বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের প্রায় চার কোটি মানুষের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রমবর্ধমান বাজারদর। প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা উৎস মুরগির ডিমের দাম আকাশচুম্বী। যেন রূপকথার সেই হাঁসটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় মুরগি হয়ে সোনার ডিম পাড়ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী এক ডজন ডিম আর এক কেজি মুরগির দাম এখন প্রায় সমান। সাধারণত ডিমের দাম কম এবং মুরগির মাংসের দাম তার থেকে বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু এখন সে কথা উলটে যাওয়ার উপক্রম। এটা এমন এক বাস্তবতা- যখন দেশবাসীকে মুরগি আর ডিমের চিরায়ত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ডিমের হালি যেখানে ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা, তা এখন ৬০ টাকা হালি। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বারংবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে পোল্ট্রি ফিডের দাম বাড়ানোর অজুহাত দেখালেও, বিশ্ব বাজারে বেশিরভাগ ফিডের দাম টনপ্রতি অনেকাংশে কমেছে। দ্য গ্লোবাল ইকোনমি ডটকমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাসে ভুট্টা টনপ্রতি ৩৭৯. ৯ ডলারে বিক্রি হলেও তা ২০২৩ সালের জুলাইতে নেমে আসে ২৪৯ ডলারে। এ ছাড়া সয়াবিন মিলের (মুরগির খাবার) দামও কমেছে গত বছরের তুলনায়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে টনপ্রতি সয়াবিন মিলের দাম ছিল ৬০৫.১২ ডলার, যা চলতি বছরের জুলাইতে কমে দাঁড়িয়েছে ৫১৭.২৩ ডলার।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রান্তিক খামারিদের দেওয়া একটি বিজ্ঞপ্তিতে দাম বাড়ানোর এসব গোমর কিছুটা ফাঁস হয়েছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন উৎপাদন ও সরবরাহ সংকটের জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন প্রান্তিক খামারিরা। তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) দাবি, ডিম ও মুরগির মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ জোগান দেন প্রান্তিক খামারিরা। কিন্তু ন্যায্য বাজারমূল্য না পেয়ে অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ সুযোগে করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসএমএস বা খুদেবার্তার মাধ্যমে ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাজার করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারা এসএমএস দিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বাড়াতে চাইলে বাড়ে, কমাতে চাইলে কমে। অভিযোগ করে বলা হয়, ব্যবসায় টিকে থাকতে দেশের প্রায় অর্ধকোটি প্রান্তিক উদ্যোক্তা করপোরেটদের দাদনে জিম্মি হয়ে পড়েছেন (সূত্র : দৈনিক কালবেলা)। তবে পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের এ অসহায়ত্ব শুধু তাদের একার নয় বরং দেশবাসীর জন্যই এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এক দুষ্টচক্রে যেন ভোক্তারা বন্দি। কখনো সয়াবিন তেল, কখনো পেঁয়াজ, কখনো ব্রয়লার মুরগি, কখনো কাঁচামরিচ, কখনো আলু অথবা কখনো ডিম, যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসায়ীরা গোপন কোনো সংগঠনের অংশ। যেখান থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে- এবার পেঁয়াজ, এবার মুরগি, এবার ডিমের মূল্য বাড়বে। এই চক্রের যেন শেষ নেই। ফলাফল হিসেবে এ দেশের বিভিন্ন পর্যায়েয় নির্ধারিত আয়ের মানুষ পড়ছেন চরম বিপাকে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে নিউজ চ্যানেল ২৪-এর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এক সাংবাদিক দেখান, তিনি ১ হাজার টাকা নিয়ে বাজারে যান। এরপর ১১০ টাকায় ২ কেজি চাল, ২৭৫ টাকায় দেড় কেজি ওজনের একটি মুরগি, ৪৫ টাকায় হাফ কেজি ডাল, ১৭৫ টাকায় এক লিটার তেল, ৫০ টাকায় মসলা, ৩০ টাকার পেঁয়াজ, ১০০ টাকায় হাফ কেজি আদা, ১০০ টাকায় হাফ কেজি রসুন, ১০০ টাকায় হাফ কেজি কাঁচামরিচ কেনার পর তার কাছে মাত্র ১৫ টাকা ছিল। এ টাকায় কোনো সবজি কিনতে না পেরে তিনি ১৫ টাকার শাক কেনেন।
প্রতিবেদনটিতে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, এক হাজার টাকা উপার্জন করতে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের তিন দিন সময় লাগে। আর ১৬ বছর ধরে লেখাপড়া করা শিক্ষিত যুবকের লাগে দুই দিন। এই সাংবাদিক কোনো সিদ্ধান্ত না দিলেও বাংলাদেশে মানুষের নিত্যপণ্যের দামের বৃদ্ধির সঙ্গে সমাজের বড় একটি অংশের নিয়ত সংগ্রামের ব্যাপকতা এই তথ্যের মাধ্যমে ঠিকই বোঝা গেছে।
যখন ডিমের দামই হালিপ্রতি ৬০ আর ডজন প্রতি ১৮০ টাকা, ঠিক একই সময়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কাঁচাবাজারে কেজিপ্রতি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ আরেক দিকে করপোরেটদের এসএমএসের প্রতাপ, দুর্ভোগ শুধু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের।
ডিমের দামের এমন লাগামহীন বৃদ্ধি যদি বহাল থাকে তাহলে মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য হিসেবে ডিম খাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পুষ্টিমান অনুসারে, বছরে একজন মানুষকে কমপক্ষে ১০৪টি ডিম খেতে হবে। এর বেশি হলেও ক্ষতি নেই বলে জানিয়েছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।
বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, চাহিদামতো প্রোটিন না পেলে- শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হবে না, গর্ভবতী মায়েদের গর্ভজাত সন্তানের বৃদ্ধি কম হবে, দুধ পান করানো মায়েদের দুধের পরিমাণ ও মান কমে যাবে, বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে কমতে বার্ধক্য আরও দ্রুত কাবু করতে শুরু করবে। কারণ বার্ধক্য ঠেকায় প্রোটিন। আবার প্রাপ্তবয়স্ক যারা কায়িক শ্রম দেন তারা সঠিক মাত্রায় প্রোটিন না খেলে তাদের পেশি ভাঙতে শুরু করবে। ফলে প্রোটিনের ঘাটতি মানুষকে একটা ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাবে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডিমের দাম কত হওয়া উচিত সেটা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কী কষ্ট হওয়া উচিত, সেটা তো প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানাবে! আমরা যদি বলি, কালকে থেকে ডিম আমদানি করব; প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রিন সিগনাল না দিলে আমরা পারব না। মূল ব্যাপারটা তাদের হাতে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে কমে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা অবশ্যই খুশি হওয়ার মতো খবর। জনসংখ্যার এই বড় অংশের দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ঘরগুলোতেও বাজার করায় ভাটা পড়েছে। শুধু যে ডিমের দামেরই এমন বৃদ্ধি ঘটেছে ব্যাপারটা এমন নয়। দেশি পেঁয়াজের মজুদ কমে যাওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি, ভারতের নাসিক রাজ্যে বন্যা ও রপ্তানিমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার অজুহাতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনেকে একচ্ছত্রভাবে দুষলেও এটা সহজে বোধগম্য- শুধু তাদের মনিটনিংয়ের মাধ্যমে গরুর মাংস থেকে শুরু করে ডিম, তেল, চিনি সবকিছুর দাম ন্যায্য রাখা সম্ভব নয়। দাম ন্যায্য না থাকার পেছনে অবশ্যই সুবিধাভোগী এবং প্রবলভাবে ক্ষমতাবান কিছু মানুষের হাত রয়েছে। শুধু ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযানে মূল্য যেটুকু নিয়ন্ত্রণে আসবে, তাতে সার্বিক পরিস্থিতির খুব একটা তারতম্য ঘটবে বলে মনে হয় না। করপোরেটদের দানবীয় আচরণ না থামাতে পারলে মূল্য বৃদ্ধির এই যাঁতাকল থেকে দেশের মূল জনশক্তির বের হয়ে আসা দুষ্কর। তবে এটুকুই শেষ নয়, সরকারের সদিচ্ছার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে সমস্যার তালিকার সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন এ সময়ের দাবি।
নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি প্রশংসার যোগ্য একটি বিষয়। দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরা প্রবাসীরা ঢাকায় এয়ারপোর্ট থেকে নেমে শহরের মানচিত্রের আমূল পরিবর্তন দেখে অবাক হতে পারেন। পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণের জনপদে আর্থিক চঞ্চলতাসহ যাতায়াতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে আছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, দেশের সব মানুষ কি খেয়ে পরে সুখে আছে? নাকি দেশের জনসংখ্যার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অংশই বছরের পর বছর শুধু সম্পদশালী হয়ে উঠছে? এসব চিরায়ত প্রশ্নের উত্তর যাদের দেওয়ার কথা তারাই হয়ত ভালো দিতে পারবেন।
মন্তব্য করুন