কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০২:১০ পিএম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. মো. শফিকুল ইসলাম

শোকাবহ আগস্ট, ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়

শোকাবহ আগস্ট, ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়। ছবি : সৌজন্য
শোকাবহ আগস্ট, ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়। ছবি : সৌজন্য

আগস্ট মাস বেদনার মাস। আগস্ট এলেই ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুর স্মৃতি পীড়ন তাড়িত করতে থাকে আমাদের। আমরা বিপন্নবোধ করি, অসহায়বোধ করি। জাতির পিতার অকালমৃত্যুর দগদগে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকে গোটা জাতি। লেখার শুরুতে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেই সঙ্গে স্মরণ করছি ১৫ আগস্টে যারা শাহাদৎবরণ করেছেন তাদের সবাইকে। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বিশ্বের ইতিহাসে এক কালো এবং বর্বরতম ঘটনা। কারণ ওইদিন খুব সকালে নৃশংসভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে সিঁড়ির নিচে অবস্থানকারী ঘাতকের হাতের স্টেনগান। ১৮টি গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় বঙ্গবন্ধুর বুক। জাতির পিতা পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। তার বুকের রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের স্রোত। যেই রক্তে মিশে আছে আমাদের জাতির স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা।

ষড়যন্ত্রের বুলেটে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই ষড়যন্ত্র আমরা সবাই বুঝতে পারি। যে দেশকে স্বাধীন করল তাকে এইভাবে হত্যা করতে পারে মানুষ। ভাবতে কষ্ট লাগে, কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর! কী এক হতাভাগা জাতি আমরা! এই হত্যাকাণ্ডের ফলে আমরা শুধু বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই পরিচিতি পাইনি বরং বিশ্বের সামনে আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হয়েছি সেই খুনিদের জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা জাতি হিসেবে বিশ্বের মানুষের কাছে আত্মঘাতী চরিত্রই প্রকাশ করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দ্য টাইমস অব লন্ডন-এ প্রকাশিত ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবন বিশ্ব স্মরণ করবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুর ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে মনে করছে এবং করবে বাংলাদেশের জনসাধারণ।

যদি ১৫ আগস্টের মীর জাফরদের ঘৃণিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কারও একটুও ধারণা থাকে, তবে কারও পক্ষেই ওই ঘাতকদের মানুষ বলে মনে করা সম্ভব নয়। এরা কাপুরুষ এবং জাতির সন্তান হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। এদের নিয়ে কথা বলার মতো রুচিও মানুষের নেই। এরা কী যে নিন্দনীয় এবং পাষণ্ডের মতো কাজ করছে! তাদের ঘৃণা জানানোর ভাষাও জানা নেই। জাতি তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়, কিন্তু বিচারের কার্যক্রম শুরু হয় অনেক বছর পরে। এটাও জাতির জন্য আরেক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।

১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা হয় এবং হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের গতিশীলতা ফিরে পায় বাঙালি জাতি ও দেশের নাগরিক। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জর্জ আদালত। কিন্তু ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে তিনজনকে খালাস দিয়ে ১২ জনের মৃত্যু দণ্ড বহাল রাখে। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগেও বহাল রেখে আদেশ জারি করা হয়। অনেকের ফাঁসি কার্যকর হলেও যাদের ফাঁসির রায় এখনও কার্যকর হয়নি তাদের দেশে এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে পারলেই দেশের জনগণ শান্তি পাবে এবং কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে।

নতুন প্রজন্মের একজন নাগরিক হিসেবে আজও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কীভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল কিছু দুষ্কৃতকারী। ভাবতে আমি শিউরে উঠি আতঙ্কে। কারণ যে মানুষটি জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তার মোট জীবনের এক-চতুর্থাংশ, যাকে ২০ বার গ্রেপ্তার করা হয় শুধু দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে, যার অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর সাহস দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা এনে দেয়, তাকেই নিহত হতে হয় দেশের কিছু পথভ্রষ্ট কুলাঙ্গার মানুষের হাতে। আজকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি, স্বাধীন একটি মানচিত্র পেয়েছে শুধু তার নেতৃত্বের কারণে। যে নেতার কারণে আজ বাঙালি জাতি বিশ্বের দরবারে পরিচিত। আমরা এক হতভাগা জাতি, তার মতো নেতাকে মেরে ফেলছি। আজ আমরা বিশ্বের ৩৮তম শক্তিশালী অর্থনীতিক দেশ, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন আজ আমরা আরও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে থাকতে পারতাম। তার নেতৃত্বে যে গুণ, দক্ষতা এবং দূরদৃষ্টি ছিল, তা আর কারও মধ্যে নেই। তার হত্যার ঘটনা যখন পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।

শোকাবহ মাস আগস্ট মাস। আগস্ট যখন আসে তখন চিন্তা করি শেখ রাসেলের কথা। সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পাষণ্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছোট শিশু রাসেল, এমনকি পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা বধূও। রাসেলের মতো নিষ্পাপ ছেলেটিকে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করল খুনিরা, মৃত্যুর আগে তার অনুরোধটুকুও কি ঘাতকের মনে একটু দয়া সঞ্চার করতে পারেনি! চিন্তা করলে শরীর কেঁপে উঠে, থমকে যায় স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং সবকিছু স্তম্ভিত হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য।

বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত শোকাবহ এবং বেদনাদায়ক একটি মাস আগস্ট। এই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরমতম ঘৃণিত ও কলঙ্কিত এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল। আগস্টে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ওই দিন আমাদের জাতির পিতা, মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শ্যামল বাংলার মাটি। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যা ঘটেছিল তা পৃথিবীর কোনো সুষ্ঠু মানুষ মেনে নেবে না। বরং ওই ঘাতকদের ঘৃণা করবে এবং বলবে যে বিশ্বের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার যেন আর কোনা পুনরাবৃত্তি না হয়।

এই আগস্টেই ঘটেছিল জাতির ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্ককিত অধ্যায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী শাহাদৎবরণ করেছিল। আগস্ট আসলে ভয় লাগে, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলমান। তাই সরকারের সব কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিন থেকে মাসজুড়ে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মানুষ ধিক্কার জানাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকারী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের, খন্দকার মোশতাকদের। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের চূড়ান্ত রায় এবং পাঁচ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। আমি মনে করি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাকি খুনিদের দেশে এনে বিচার নিশ্চিত করতে অব্যাহত তৎপরতা জারি রাখবেন। আগস্টের শোকের এই দুঃখজনক ইতিহাসের দায়মোচনের তরে এটাই আজকের বাংলাদেশের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় শোক দিবস ২০২৩
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বড় ৭ পদক্ষেপ

হাসপাতালের টয়লেটের ঝুড়িতে মিলল নবজাতকের মরদেহ

২৫ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ছাত্রীকে হত্যা করে বেলাল

পাকিস্তানে বিক্ষোভ / ‘ভারত আক্রমণ করলে কাশ্মীরিরাই প্রথম সারিতে লড়বে’

কাশ্মীর সীমান্তে দুপক্ষের গোলাগুলি

রাজধানীতে ঝুটের গুদামে আগুন

বার কাউন্সিল পরীক্ষা আজ, ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়ানোয় গ্রেপ্তার ১

ধৈর্য ধরবে কি ভারত-পাকিস্তান?

৯ মাস পর শহীদ মিঠুর মরদেহ উত্তোলন

১০

২৫ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

সামরিক শক্তি দেখাতে নেমেছে ভারত-পাকিস্তান

১২

ভারত-পাকিস্তান / পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ, সব কিছুতেই নিষেধাজ্ঞা

১৩

সিলেট মেডিকেলের সাবেক উপাচার্যসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১৪

টিভিতে আজকের খেলা

১৫

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৬

নারায়ণগঞ্জে টাকা নেওয়া সেই ওসিকে বদলি

১৭

জানাজায় গিয়ে ভাতিজার মৃত্যু, খবর শুনে মারা গেলেন চাচাও

১৮

স্বাস্থ্য পরামর্শ / একচেটিয়া মাতৃদুগ্ধ পান শিশু পুষ্টির স্বর্ণমান

১৯

ডামুড্যায় ওপেন হাউজ ডে অনুষ্ঠিত

২০
X