা ‘বিশেষ বিসিএস’ নামক এমসিকিউ পরীক্ষা, যা কোনো অবস্থাতেই বিসিএস পরীক্ষার সমতুল্য নয়। একই সঙ্গে উনাদের নামের সঙ্গে ক্যাডার লিখলেও লেখা উচিত ‘বিশেষ বিসিএস (....) ক্যাডার’ কোনো অবস্থাতেই ‘বিসিএস (....) ক্যাডার’ লেখা উচিত নয় এবং আইনসিদ্ধও নয়।
দ্বিতীয়ত, যারা মূল বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি বা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেননি ফলে সম্মিলিত মেধাতালিকায় নিজের কোনো অবস্থান নেই তারাও ডিএস পুলের মাধ্যমে উপসচিব হওয়ার সুযোগ নেই। কারন ডিএস পুলে আসার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মূল শর্ত হলো, ‘অভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে আপনাকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় থাকতে হবে’। মূলকথা হলো, যদি মাননীয় আদালতের নির্দেশনাকে অনুসরণ করা হয়, তাহলে ‘বিশেষ বিসিএস’ নামক সহজ পথে যারা ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন তাদের কোনো অবস্থাতেই বিশেষ কাজের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, আর উপসচিব পুলে আসার তো প্রশ্নই আসে না। আর যারা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু জেনারেল যেকোনো একটি ক্যাডরেও সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেননি ফলে নিজ সাবজেক্টের পরীক্ষার মাধ্যমে সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও ডিএস পুলের মাধ্যমে উপসচিব হওয়ার সুযোগ থাকে না। অন্তত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তাই বলে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু মূল বিসিএস পরীক্ষার জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯০০ নম্বরের পরীক্ষায় এবং ভাইভার পর চূড়ান্ত ফলাফলে যারা মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন এবং যে কোনো একটি জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শুধু তারাই ডিএস পুলের মাধ্যমে উপসচিব হওয়ার ২৫% সুযোগ এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য বিবেচিত হতে পারেন। এই বিষয়টি মহামান্য আদালতের নির্দেশনাতে স্পষ্ট করা আছে কিন্তু কোনো ক্যাডার (জেনারেল ক্যাডার) যদি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ হয় সেক্ষেত্রে ২৫% থেকে উক্ত ক্যাডারের জন্য বরাদ্দকৃত ডিএস পুলের পদ বিসিএস (প্রশাসন)-এর সঙ্গে যুক্ত হবে কি না সে সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা স্পষ্ট করা নেই। উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনার পর বিসিএস (ইকোনমিক) নামক জেনারেল ক্যাডারটি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ হয়েছে তাই বিসিএস (ইকোনমিক) ক্যাডার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ হওয়ার পর ২% হলেও ২৫% থেকে হ্রাস পাওয়ায় কথা ছিল। কিন্তু সেটা মাননীয় আদালতের নির্দেশনা ব্যতীত করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।
তাই, এ বিষয়েও আদালতের নিকট সুস্পষ্টকরণের আবেদন করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই মূল বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি অথবা জেনারেল ক্যাডারের উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে নিতে পারেননি এমন কাউকে ডিএস পুলের মাধ্যমে উপসচিব করা যথাযথ হতে পারে না। বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অসতর্কতাবশত বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে উপসচিব হওয়া সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্টগণের বিষয়ে এবং বিসিএসের মাধ্যমে টেকনিক্যাল ক্যাডারের সুপারিশপ্রাপ্ত ইতোমধ্যে ডিএস পুলের মাধ্যমে ‘উপসচিব’ হওয়া অফিসারগণের বিষয়ে করণীয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কেই নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, এই পদসমূহ মূল বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত অন্যান্য জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত অফিসারদের জন্য উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ছিল।
লেখক- কৃষিবিদ মুহম্মদ শামীম কিবরিয়া, সিনিয়র সহকারী সচিব, ৩০তম বিসিএস (প্রশাসন)।
মন্তব্য করুন