কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারে সমস্যা কোথায়

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। ছবি : সংগৃহীত
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। ছবি : সংগৃহীত

যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় গৃহকর্তা লোকজন নিয়ে তীর্থে বৃন্দাবন গিয়েছেন। গিন্নির তীব্র বারণ সত্ত্বেও তার চক্ষুশূল ওই কেষ্টাও সঙ্গে আছে। গৃহকর্তা শ্রীধামে বাসা নিলেন, সদলবলে সেখানে উঠলেন এবং কদিনের মধ্যে গুটিসবন্ত (Smallpox) রোগে আক্রান্ত হলেন। সঙ্গী-সাথী চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। থেকে গেল কেবল ওই কেষ্টা। নিশিদিন প্রাণান্তকর সেবাশুশ্রূষা করে সে তার কর্তাবাবুকে সুস্থ করে তুলল। কিন্তু নিজে পড়ল ওই মরণঘাতী রোগে। নির্বোধ-নিষ্কর্মা বলে যাকে আগে বারবার বাসা থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছিল, সে এতদিনে চিরবিদায় নিল। তখনও গুটিসবন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। একবার প্রাদুর্ভূত হলে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। রোগটি বসন্তের শুরুর দিকে বা শীতের পর দেখা যেত, যার কারণে রোগটি বসন্ত নামে পরিচিত হয়ে যায়। হিন্দু ধর্মানুসারে দেবী দুর্গার অবতার হিসাবে শীতলা দেবী এক হাতে কলস, অন্য হাতে ঝাটা ও কুলা নিয়ে গর্দভে চড়ে ধরায় আসেন। কলস ভর্তি গর্দভীর দুধ দিয়ে বসন্ত রোগের আরোগ্য সুধা দান করেন, আর ঝাড়ু-কুলা দিয়ে রোগাক্রান্তদের কষ্ট লাঘব করেন। মাঘ মাসের ৬ষ্ঠ দিনে নারীরা বসন্তবুড়ী ব্রত পালন করেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘বসন্তভীতু আবালবৃদ্ধবনিতা... মিলে হরি-সংকীর্তন করে।

গুটিসবন্ত রোগের বিরুদ্ধেই পৃথিবীর সর্বপ্রথম টিকা (vaccine) আবিষ্কৃত হয়। ইংল্যান্ডের চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner) ১৮৯০ সালে এই টিকা উদ্ভাবন করেন, যা আধুনিক ইমিউনোলজির ভিত্তি স্থাপন করে। সফল প্রয়োগের ফলে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে, গুটিবসন্ত রোগ পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে গেছে। প্রতিষেধক হিসেবে টিকার এ যুগান্তকারী সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। টিকা আবিষ্কারের বহুমুখী প্রচেষ্টা শুরু হয়। দ্বিতীয় রোগ হিসেবে ২০১১ সালে রিন্ডারপেস্ট (গবাদি পশুর প্লেগ) পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়। পোলিওর বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছে। সর্বশেষ বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে টিকার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সহজভাবে বলতে গেলে টিকা হলো এক ধরনের প্রতিষেধক ওষুধ যা জীবাণুঘটিত অর্থাৎ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করার কাজ করে থাকে। রোগ হওয়ার পরে চিকিৎসা নেয়ার পরিবর্তে, টিকা আমাদের অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করে। একটি প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) মানবদেহকে দুর্গের মত প্রতিরক্ষা প্রদান করে থাকে। নির্দিষ্ট জীবাণু (অ্যান্টিজেন) দেহদুর্গ আক্রমণ করলে তা যেন অসুস্থতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য টিকা এক ধরণের হাতিয়ার হিসেবে ইমিউন সিস্টেমকে প্রয়োজনীয় শক্তি ও সক্ষমতা দান করে। তাহলে সংজ্ঞা দাঁড়ালো এই- টিকা এক প্রকার জৈবিক প্রস্তুতি যা একটি নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে সক্রিয় অর্জিত অনাক্রম্যতা প্রদান করে। টিকা ইমিউন সিস্টেমকে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে এবং কীভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেয়। অ্যান্টিবডি হচ্ছে অ্যান্টিজেন তথা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেম দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত প্রোটিন। ইমিউন সিস্টেম মনে রাখার জন্য ডিজাইন করা; সে আক্রমণকারী জীবাণুকে চিনে রাখতে পারে। ইমিউন সিস্টেম একবার টিকার এক বা একাধিক ডোজের সংস্পর্শে আসলে সাধারণত বছরের পর বছর, কয়েক দশক বা এমনকি সারাজীবন সে জীবাণুকে চিনে ফেলতে পারে এবং অ্যান্টিবডি দিয়ে তার কর্মক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে।

টিকার প্রকারভেদ রয়েছে, এদের উৎপাদন ও কার্যপদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। টিকা প্রধানত ২ ধরনের : (ক) সমগ্র কোষভিত্তিক টিকা (Whole-cell Vaccine) : পুরো জীবাণু ব্যবহার করে টিকা তৈরি করা হয়। (খ) উপাদানভিত্তিক ভ্যাকসিন (Component/Subunit Vaccine) : ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার পুরো জীবাণু ব্যবহার করা হয় না; বরং জীবাণুর নির্দিষ্ট অংশ, যেমন প্রোটিন বা শর্করা (সাধারণত স্পাইক প্রোটিন বা টক্সিন) ব্যবহার করা হয়। সমগ্র কোষভিত্তিক টিকা ৩ রকমের হতে পারে :

১. লাইভ ভাইরাস (Live virus) : এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করেন, যারা গোয়ালঘরে গরুর লালন-পালনের কাজ করতে যেয়ে ‘গরুর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়, তারা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয় না। গরুর বসন্ত হল একটি তুলনামূলকভাবে হালকা রোগ, যা গরু এবং মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। তিনি গরুর বসন্তে আক্রান্ত এক গোয়ালিনী সারা নেলমসের ক্ষত থেকে সংগৃহীত পুঁজ ৮ বছরের একটি ছেলে জেমস ফিপসের শরীরে ইনজেক্ট করেন। ছেলেটি সামান্য জ্বর এবং অস্বস্তিতে ভুগলেও খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। কয়েক মাস পরে জেনার আবার ছেলেটির শরীরে গুটিবসন্তের জীবাণু প্রবেশ করান। তাতেও জেমস ফিপস রোগাক্রান্ত হয়নি। এটি প্রমাণ করে যে গরুর বসন্তের জীবাণু তাকে গুটিবসন্ত থেকে সুরক্ষা দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে 'Vaccine' শব্দটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ 'Vacca' থেকে, যার অর্থ 'গরু'। জেনার টিকা হিসেবে একটি কম বিপজ্জনক জীবন্ত ভাইরাস ব্যবহার করেছিলেন, যা ছিল 'কাউপক্স ভাইরাস (Vaccinia virus)। এটি একটি ক্ষয়প্রাপ্ত (attenuated) ভাইরাস যা হোস্টে প্রতিলিপি করতে সক্ষম কিন্তু গুটিবসন্ত সৃষ্টি করে না। পরিবর্তে, এটি একটি ইমিউন প্রতিক্রিয়া উদ্দীপিত করে যা যথাসময়ে গুটিবসন্ত ভাইরাসকে চিনতে পারে এবং ক্রস-প্রোটেকশনের মাধ্যমে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করে।

২. লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিন (Live attenuated vaccines): অ্যাটেন্যুয়েশন নিশ্চিত করে যে ভ্যাকসিন নিরাপদ কিন্তু এখনও ইমিউনোজেনিক। অর্থাৎ ভাইরাসটিকে এমনভাবে দুর্বল করা হয় যাতে এটি আরেকজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে রোগ সৃষ্টি করতে না পারে, কিন্তু তারপরও একটি শক্তিশালী ইমিউন প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে। অ-মানব হোস্ট (যেমন, প্রাণী বা মুরগির ভ্রূণ)-এর সাথে ভাইরাসের অভিযোজন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, নিম্ন তাপমাত্রায় সংবেদনশীলতা, রাসায়নিক বা বিকিরণ চিকিৎসা ইত্যাদির মাধ্যমে ভাইরাসটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়। এর ফলে রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন ভিরুলেন্স জিন এনকোডিং প্রোটিন বা এনজাইম (যা ভাইরাসকে হোস্ট কোষ আক্রমণ করতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমন করতে বা কোষের ক্ষতি করতে দেয়)-কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। সারফেস প্রোটিন (অ্যান্টিজেন) অক্ষত থাকে টি-লিম্ফোসাইট তথা প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করার জন্য । কিন্তু অন্যান্য জেনেটিক বা কাঠামোগত উপাদানগুলিকে পরিবর্তিত করা হয় যাতে ভাইরাসের অসুস্থতা সৃষ্টি করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয়করণে এ ধরণের টিকা নিষ্ক্রিয় (নিহত) টিকার চেয়ে অধিক পারঙ্গম। উদাহরণ: - হাম, মাম্পস, রুবেলা (MMR) ভ্যাকসিন, ওরাল পোলিওমায়েলাইটিস (OPV), রোটা ভাইরাস, যক্ষ্মা (BCG), টাইফয়েড (ওরাল), ভেরিসেলা জস্টার ভাইরাস।

৩. নিষ্ক্রিয় (নিহত) সমগ্র কোষভিত্তিক টিকা (Inactivated (Killed) Whole Cell Vaccine) : এটি এমন এক ধরনের টিকা, যেখানে জীবাণুগুলো (যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস) মেরে ফেলা হয় এবং এই মৃত জীবাণুগুলো টিকার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই টিকা জীবাণুর সম্পূর্ণ গঠন ধরে রাখে, কিন্তু জীবাণুগুলো বংশবৃদ্ধি বা সংক্রমণ ঘটাতে অক্ষম থাকে। ইমিউন সিস্টেম জীবাণুর অ্যান্টিজেন চিনে নেয় এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে শুরু করে। সক্রিয় বি-লিম্ফোসাইট প্লাজমা সেলে রূপান্তরিত হয় ও জীবাণুর অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। তাছাড়া শরীরে মেমরি সেল তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে ওই জীবাণু আক্রমণ করলে দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এগুলো সাধারণত শিশু, গর্ভবতী নারী বা দুর্বল ইমিউনিটি সম্পন্ন রোগীদের জন্য নিরাপদ।

উদাহরণ : ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন (Influenza vaccine), হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন (Hepatitis A Vaccine), রেবিস ভ্যাকসিন ( Rabies vaccine), কলেরা ভ্যাকসিন (Cholera vaccine) ইত্যাদি।

উপাদানভিত্তিক ভ্যাকসিন জীবাণুর নির্দিষ্ট টুকরো ব্যবহার করে- যেমন এর প্রোটিন, চিনি বা ক্যাপসিড (জীবাণুর চারপাশে একটি আবরণ)। কয়েক রকমের হতে পারে :

১. প্রোটিন সাবইউনিট টিকা (Protein subunit vaccine) : জীবিত বা মৃত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার না করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন (যেমন, ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন বা কোষের সারফেস প্রোটিন) ব্যবহার করা হয়। ঐ প্রোটিন শরীরে অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং ইমিউন সিস্টেমের কোষ (যেমন, T-cells)-কে সক্রিয় করে, যা ভবিষ্যতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ ধরণের টিকাকে “রিকম্বিন্যান্ট প্রোটিন টিকাও (Recombinant Protein Vaccine) বলা হয়, কারণ এখানে রিকম্বিনেশন অর্থাৎ পুনঃসংযোজন ঘটে। দুটি ভিন্ন উত্স থেকে সংগৃহীত জেনেটিক উপাদানের সংযোজন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়। যেমন: হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন তৈরি করতে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে ডিএনএর অংশ ইস্ট (yeast)-এর কোষের ডিএনএতে প্রবেশ করানো হয়। ইস্টের কোষগুলি তখন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে সারফেস প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম হয়; এরপর এটিকে পরিশুদ্ধ করা হয় এবং ভ্যাকসিনের সক্রিয় উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

উদাহরণ : হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B), এইচপিভি (HPV, Human Papillomavirus), নোভাভ্যাক্স কোভিড-১৯ (Novavax COVID-19 Vaccine), হুপিং কাশি (Pertussis Vaccine), মেনিনজোকোক্কাল (MenB) ভ্যাকসিন, ভেরিসেলা- জোস্টার ভ্যাকসিন (শিংগ্রিক্স), অ্যান্থ্রাক্স (Anthrax Vaccine Adsorbed ( AVA / Bio Thrax) ।

২. পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন (Polysaccharide subunit vaccine): এক্ষেত্রেও জীবিত বা মৃত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয় না; তবে প্রোটিনের পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়ার পৃষ্ঠের শর্করা (পলিস্যাকারাইড) ব্যবহার করা হয়। কিছু ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনকে কার্যকর করতে ইমিউন সিস্টেমকে প্রশিক্ষণ দিতে হয় যেন সে প্রোটিনের পরিবর্তে পলিস্যাকারাইডের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এ ধরণের টিকা টি- লিম্ফোসাইটকে ভালোভাবে সক্রিয় করতে পারে না, ক্ষণস্থায়ী ও স্বল্পস্মৃতিশক্তির অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

উদাহরণ : নিউমোকোকাল পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন (PPSV, 23 serotypes)

৩. কনজুগেট টিকা (Conjugate Vaccine) : ‘কনজুগেট’ মানে ‘সংযুক্ত’। প্রাথমিকভাবে দেখা গেল যে, পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন শিশু এবং ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ভাল কাজ করে না । তবে তারা বেশ ভাল কাজ করে যদি পলিস্যাকারাইড অন্য কিছুর সাথে সংযুক্ত হয়; তখন তারা টি-লিম্ফোসাইটকে জোরেশোরে সক্রিয় করতে পাওে, এদের ইমিউন সিস্টেমের স্মৃতিশক্তিও দীর্ঘস্থায়ী হয় । বেশিরভাগ কনজুগেট ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে পলিস্যাকারাইডকে সংযুক্ত করা হয় ডিপথেরিয়া বা টিটেনাস টক্সয়েড প্রোটিনের সাথে। ইমিউন সিস্টেম এই প্রোটিনগুলিকে খুব সহজেই চিনতে পারে এবং এটি পলিস্যাকারাইডের প্রতি একটি শক্তিশালী ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে। এজন্য ডিপথেরিয়া টক্সয়েডকে প্রায়ই 'CRM197 ক্যারিয়ার প্রোটিন' বলা হয়, কারণ এটি প্রায় ডিপথেরিয়া টক্সয়েডের মতোই কিন্তু পুরোপুরি নয়।

উদাহরণ : হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি ভ্যাকসিন (HIB), মেনিনজোকোকাল সেরোগ্রুপ-সি ভ্যাকসিন (MenC), নিউমোকোক্কাল ভ্যাকসিন (PCV, 13 serotype), মেনিনজোকোক্কাল কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন (MenACWY135), টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV)।

৪. টক্সয়েড (Toxoid) : টক্সয়েড টিকা হল একটি ইনঅ্যাকটিভেটেড (অপ্রচলিত) ভ্যাকসিন, যা জীবিত বা মৃত জীবাণু বা এর কোনও জীবিত অংশ থেকে তৈরি হয় না। বরং, এতে জীবাণুর তৈরি টক্সিন বা বিষাক্ত প্রোটিন (যা রোগ সৃষ্টি করে)-কে নিষ্ক্রিয় করা হয়, কিন্তু অ্যান্টিজেন হিসেবে এর সক্রিয়তা বহাল থাকে। শরীর এই নিষ্ক্রিয় টক্সিনকে চিনতে পারে এবং ভবিষ্যতে যদি আসল টক্সিন শরীরে প্রবেশ করে, তবে শরীর আগেই প্রস্তুত থাকে এবং দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

উদাহরণ : টিটেনাস টিকা (Tetanus vaccine), ডিপথেরিয়া টিকা (Diphtheria vaccine)

৫. নিউক্লিক অ্যাসিড টিকা (Nucleic Acid Vaccine) : এতে ভাইরাসের ডিএনএ (DNA) বা ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) ব্যবহৃত হয়, যা কোষের প্রোটিন তৈরির মেশিন (রাইবোসোম)-কে নির্দেশ দেয় প্রোটিন (যেমন স্পাইক প্রোটিন) তৈরি করতে। এই প্রোটিন শরীরের ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় করে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। Protein Subunit Vaccine এবং Nucleic Acid Vaccine এর মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটিতে জিনগত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রোটিন তৈরি করা হয়, আর দ্বিতীয়টিতে শরীরের কোষকে প্রোটিন তৈরি করতে শেখানো হয়। উদাহরণ : Pfizer-BioNTech COVID-19 Vaccine (mRNA ভ্যাকসিন), Moderna COVID - 19 Vaccine (mRNA ভ্যাকসিন)।

৬. ভাইরাল ভেক্টর টিকা (Viral Vector Vaccine): এই ভ্যাকসিনে এক ধরনের নিরাপদ ভাইরাস (যেমন অ্যাডেনোভাইরাস) ব্যবহার করা হয়, যা আসল ভাইরাসের জিনগত উপাদান বহন করে। এই ভেক্টর ভাইরাস শরীরের কোষে প্রবেশ করে এবং প্রোটিন তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রশিক্ষণ দেয়। উদাহরণ: অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড COVID-19 ভ্যাকসিন, জনসন অ্যান্ড জনসন (J&J) ভ্যাকসিন, ডেঙ্গু ভাইরাস (যাতে ইয়ালো ফিভারের ১৭ডি ভ্যাকসিনের সাথে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিন থাকে), ইবোলা ভাইরাস। টিকা যে সর্বদা রোগ চিরতরে নির্মূল করতে পারে, তা নয়। কিন্তু তা না হলেও বিভিন্ন সংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণে টিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আমাদের দেশে মাঝে মাঝেই ডেঙ্গু মহামারী আকারে দেখা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই মৃত্যু এবং অসুস্থতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ ডেঙ্গু । প্রশ্ন চলে আসে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের সর্বশেষ খবর কী? ডেঙ্গু জ্বরের টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণা চলছে, কিন্তু বাজারে কি সম্পূর্ণ কার্যকর এবং নিরাপদ টিকা পাওয়া যাচ্ছে? ডেঙ্গু টিকা আবিষ্কারে ২ ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল : ১. ডেঙ্গু ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকার (Serotypes) এবং ২. ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা। এক এক করে আলোচনা করা যাক।

১. ডেঙ্গু ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকার (Serotypes ) : ডেঙ্গু একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। এ ভাইরাসের পোষক এডিস ইজিপ্টি মশা। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান প্রকার (DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4) রয়েছে। দেখা গেছে ভ্যাকসিনটি একটি প্রকারের বিরুদ্ধে কার্যকর, কিন্তু অন্য প্রকারের বিরুদ্ধে তার কার্যকারিতা নেই বা যৎসামাণ্য। তাছাড়া, যদি একজন ব্যক্তি একাধিক বার ডেঙ্গু ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকারের সংক্রমণের শিকার হন, তবে এটি শরীরের জন্য আরও বিপজ্জনক হতে পারে, যার ফলে Antibody- Dependent Enhancement (ADE) হতে পারে, যেখানে ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ADE হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া যা কিছু ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঘটে, বিশেষ করে ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্ষেত্রে। ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা)-কে two-edged sword বা 'দ্বিধার তলোয়ার' বলা হয়, কারণ এর দুটি দিক থাকে- একটি ভালো এবং একটি খারাপ।

ভালো দিক (প্রতিরোধ) : ইমিউন সিস্টেম আমাদের শরীরের রোগজীবাণু (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস) এবং বহিরাগত পদার্থ (যেমন টক্সিন) থেকে রক্ষা করে। যখন এটি সঠিকভাবে কাজ করে, তখন এটি শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং সংক্রমণ বা রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। খারাপ দিক (অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া) :

কখনও কখনও ইমিউন সিস্টেম ভুলভাবে শরীরের নিজস্ব কোষ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করতে শুরু করে, যা অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করে (যেমন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, টাইপ ১ ডায়াবেটিস)। এছাড়া, ইমিউন সিস্টেম যদি অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে যায়, তবে এটি শরীরের ক্ষতি করতে পারে (যেমন, অ্যালার্জি বা অতি প্রতিক্রিয়া, ADE।

ADE তখন ঘটে যখন শরীরের তৈরি অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করার পরিবর্তে ভাইরাসকে শরীরের কোষে প্রবেশ করতে সহায়তা করে, ফলে সংক্রমণ আরও তীব্র হতে পারে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ADE যেভাবে ঘটে: ডেঙ্গুর যে ৪ ধরনের ভাইরাস রয়েছে, তার এক ধরণের ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর শরীর সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। কিন্তু, যদি সেই ব্যক্তির শরীর আরেক ধরণের ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হয়, তখন ADE ঘটে এবং পুরনো অ্যান্টিবডি নতুন ভাইরাসের সাথে মিশে গিয়ে ভাইরাসের কোষে প্রবেশের প্রক্রিয়া আরও সহজ করে দেয়। এর ফলে নতুন সংক্রমণ আরও মারাত্মক হতে পারে এবং জটিলতা বাড়তে পারে, যেমন হেমোরেজিক ফিভার বা শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু ভ্যাকসিনে (যেমন Dengvaxia) ADE সম্পর্কিত ঝুঁকি রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি প্রথম ডোজের আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে ভ্যাকসিনের পর ADE ঘটতে পারে, যা তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তবে, যদি কাউকে টিকা দেয়ার আগে নিশ্চিত করা যায় যে সে পূর্বে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি, তবে ADE এর ঝুঁকি কমে যায়। এ কারণে, ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং স্বাস্থ্য সংস্থাসমূহ প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার পরেই টিকা দেয়ার সুপারিশ করে।

২. ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন, Dengvaxia (Sanofi Pasteur), যেটি প্রথমে বাজারে আনা হয়েছিল, সেটি শুধুমাত্র যাদের পূর্বে ডেঙ্গু হয়েছিল, তাদের জন্য কার্যকর ছিল। তবে যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে এই টিকা দেওয়ার পর, ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর গুরুতর রূপ দেখা দিতে পারে। এই কারণে, স্যানোফির এ ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সতর্কবার্তা পেয়েছিল। ডেঙ্গুর যে ২টি ভ্যাকসিন নিয়ে বর্তমানে কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেগুলো হলো: Dengvaxia এবং TAK-003 । বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্যাকসিনগুলি তৈরি করা হয়েছে :

১. ডেংভ্যাক্সিয়া (Dengvaxia) প্রস্তুতকারক: Sanofi Pasteur (সানোফি পাস্তুর), ফ্রান্স প্রযুক্তি: লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিন (Live attenuated vaccine) বিবরণ: এটি ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রকারের বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি yellow fever virus (YFV)-এর বংশোদ্ভুত একটি ভাইরাস থেকে তৈরি করা হয়েছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত উপাদান ধারণ করে। ভ্যাকসিনটি ২°C থেকে ৮°C তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করতে হয়, এটি ফ্রিজ করা (০°C বা তার নিচে) নিষিদ্ধ। বিতরণের সময়ও তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ জরুরি; উষ্ণ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

২. তাক-০০৩ (TAK-003)/কিউডেঙ্গা (QDENGA) প্রস্তুতকারক: তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস (Takeda Pharmaceuticals), জাপান প্রযুক্তি: লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিন (Live attenuated vaccine) বিবরণ: গবেষণাকালীন নাম ছিল TAK - 003, 003 ভ্যাকসিনের কোন বৈশিষ্ট্য সূচক সংখ্যা নয়, স্রেফ শনাক্তকারী একটি সংখ্যা। বাজারজাতকরণের সময় নামকরণ হয় QDENGA । এটিও ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম। Takeda এর এই ভ্যাকসিনটিও yellow fever virus এর অনুরূপ একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তৈরি, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের কিছু জিন ধারণ করে এবং শরীরে প্রতিরোধ তৈরি করতে সাহায্য করে। ভ্যাকসিনটি ২°C থেকে ৮°C তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করতে হয়, এটি ফ্রিজ করা (০°C বা তার নিচে) নিষিদ্ধ। বিতরণের সময়ও তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ জরুরি; উষ্ণ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

তাকেদার Qdenga ভ্যাকসিনের ফেজ-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল, যা Tetravalent Immunization against Dengue Efficacy Study (TIDES) নামে পরিচিত, তা সম্পন্ন হয়েছে। এই পরীক্ষায় লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার ডেঙ্গু-এন্ডেমিক অঞ্চল জুড়ে ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী ২০,০০০-এরও বেশি শিশু জড়িত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীরা Qdenga-র দুটি ডোজ বা একটি ছলৌষধ (placebo) প্রথম দিন এবং ৯০ তম দিনে পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ডোজের পরে ১২ মাসের ফলো-আপ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে ৮০.২% ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেখা গেছে। ইন্দোনেশিয়ার 'ন্যাশনাল এজেন্সি ফর ড্রাগ অ্যান্ড ফুড কন্ট্রোল' (BPOM) ২০২২ সালের আগস্টে ৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের জন্য Qdenga অনুমোদন করেছে, যা ইন্দোনেশিয়াকে ভ্যাকসিন অনুমোদনকারী প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পরবর্তীকালে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ২০২৪ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) Qdenga-কে প্রাক-যোগ্যতা (prequalification) প্রদান করে, ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারের সুপারিশ করে। প্রাক-যোগ্যতা এটিকে ইউনিসেফ এবং প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের মতো জাতিসংঘের সংস্থাগুলির দ্বারা সংগ্রহের জন্য যোগ্য করে তোলে। Qdenga ভ্যাকসিন ৩ মাসের ব্যবধানে মাংসপেশীতে ইনজেকশনের মাধ্যমে ২ ডোজে দেওয়া হয় এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ থেকে রক্ষা করে। উচ্চ সংক্রমণের হার সম্পন্ন অঞ্চলে ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ব্যবহারের জন্য Qdenga ভ্যাকসিনকে সবুজ সংকেত দেয়া হেয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে থাকা দেশগুলি সহ বেশ কয়েকটি দেশে এটির অনুমোদিত হয়েছে। ব্রাজিল ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ভ্যাকসিনটি চালু করে, যার লক্ষ্য কমপক্ষে ৩ মিলিয়ন মানুষকে টিকা দেওয়া। উৎপাাদক জাপানি সংস্থাটি অনুমোদনের জন্য ভারতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রকের সাথে আলোচনা করছে। এটি দশকের শেষ নাগাদ বার্ষিক ১০০ মিলিয়ন ডোজে উৎপাদন বাড়াতে ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় ভ্যাকসিন নির্মাতা 'বায়োলজিক্যাল ই'-এর সাথে একটি উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

অন্যদিকে সানোফি পাস্তুর দ্বারা Dengvaxia (CYD-TDV)-এর ক্লিনিকাল উৎপাদনের আগে ব্যাপকভাবে ফেজ ৩ ট্রায়াল সম্পন্ন করা হয়, তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য CYD14 এবং CYD15। CYD14 এশিয়ার পাঁচটি দেশ- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম-এ পরিচালিত হয়েছিল- ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী ১০,২৭৫ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে। CYD15 পাঁচটি ল্যাটিন আমেরিকার দেশ- কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, হন্ডুরাস এবং পুয়ের্তো রিকোতে সংঘটিত হয়েছিল- যাতে ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী ২০,৮৬৯ জন অংশগ্রহণকারী জড়িত ছিলেন। এই ট্রায়ালগুলি সমাপ্ত হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত Dengvaxia একাধিক দেশে নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছে। এটি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বেশ কয়েকটি এশীয় এবং লাতিন আমেরিকার দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। ইন্দোনেশিয়ায় এই টিকাকে ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী ব্যক্তি যাদের পূর্বে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল (সেরোপজিটিভ) বলে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে, শুধু তাদের ব্যবহারের জন্য BPOM অনুমোদন করেছে। যাইহোক, নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে, বিশেষ করে যারা আগে সংক্রমিত হয়নি (সেরোনেগেটিভ), তাদের মধ্যে মারাত্মক ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি থাকার কারণে Dengvaxia-র ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। BPOM ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য পুনঃমূল্যায়ন করে চলেছে। WHO সেরোনেগেটিভ ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর ডেঙ্গুর ঝুঁকির কারণে শুধুমাত্র পূর্বে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া ব্যক্তিদের জন্য Dengvaxia সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণ ও ব্যবহার নীতিকে প্রভাবিত করেছে। Dengvaxia ৩ ডোজের সিরিজে একটি সাবকিউটেনিয়াস (ত্বকের নীচে) ইনজেকশন হিসাবে দেওয়া হয়, প্রতিটি ০.৫ মিলি ডোজ ছয় মাসের ব্যবধানে দেওয়া হয় ( ০, ৬, এবং ১২ মাসে)। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ডেংভাক্সিয়া এবং কিউডেঙ্গা বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ টিকা দুটি প্রবর্তন করার আগে অন্যান্য দেশে এই ভ্যাকসিনগুলির কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা আরো বেশি পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছেন। ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব রোধকল্পে তারা বরং ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্য কৌশলগুলির গুরুত্বের উপর জোর দিচ্ছেন।

বিশ্বজুড়ে মশকবাহিত অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে কিছু টিকা কার্যকরী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, পুরোপুরি কার্যকরী বা সব ধরনের আক্রান্তদের জন্য একেবারে নিরপেক্ষ এমন কোনো টিকা এখনও পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। ডেঙ্গু সহ মশকবাহিত বিভিন্ন রোগের জন্য কিছু টিকার তথ্যাদি নিম্নরূপ :

মনে রাখতে হবে যে, ভ্যাকসিনের কোনটি নিতে হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির অবস্থান, বয়স এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অবস্থার উপর। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভাইরাস নয়, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং অন্যান্য অনুজীব (microorganisms)-এর বিরুদ্ধেও কার্যকর ভ্যাকসিন রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন: ১. টিটানাস টিকা (Tetanus Vaccine), ব্যাকটেরিয়া: ক্লস্ট্রিডিয়াম টিট্যানি (Clostridium tetani), ২. ডিপথেরিয়া টিকা (Diphtheria Vaccine), ব্যাকটেরিয়া: কোরাইনিব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরিয়া (Corynebacterium diphtheriae), ৩. বিসিজি টিকা (BCG Vaccine), ব্যাকটেরিয়া: মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস (Mycobacterium tuberculosis); ছত্রাক (Fungus)-এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন: ক্যান্ডিডা টিকা (Candida Vaccine), ছত্রাক: ক্যানডিডা অ্যালবিক্যানস (Candida albicans); প্রোটোজোয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন: ম্যালেরিয়া টিকা (RTS,S/AS01), প্রোটোজোয়া: (Plasmodium)।

বেশিরভাগ টিকা ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়, তবে কিছু মুখে খাওয়ানো বা নাকে স্প্রে করা হয়। নাকে স্প্রে করা হয় এমন একটি টিকা ফ্লুমিস্ট কোয়াড্রিভ্যালেন্ট (লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন, LAIV); ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) থেকে রক্ষা পেতে ব্যবহৃত হয়। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় হাতের পেশীতে টিকার ইনজেকশন নেয়ার ছবি অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। একজন কমেন্টে লিখেছিলেন, 'ভাগ্য ভালো কোভিডের টিকা দিতে হয় হাতে, এটা যদি সাপোজিটরি হতো, তাহলে ছবি দিত কীভাবে?

লেখক : বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোথায় চলবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম?

জেসিও আমিনুল ইসলামের বক্তব্য তার একান্ত ব্যক্তিগত মন্তব্য

কুষ্টিয়া চিনিকলের যন্ত্রাংশ অন্য চিনিকলে স্থানান্তরে বাধা, ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

বায়ুদূষণে শীর্ষে কলকাতা, ঢাকায় বইছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস 

চট্টগ্রামে প্রাথমিকের ২৪ শতাংশ বই পৌঁছেছে

রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত হয় সেই বিমান

পঞ্চগড়ে শৈত্যপ্রবাহে তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রিতে

পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া ভারতের প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং

৩২ লাখ টাকার সেতুতে ৭ বছরেও উঠতে পারেনি কেউ

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বড় নিয়োগ, পদ সংখ্যা ১৮৬

১০

মহারাষ্ট্রে ১৭ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

১১

টিভিতে আজকের খেলা

১২

আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

শুক্রবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৪

ইতিহাসের এই দিনে যত স্মরণীয় ঘটনা

১৫

সুনামগঞ্জে নদীতে বালু উত্তোলনে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১০

১৬

খালাতো বোনের বিয়ে খেতে এলেন ছাত্রলীগ নেতা, অতঃপর...

১৭

পাল পাড়া মিনিবার ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত 

১৮

সরকারি বাঙলা কলেজে ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির আনন্দ মিছিল

১৯

দেশে ফিরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ব্যারিস্টার রাজ্জাকের

২০
X