কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদ প্রশাসন ক্যাডারের : অন্যদের অনাহুত প্রবেশ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে

মো. সাইফুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত
মো. সাইফুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদে সবসময় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পালন করে আসছেন। এই কাঠামো শুধু ঐতিহ্যের অংশ নয়, বরং দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের দক্ষতা, স্থিতিশীলতা এবং জনগণের সেবায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার ভিত্তি (জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ)। সম্প্রতি অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদের এ পদে ৫০ শতাংশ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে, যা প্রশাসনের সুষ্ঠু কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

কেন এই পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্যই? ১. মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের দক্ষতা : প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে সরাসরি জনগণের সঙ্গে কাজ করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে কাজ করার সময় তারা স্থানীয় প্রশাসনের সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। নীতিনির্ধারণে এবং তা বাস্তবায়নে তারা সুদক্ষ, কারণ তারা মাঠ পর্যায়ে কাজের মাধ্যমে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো সরাসরি মোকাবিলা করেন (জনপ্রশাসন গবেষণা প্রতিবেদন, ২০২২)। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের দপ্তরভিত্তিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, যা তাদের এই ধরনের নেতৃত্ব প্রদানে উপযুক্ত করে তোলে না।

২. প্রশাসনিক কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রাখা : উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদে অন্যদের প্রবেশ প্রশাসনিক কাঠামোর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পান। যদি অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ পদে প্রবেশ করেন, তাহলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হবে। এটি শুধু কর্মকর্তাদের মনোবল ভাঙবে না, বরং প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করবে (জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ)।

৩. মাঠ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব : প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে আসেন। এ অভিজ্ঞতা তাদের মাঠ এবং কেন্দ্রের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করতে সক্ষম করে। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেবে (Administrative Reforms in South Asia, ২০২১)।

৪. বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে : উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ৫০ শতাংশ অন্তর্ভুক্তি প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানবেন যে তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এটি তাদের কাজের প্রতি আগ্রহ এবং নিষ্ঠা কমিয়ে দেবে। অন্যদিকে, বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়হীনতা প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও জটিল করে তুলবে (জনপ্রশাসন গবেষণা প্রতিবেদন, ২০২২)।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ : কেন এটি কার্যকর নয়

বিশ্বের অনেক দেশের প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায়, নেতৃত্বের এই ধরনের পদে অনাহুত প্রবেশ প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ১.ভারত : প্রাদেশিক সচিবালয় থেকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নীতি নির্ধারণী পর্যায় সর্বত্রই IAS অফিসারগণ দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা সুবিশাল রাষ্ট্রের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পলিসি লেভেলে বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছে (Indian Administrative Service Handbook, ভারত সরকার)। ২.পাকিস্তান : PAS কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে নেতৃত্ব দেন। ৩.যুক্তরাজ্য : Civil Service Fast Stream যুক্তরাজ্যের উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব সিভিল সার্ভিসের একটি বিশেষ প্রোগ্রাম, Fast Stream-এর মাধ্যমে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত (UK Civil Service Official Portal)।

* পদ সংরক্ষণ : * নীতিনির্ধারণী এবং ব্যবস্থাপনায় উচ্চ পর্যায়ের পদে Fast Stream Officers নিয়োগ দেওয়া হয়। * অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করেন। * কারণ : * Fast Stream প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্বাচিত কর্মকর্তারা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হন। * ফলাফল : * দায়িত্বের সুনির্দিষ্টতা প্রশাসনের কার্যকারিতা বাড়ায়। * নেতৃত্বের মান বজায় থাকে।

৪. যুক্তরাষ্ট্র : Senior Executive Service (SES) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোতে Senior Executive Service (SES) কর্মকর্তারা উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে কাজ করেন (United States Office of Personnel Management)। * উপসচিব পর্যায়ের সমতুল্য : * নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় SES কর্মকর্তারা নেতৃত্ব দেন। * এই পদের জন্য নির্বাচিত কর্মকর্তারা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন করেন। * কারণ : * নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। * বিভিন্ন দপ্তরের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাডারগুলোর ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখা। * ফলাফল : * প্রশাসনের কার্যকারিতা এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

৫. অস্ট্রেলিয়া : Australian Public Service (APS) অস্ট্রেলিয়ার APS কাঠামোতে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক পদে নির্বাচিত কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। * নির্দিষ্ট ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ : * উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব APS-এর নির্দিষ্ট ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত। * ফলাফল : * দায়িত্বের বিভাজন সুনির্দিষ্ট থাকায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।

৬. চীন : Civil Servants System চীনে প্রশাসনিক কাঠামোতে নেতৃত্বদানের জন্য ক্যাডারভিত্তিক ব্যবস্থা রয়েছে। * উপসচিব পর্যায়ের সমতুল্য দায়িত্ব : * নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনের নেতৃত্বের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। * কারণ : * প্রশাসনিক কাঠামোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। * মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত।

উপসচিব এবং তদুর্ধ্ব পদে অন্যান্য ক্যাডারের প্রবেশ শুধু প্রশাসন ক্যাডার নয়, পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর হবে। যেমন : দায়িত্ব পালনের দক্ষতা কমবে : যারা মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া নেতৃত্বে আসবেন, তারা জনগণের সমস্যা বুঝতে এবং সমাধান করতে ব্যর্থ হবেন।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও সংঘাত : বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং তা প্রশাসনিক কাজের গতিকে ধীর করবে। পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব তৈরি হবে।

নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সংকট : যারা মাঠ প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন নন, তারা নীতি তৈরি এবং তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সংকটে পড়বেন। এ ছাড়াও বর্তমানে কাঠামোতে যে অনুপাতে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান, সেটা কমিয়ে দেওয়ার ফলে প্রতি ব্যাচেই একটা বিশাল সংখ্যক কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে রয়ে যাবেন। এভাবে কয়েক ব্যাচ মিলেই পদোন্নতিবঞ্চিত সিনিয়র সহকারী সচিবের বিশাল আকার পুরো রাষ্ট্র কাঠামোতেই দক্ষ মানবসম্পদের পরিবর্তে বোঝা পরিগণিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।

উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদ প্রশাসন ক্যাডারের। এই পদের দায়িত্ব অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দেওয়া প্রশাসনের কার্যকারিতা এবং স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অন্যান্য দেশেও প্রশাসনের এই ধরনের পদে বিশেষায়িত এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে এই পদে অন্যদের প্রবেশ এক ধরনের অনাহুত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, যা মাঠ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সমন্বয় নষ্ট করবে এবং জনগণের সেবাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রশাসনিক কাঠামোর ধারাবাহিকতা এবং দক্ষতা বজায় রাখতে এ ধরনের প্রস্তাব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

লেখক : মো. সাইফুল ইসলাম সিনিয়র সহকারী সচিব ও সাধারণ সম্পাদক, ইয়াং অফিসার্স ফোরাম অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের নামাজের সময়সূচি

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাচ্ছে ৩২০ পরিবার

সচিবালয়ের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ

ডিমলা উপজেলা আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক মিন্টু গ্রেপ্তার

সচিবালয়ে আগুনের কারণ সম্পর্কে যা জানালেন ফায়ার সার্ভিসের ডিজি

পদ্মায় কমছে পানি, পারাপারে ভোগান্তি

‘ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাতে পারবে না’

পাঁচ ঘণ্টা পর সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে 

ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি ব্রিজ, টনক নড়ছে না কারও

পীরগাছা উপজেলা আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক মিলন গ্রেপ্তার

১০

ট্রাকচাপায় আহত সেই ফায়ার কর্মীর মৃত্যু

১১

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১২

চার ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি সচিবালয়ের আগুন

১৩

সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী গুরুতর আহত

১৪

মধ্যরাতে সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ২০ ইউনিট

১৫

ভারতের অবিলম্বে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা উচিত : সিলেটে মির্জা ফখরুল

১৬

জয় বাংলা বলে খেজুরের রস খেতে গিয়ে কারাগারে ১৫ যুবক

১৭

১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করলেন মুক্তিযোদ্ধা কানু

১৮

নারায়ণগঞ্জে হাসপাতালে পিস্তল সাদৃশ্য দেখিয়ে টেন্ডার জমা দিতে বাধা

১৯

ঢাকা কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ

২০
X