আহসান কামরুল
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৭ এএম
অনলাইন সংস্করণ

গণমাধ্যমের কেমন সংস্কার চাই

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পলায়নের পরপরই দেশের গণমাধ্যমের ওপর নজিরবিহীন হামলা হয়েছে। এটি ছিল গণমাধ্যমের ওপর জনতার চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। গণমাধ্যমকে এমন টার্গেট করা ঠিক হয়েছে কিনা, সেটি ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু গণমাধ্যম কেন এমন টার্গেট হলো? স্বৈরাচারের ১৫ বছরে মিডিয়া কি কখনও গণমাধ্যম হওয়ার চেষ্টা করেছে? নাকি শুধু সংবাদমাধ্যম হিসেবেই ক্ষমতাসীনদের ফুট-ফরমায়েশ খেটেছে? বড় দাগে বলতে গেলে দু’চারটি মিডিয়া হাউজ ব্যতীত অন্য কেউই গণমাধ্যম হওয়ার ন্যূনতম চেষ্টা করেনি। এরা বরং নিজে থেকে যেচে গিয়ে ফুট-ফরমায়েশ খেটে গৌরববোধ করেছে। এ কারণে তারা গণমানুষ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষে রূপ নেওয়ার কারণেই শেখ হাসিনার পলায়নের পর ওই ক্ষোভ গিয়ে উগড়ে পড়েছে মিডিয়া হাউজগুলোর ওপর। বিক্ষুব্ধ জনতা একের পর এক ভেঙেছে গণমাধ্যমের কার্যালয়। এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসের জন্যও একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

একইসাথে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের জন্যও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে যে, ভবিষ্যতে তারা গণমাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতা করবে নাকি ফুট-ফরমায়েশি করে আবারও কোনো পালাবদলে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে।

শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তবর্তী সরকার গঠন হলে দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। গণআন্দোলনের সময়ও এটি ছিল আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি ও কমিটমেন্ট। এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন হয়েছে, যার মধ্যে ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ অন্যতম। জুলাই গণআন্দোলনে মিডিয়ার যে ভূমিকা ছিল তা অবশ্যই নিন্দনীয়। ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনকারীদেরকে তৎকালীন সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ‘দুর্বৃত্ত, নাশকতাকারী’ ইত্যাদি বলেছিল বেশিরভাগ গণমাধ্যম।

শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানের নির্দেশনা অনুযায়ী মিডিয়া এসব কাজ করেছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল। এক্ষেত্রে বাধ্য হওয়ার ঘটনা খুবই কম। গণভবন থেকে নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথেই বেশিরভাগ মিডিয়া সেই অনুযায়ী ‘হুক্কাহুয়া’ বলতে শুরু করেছিল। গণভবন থেকে পাঠানো নির্দেশনা যেন ছিল মিডিয়ার প্রতি লজ্জাবতীর ছোঁয়া, স্পর্শের সাথে সাথেই তারা গুটিসুটি হয়ে চুপসে গিয়েছিল। অথচ এটি মিডিয়ার চরিত্রের সাথে যায় না। সাংবাদিকদের হওয়া উচিৎ সাহসী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী।

যেমনটা কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় সেসময় (৩১ জুলাই ২০২৪) বলেছিলাম: ‘‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত!’’

মিডিয়া কেন লজ্জাবতীর মতো চুপসে গিয়েছিল

জুলাই গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে, সামাল দেওয়ার পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সেসময় পর্যন্তও মিডিয়া সব পক্ষের খবরাখবর পরিবেশন করছিল। ইন্টারনেট বন্ধের পর মিডিয়ার প্রতি নির্দেশনা জারি করেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বেশ কয়েকটি মুঠোফোন মেসেজে তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নিউজ প্রচার করতে নিষেধ করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে বলেন তিনি। এরপর থেকেই পাল্টে যায় সংবাদমাধ্যমের চরিত্র। খবরে আরোপ হয় সেন্সরশিপ। সব টেলিভিশন যেন হয়ে যায় বিটিভি।

সরকার কীভাবে সফলতার সাথে আন্দোলন দমন করছে সেটি প্রচার করাই যেন হয়ে উঠে টেলিভিশনগুলোর খবরের মূল বিষয়বস্তু। সেসময় অবশ্য গুটিকয়েক পত্রিকা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের প্রেস সচিবের প্রেসক্রিপশন উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা নিহতের খবরাখবর প্রকাশ করতে থাকে। এছাড়া মানবিক কিছু প্রতিবেদনও প্রকাশ করে তারা। এর ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবশ্য সেসব মনে রাখা হয়নি।

গণমাধ্যমে কেমন সংস্কার প্রয়োজন

দেশে ৯০ পরবর্তী সময়ে কর্পোরেট সংবাদধ্যম পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম তার চরিত্র হারিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমে রূপ নেয়। তবে কর্পোরেট মালিকানায় গেলেও সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বরং খারাপ সাংবাদিকতার চূড়ান্ত নজির আমরা দেখেছি।

গত ৩ দশকে সাংবাদিকতা ডালপালা মেলে অনেকটা মহীরুহ হলেও নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারসহ মানের দিক থেকে সবকিছুই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সেই গণবিচ্ছিন্নতার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ করে গণমাধ্যমকে প্রকৃত গণমাধ্যমে রূপান্তর করতে নিম্নোক্ত সংস্কার জরুরি।

১. নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার: গণমাধ্যম এমন একটা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে যে, এখানে নিয়োগ সংক্রান্ত তেমন কোনো নীতিমালা নেই। কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো একক নীতিমালা অনুসরণ করে না। এখানে স্বচ্ছতাও নেই। এর ফলে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছাড়াই পান দোকানদার থেকে কাঠ ব্যবসায়ী, জেলে, মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা ক্ষেত্রের দাগী অপরাধীরাও সাংবাদিকতায় ঢুকে যাচ্ছে। ফলাফল স্বরুপ ছড়িয়ে পড়ছে চাটুকারিতা ও অপসাংবাদিকতা।

সাংবাদিকতাকে সঠিক পথে রাখতে হলে নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। অন্যদিকে অনেক মিডিয়া হাউজ রয়েছে যারা সাংবাদিকদেরকে নিয়োগপত্র দেয় না। অপেশাদার এমন আচরণ বন্ধ করে বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়া অনেক জায়গায় অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। পেশাদারিত্বের বদলে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নিতে হবে।

শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা

দেশে অপসাংবাদিকতায় বেশিরভাগই করে থাকেন যাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত এবং পারিপার্শ্বিক যোগ্যতা নেই। প্রেস কাউন্সিলসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কথা বলেন। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টিকে তারা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন।

অপসাংবাদিকতা রুখতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।

চাকরির নিশ্চয়তা

পেশাদার সাংবাদিকতায় যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগেরই চাকরি নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক থাকেন। কখন যেন আকস্মিক নোটিশে চাকরিহারা হতে হয়।

সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া যেন ছেলের হাতের মোয়া। এমনও অনেকসময় হয় যে, রাতে কাজ করে গিয়ে সকালে শুনতে পান যে তার চাকরি নেই!

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। কোন সাংবাদিককে হুটহাট নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। কোনো কারণে যদি চাকরি যায়ও, সেটাও যেন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় হয়। এতে সাংবাদিকতা অপেশাদারিত্ব থেকে রক্ষা পাবে।

২. বেতন সংক্রান্ত সংস্কার: বিগত কয়েক দশকে সাংবাদিকতা পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হলেও এর সুফল পায়নি পেশাদার সাংবাদিকরা। এখনকার বাজারেও ১০-১৫ হাজার টাকা বেতনে গ্র্যাজুয়েট কর্মী খোঁজেন মিডিয়ার কর্তারা! অনেক জায়গায় আবার সেও নেই। বেতন-ভাতা দেওয়া হবে বলে নিয়োগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয় না। দিলেও সেটি হয় অনিয়মিত। যে কারণে অনেক সংবাদকর্মী অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাংবাদিকতা পেশার ওপর। এজন্য নিয়মিত বেতন দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নিয়মিত বেতন দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলে মিডিয়া হাউজ থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য গ্রুপ অব কোম্পানির অন্যান্য খাতে বেতন-ভাতায় সমস্যা না হলেও মিডিয়ার ক্ষেত্রে ‘দারিদ্রতার চরম রূপ’ পরিলক্ষিত হয়।

ওয়েজবোর্ড সংশোধন

প্রিন্ট মাধ্যমে ওয়েজবোর্ডের বিষয় থাকলেও টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমে তারও বালাই নেই। সেজন্য কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের মনমতো অন্যায্য বেতন নির্ধারণ করেন। প্রিন্টে ওয়েজবোর্ড থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। কিছু কিছু জায়গায় মানা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা নেয় পত্রিকাগুলো।

এছাড়া ওয়েজবোর্ড সংশোধন করে টেলিভিশন এবং অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ওয়েজবোর্ড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি ওয়েজবোর্ড বাতিল করে ন্যূনতম বেতনের সিস্টেম চালু করার কথা বলেছেন। সেটিও আলোচনা সাপেক্ষে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ ও কঠোর বাস্তবায়ন হতে হবে। নাহলে আইন বা নিয়ম করে শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

৩) পেশাদারিত্ব সংক্রান্ত সংস্কার: জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় আমরা সংবাদমাধ্যমকে লজ্জাবতীর মতো চুপসে যেতে দেখেছি। সেটাও তবু একধরনের অসহায়ত্ব বলে মানা যায়। তবে বেশকিছু সংবাদমাধ্যম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছিল। পেশাদারিত্বের ন্যূনতম বালাই ছিল না তাদের। জনগণের প্রতিও ছিল না কমিটমেন্ট।

স্বউদ্যোগে ওসব মিডিয়া সরকারের পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে দিনের পর দিন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে এভাবেই পেশাদারিত্বের মুণ্ডুপাত করে গিয়েছে কথিত কিছু মিডিয়া। এই সংবাদমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের গুজব সেল সিআরআই এর প্রোপাগাণ্ডা মেশিন। বিরোধী নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল প্রচার, চরিত্র হনন থেকে শুরু করে নীতি-নৈতিকতার বলাৎকারসহ এমন কিছু নেই, যা কথিত সেই সংবাদমাধ্যমগুলো করেনি। এমন যাতে আর কখনও কেউ করতে না পারে, সেজন্য লাগাম টেনে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে অপেশাদার আচরণ করে এমন কাউকে সংবাদমাধ্যমে রাখা যাবে না। অন্যদিকে মালিকপক্ষও নানা সুবিধা পেতে নিউজরুমের কাছে অন্যায় আবদার করে থাকেন। অপেশাদার আচরণ করে তারা যাতে পার না পান, তার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এজন্য সংবাদমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকসহ সবার দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে। এখানে যে যেই মতেরই হোক না কেন, শতভাগ পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে।

এছাড়া সরকারও যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাইবার আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা জরুরি।

প্রেস কাউন্সিল শক্তিশালীকরণ

পেশাদার সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নানাভাবে হয়রানি ও মামলা-হামলার শিকার হন। সেজন্য প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। থানা বা কোর্টে নয়, সংবাদ সংক্রান্ত সব মামলা প্রেস কাউন্সিলে করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের অনুমতি বা অবগতি ব্যতীত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ সংক্রান্ত মামলা করতে না দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে কোনো ধরনের হুমকি দেওয়া বা হামলা করা হলে কঠোরভাবে প্রতিহত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

৪) নিবন্ধন সংক্রান্ত সংস্কার: দেশে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া এখনও যেন সেই ব্রিটিশ আমলে পড়ে রয়েছে। কেউ যদি যথাযথভাবে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনভিত্তিক করা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসেও মান্ধাতার আমলের মতো এ অফিস সে অফিস করে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেওয়া যৌক্তিক বিষয় নয়।

এছাড়া নিবন্ধন পেতে হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সংবাদমাধ্যমের অবমূল্যায়ন ও হয়রানি বন্ধ করে যেকোন এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন সংক্রান্ত বিশেষ সেল রাখা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নিবন্ধনসহ সবকিছু বিশেষ সেলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা করবেন। একইসাথে কালো টাকার মালিক, অসাধু ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাফিয়া চক্রসহ অপেশাদার কাউকে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়া যাবে না। পেশাদারিত্বের বদলে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ কায়েমের চেষ্টা বন্ধ করতে হলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হবে।

স্বৈরাচারের আগে-পরে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, কোনো রিপোর্ট সরকারের পছন্দ না হলে সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। টেলিভিশন-পত্রিকার জন্য বিষয়টি কিছুটা জটিল হলেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে খুবই সহজ। বিটিআরসি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ না হলেও এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বহু অনলাইন মিডিয়া বন্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ৫৪টি অনলাইন বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি।

আইন না মানলে নিবন্ধন স্থগিত ব্যতীত অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ কোনো মিডিয়াই যেন সরকার বন্ধ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরপরও সরকার কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করলে সরকারকে অন্তত ৬ মাস ওই মিডিয়ার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বহন করতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো করেই সরকার যেন নিবন্ধন ইস্যু বা অন্য কোনভাবেই মিডিয়ার ওপর কোন ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা খবরদারি করতে না পারে সংস্কারের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫) বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সংস্কার: চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণ করে থাকে। এখানে অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেসব পত্রিকা দৈনিক ৫০০ কপিও ছাপা হয় না, সেসব পত্রিকা লাখ লাখ কপি ছাপানোর ভুয়া তথ্য দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে বেশি বিজ্ঞাপন রেট নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

অর্থের বিনিময়ে রেট আপ-ডাউন করানো বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া ৯০০ টাকা রেট দিয়ে এখনকার সময়ে কতটুকু টিকে থাকা যায় সেটিও বিবেচ্য বিষয়। এখনকার মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় রেট আরও অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়ানো যায় কিনা সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে। একই কথা রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। সেসব মিডিয়ার জন্যও বিজ্ঞাপন নীতিমালা করা সময়ের দাবি।

এছাড়া সামগ্রিক মিডিয়াকে শিল্প ঘোষণা করে এই শিল্পের বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সরকারের পছন্দমতো সংবাদ না করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হুমকি দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। সংবাদের কারণে কোনো গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। এটি প্রমাণ হলে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি বা যে পদেই থাকুক না কেন পদচ্যুত করার বিধান থাকতে হবে।

৬) মিডিয়া সিটি তৈরি: বাংলাদেশে মিডিয়া হাউজগুলো পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এটি কোনো আদর্শ পন্থা নয়। সেক্ষেত্রে মিডিয়া সিটি তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে স্বল্পমূল্যে একই ভবনে একাধিক মিডিয়া হাউজের অফিস থাকবে। এটা উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হতে পারে। দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এক এলাকায় থাকলে সব দিক থেকেই সুবিধা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অফিস ছাড়াও সেখানে বা পাশাপাশি কোথাও সংবাদকর্মীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাও তৈরি করা যেতে পারে।

৭) ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন: সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে, ’৯০ পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষার বদলে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো হয়েছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আঁতুড়ঘর। নির্লজ্জভাবে দলীয় লেজুরবৃত্তি করাই হয়েছে তাদের একমাত্র প্রধান কাজ। সাংবাদিকতার আজকের দুর্দিনের জন্য এটিও অন্যতম কারণ। সেজন্য সাংবাদিক ইউনিয়নকে পেশাজীবী সংগঠন করতে হবে। এই সংগঠনগুলো যাতে কোনভাবেই দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এসব বিষয়গুলো ছাড়াও পেশাজীবী সাংবাদিক, মালিকপক্ষসহ পেশা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে আরও প্রয়োজনীয় বিষয় নির্ণয় করে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

এর উদ্দেশ্য হলো: সাংবাদিকতা যেন সবসময় সঠিকপথে থাকে। কোন অশুভ শক্তি যেন সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। হোক সেটা সরকার, মালিকপক্ষ, সাংবাদিক বা যেকোন পক্ষ থেকেই। কেউ যেন সাংবাদিকতার গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে কিংবা গতিপথ পাল্টে দিতে না পারে। গণমানুষের জন্যই হোক পেশাদার গণমাধ্যম, এটাই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে।

আহসান কামরুল: সাংবাদিক; প্রধান সমন্বয়ক, মিডিয়া মনিটর ইমেইল: [email protected]

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে নিখোঁজের দুদিন পর শিশুর মরদেহ উদ্ধার

একদিনেই দুদকের ৫ অভিযান

নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই সংবিধান সংশোধন হওয়া উচিত : দুলু

পবিত্র শবে মেরাজের তারিখ জানা গেল 

সারদায় প্রশিক্ষণরত ৮ এসআইকে অব্যাহতি, একাডেমি ছাড়ার নির্দেশ

আসিফ, হাসনাত ও সারজিসের ফেসবুক আইডি কোথায়?

তামাক কোম্পানির ছেলে ভোলানো গল্প ও বাস্তবতা

সিলেট সীমান্তে ভারতীয় দুই নাগরিক আটক

খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর আজিমসহ গ্রেপ্তার ৫

মাগুরা অটিস্টিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবনে কার্যক্রম শুরু

১০

ছাত্রদল রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের কাজ করবে : ব্যারিস্টার অমি

১১

যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা, নিহত ১০ 

১২

বিচারপতির কাছে চাঁদা দাবি, যুবদল নেতা গ্রেপ্তার

১৩

‘বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে’

১৪

‘সুষ্ঠু নির্বাচন করলে অন্তর্বর্তী সরকারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে’

১৫

লক্ষ্মীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২

১৬

‘দেশের জনগণের সঙ্গে হঠকারিতা করেননি জিয়াউর রহমান’

১৭

পিএসএলের ড্রাফটে সাকিব-মোস্তাফিজসহ ৩০ বাংলাদেশি!

১৮

স্বপ্ন দেখালেও পাঁচ মাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই : ফয়জুল করীম

১৯

প্রধান শিক্ষকের গাফিলতিতে অনিশ্চয়তায় ৫৩ পরীক্ষার্থী

২০
X